ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

নভেম্বর বিতর্ক ও বর্ণচোরা ভাইরাস

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫৩

নভেম্বর বিতর্ক ও বর্ণচোরা ভাইরাস

আমাদের জাতীয় অর্জনের শেষ শিখা নিভিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বাঙালি জাতিসত্তার সবগুলো শিকড় উপড়ে ফেলার ঘৃণ্যতম মাস নভেম্বর। আগস্ট, নভেম্বর দু'মাস জাতীয় ইতিহাসে বর্বরতম নৃশংসতার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েছে। এ দু'মাসে ঘটেছে, ইতিহাস থামিয়ে দেয়ার মতো একের পর এক ভয়াল নৃশংসতা। সম্ভবত বিশ্ব মানচিত্রে পাকি- নামের অটিস্টিক শিশুটির পয়দা দিবসের কথা মগজে রেখে মাসটিকে পৃথিবীর বর্বরতম বঙ্গবন্ধু নির্মূল অপারেশনের জন্য বাছাই করা হয়। অদৃশ্য প্রভুবাবাদের নির্দেশেও হতে পারে।

'৭৫ এর ১৫ আগস্ট শিশু রাসেল, নব বিবাহিতা, হাতে টাটকা মেহেদী আঁকা দু'গৃহবধূ, চৌকস মেধাবী দু'পুত্রসহ ভয়াল বর্বরতায় বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের সব ক'জন সদস্যের রক্তে গোছল দেয়া হয় বাংলার মাটি। বঙ্গবন্ধুর শিকড়-বাকড় উপড়ে ফেলে পরাজিত পাকি আইএসআই'র এজেন্টরা ৭১'র পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়! তাদের বিশ্বস্ত মক্কেল কাপালিক দাদা ও খোন্দকার মোস্তাকের ঘাড়ে চেপে। পরপরই দেশ মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ছুঁড়ে ফেলে পাকি ঠিকানায় মোড় পাল্টে ফেলে।

এর পরে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে শেষ করে দিতে প্রকাশ্য দিবালোকে বঙ্গবন্ধু এভেনিউ'র সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে চলে ভয়াল গ্রেনেড হামলা। ভাগ্যক্রমে নেতাকর্মীদের মানবঢালে নেত্রী প্রাণে বাঁচলেও খুন হন দলনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী। হামলায় আহতের সংখ্যা কয়েক শ'! ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গি উত্থানের ঢঙ্কানিনাদ ঘোষিত হয়। দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে চোরাচালানে আসা দশ ট্রাক স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং বগুড়ায় বিশাল গুলির চালান ধরাও পড়ে। আড়ালে কত এসেছে হিসাব নেই। গোলা বারুদ ও মাদক চোরাচালানের নিরাপদ ট্রানজিট রুট বানানো হয় প্রিয় দেশকে।

আর ৭৫'র ৩ নভেম্বর জেলখানার নিরাপত্তা ভেঙে অবিশ্বাস্য বর্বরতায় খুন করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। জাতিসত্ত্বার শেষ শিকড়গুলো উপড়ে ফেলতেই সর্বকালের নৃশংসতম এত আয়োজন! তারপর ভয়াল ৭ নভেম্বর। বিপদগামী স্বঘোষিত বিপ্লবী জাসদ ও দেশবিরোধী আইএস আই জিন্দাবাদী কট্টর ডানেরা মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও নেতা খুনের উম্মাদনায় এক মোহনায় মিলে যায়! দু' বিপরীত ধারার খুনীচক্রের আজব ঐক্যের চূড়ান্ত ফসল এই দিনটি। ৩ নভেম্বর '৭৫ খোন্দকার মোশতাক ও তার ঘাতকচক্রকে বঙ্গভবন থেকে হঠিয়ে অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ সশস্ত্র বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ নেন। নয়া সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রথমে ইতিহাসের বর্বরতম বিশ্বাসঘাতক মোশতাককে আস্তাকঁড়ে ছুড়ে দেন। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যায় জড়িত স্মরণকালের বর্বরতম ঘাতক ফারুক-রশিদ-ডালিমদের কব্জা থেকে মুক্ত করেন দেশ ও বঙ্গভবন।

৩ নভেম্বরের খালেদ মোশাররফের পাল্টা অভ্যুত্থানের শুরুতেই আইএসআই'র পোষা দাস খোন্দকার মোশতাকের সরাসরি তদারকিতে জাতীয় চার নেতা জেলখানায় নৃশংসভাবে খুন হন। ৩ থেকে ৭ নভেম্বর '৭৫ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে' ঘৃন্য প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও রক্তঝরা দিন। বিস্ময় মানতে হয়, জাতির ক্রান্তিকালের নেপথ্যের বড় খেলোয়াড়টি বরাবরই অজ্ঞাতেই থেকে গেছে। তিনি আইএসআই তহবিলপুষ্ট কাপালিক জোব্বাদাদা সিরাজুল আলম খান। একদিকে পুতুল মোশতাকের বকলমে বঙ্গভবনে বসে দেশ চালাচ্ছে বর্বর খুনী হার্মাদ দস্যু ফারুক, রশিদ, ডালিম চক্র। দেশ বিশৃঙ্খল, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড শেষ! বীর মুক্তিযোদ্ধা মে.জে. খালেদ মোশাররফ অসম সাহসিকতায় ঘাতক-তস্করমুক্ত বাহিনী পুনর্গঠন ও দেশে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নির্ঘুম শ্রম দিচ্ছেন, বিপরীতে বিভ্রান্ত জোব্বাদাদার নির্দেশে জাসদ কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে পাকি আইএসআই'র পুতুল হয়ে খালেদ মোশাররফদের শেষ করে দিতে গাণবাহিনীর সহায়তায় সিপাহী বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেন, সেনা ব্যরাকে। ফলাফল, ক্ষিপ্ত সিপাইরা অফিসারদের রক্তপানে মরিয়া হয়ে ট্যাঙ্ক-কামান, সাঁজোয়া বহর নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তাহেরের ইশারায় ক্লান্ত নিরস্ত্র খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হায়দার, কর্নেল হুদাসহ বহু দেশপ্রেমিক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে রক্তপাগল উম্মত্ত সিপাইরা। জোব্বাদাদা, কর্নেল তাহের গং-এর সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডসহ সব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কুশীলব জিয়াকে কোলে তুলে সেনা প্রধানের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেন। সব কুকর্মের রিমোট ছিল অদৃশ্য আইএসআই'র হাতে। কথায় বলে, 'আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর'! ঠিক তাই ঘটছে, আইএসআই'র পাকিস্তানের ভাগ্যে। দেশটি এখন প্রকৃত অর্থেই তলাবিহীন ঝুড়ি। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারে ওঠানামা করছে। বিপরীতে আমাদের ৪৮ বিলিয়ন+। পাকি বৈদেশিক ঋণের বোঝা ৮ লাখ কোটি রূপির কাছাকাছি! বিশাল ঝণের কিস্তি পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে বিশ্বের প্রথম দেওলিয়া দেশের পর এখন একলাফে চীনা ঋণের ফাঁসে! এটাই মোসতাকচক্রের পেয়ারি পাকিস্তান! আইএসআই এখন খেলছে তালেবান কব্জার আফগানিস্তান নিয়ে। কিন্তু দেশি পাকি তালেবান আর বালুচ স্বাধীনতা যোদ্ধারা আরামে অস্ত্রে শাণ দিচ্ছে। সুযোগমত ফ্রাঙ্কেনস্টাইনটি গলা কাটবেই বেইমান পাকিদের। যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বিলিয়ন ডলার সন্ত্রাস নির্মূল আর্থিক সহায়তা দীর্ঘদিন বন্ধ রাখায় বাজেট ঘাটতি লেগেই আছে। সুযোগমতো পীত বড় শক্তিটা টেনে তোলার নামে আটকে নিয়েছে কঠিন শর্তের ঋণ নামের এ্যনাকুন্ডার প্যাঁচে! গরম তাওয়া থেকে অগ্নিকুণ্ডে পড়েছে দেশি দালালদের পেয়ারা মুলুক পাকিস্তান! বাংলাদেশি এজেন্টরাও পৃষ্ঠপোষকতা বঞ্চিত হয়ে দলছুট হয়ে যাচ্ছে অনেকে।

৭৫'র ১৫ আগস্ট থেকে ৯৬'র জুন পর্যন্ত টানা ২১ বছরে সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদের অন্ধকারের সুড়ঙ্গে ঠেঁসে ধরে দেশকে বিকৃতির অন্ধকুপে পৌঁছে দেয়, আইএসআই এজেন্ট কাপালিক জোব্বাদাদার পরোক্ষ সাগরেদরা। এই একুশ বছর জাতিকে হাজার বছর পেছনে টেনে নেয়ার ঘৃণ্য ইতিহাস! বিকৃতির জের এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে জাতিকে। এমনকি ক্ষমতাসীন বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগেও বিকৃতির সংক্রমণ ব্যাপক। দুঃখ, বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর কাপালিক দাদার নির্দেশনায় কর্নেল তাহের জিয়াকে ক্ষমতায়ন করতে খালেদ মোশাররফসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে খুনের দাম মাত্র দেড় মাসেই শোধ করেছেন। দ্রুততম সময়ে তাকে কোর্ট মার্শালের নামে নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়। জাসদ ও গণবাহিনীর নেতাদের খুন ও আটক করেন জিয়া। টুকরো টুকরো করে দেন কাপালিক জোব্বাদাদার জাসদের উচ্চাভিলাষ! তবুও জাসদ ভয়ংকর দিনটিকে উদযাপন করে অদ্ভুত এক নামে!

সে যাই হোক, দেশ এখন ক্রান্তিকালে। জননেত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, অনিয়মের আবর্জনা সাফে মাঠ চাষ দিচ্ছেন। শুদ্ধিকরণ চেষ্টা চলছে নিজ দল থেকে। আসলে এটা বিষাক্ত সাপের ঝাঁপি। রাজনীতি, মিডিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ সব সেক্টর এবং পেশাজীবী অঙ্গনেও বর্ণচোরা জিয়া-মোসতাক ও উগ্রবাদী এজেন্টরা গেড়ে বসেছে। সহায়তা দিচ্ছে, নেত্রীর আস্থাভাজন এবং সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী কিছু প্রভাবশালী নেতা। দুধকলা খাইয়ে ঢাকা- চট্টগ্রামসহ দেশের নানা অঞ্চল থেকে বিষধর সাপদের তুলে আনছে, পুষছে সরকারি সুবিধা বিলিয়ে। এরা আবার গণভবনঘনিষ্ট বঙ্গবন্ধুর তাবিজ ফেরিওয়ালা বচনবিদ নেতাও। দেশ, দল, বঙ্গবন্ধু বা নেত্রী নন, নিজেদের প্রভাববলয় ও গোষ্ঠীস্বার্থ সুরক্ষায় আত্মঘাতি মিশন এগিয়ে নিতে মরিয়া চক্রটি। বর্ণচোরা বিষাক্ত সাপের ফনা গুঁড়িয়ে দেয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে হেলায় ফেলায়। এদের বিষ ফনা বঙ্গবন্ধু ও নেত্রীর ছাপমারা রঙিন সেলোফেন মোড়কে ঢাকা আছে। এটা সরকারি সব সুবিধা হাতানো ও বেপরোয়া চাঁদাবাজির চমৎকার কৌশলও বটে। বর্ণচোরাদের সেলোফেন মোড়ক দেখিয়ে নেত্রীকে আঁধারে রেখেছে, আস্থাভাজন নেতারা। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের জালটি এত নিপুনভাবে পাতা, নেতার আশীর্বাদে রঙিন মোড়কধারীরা শীর্ষ নেত্রীর কাছে ভিড়ারও সুযোগ পাচ্ছে। যা ভয়ঙ্কর জাতীয় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। নেত্রীই এখন জাতির আশা ভরসার একমাত্র বাতিঘর। বাতিঘর সুরক্ষার দায় দেশপ্রেমিক সকল রাজনীতিক ও পেশাজীবীর। দ্রুত তাকে সচেতন ও সতর্ক করা জরুরি।

একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব, ষড়যন্ত্রের নিপুণ জাল ভেদ করে আপদ-বিপদ সমূলে নির্মূল করা। বিশ্বাস, ভাগ্যশিকারীদের ষড়যন্ত্রের জাল যত নিপুণ হোক, মরণজয়ী নেত্রীর চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব না। বিলম্বে হলেও ঘরের শত্রুরা শনাক্ত হবে নিশ্চিত। সব আপনজনকে এক ভয়াল ভোরে হারিয়েছেন তিনি। মৃত্যুকে বারবার ফাঁকি দিয়ে দেশকে বিশ্ব মর্যাদার আসনে তুলে এনেছেন। বেশি দিন প্রিয় নেত্রীকে বোকা বানানো সম্ভব নাও হতে পারে।

মজা হচ্ছে, চিহ্নিত শত্রুরা অনেকটা কাবু। জীঘাংসার নায়িকা জিন্দাবাদীদের মূল দু'নেতার একজন জেল থেকে সরকারের দয়ায় জমিন নিয়ে চিকিৎসায়, অন্যজন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি! বিদেশের গর্তে বসে শিয়ালের হুক্কাহুয়া সাইবার ডিম পাড়ছে। ড. কামাল বয়স ও দলের পোড়া ঘায়ের যন্ত্রণায় চুপ; মান্না, নুরু, খুরুর মতো জয় বাংলাওয়ালারা রঙ পাল্টে জিন্দাবাদী ও সাম্প্রদায়িকতার পালে জোর হাওয়া দিচ্ছে। মূল জিন্দাবাদীরা মাজা ব্যাথায় কাতর। সাইবার প্রক্সির নামে উগ্রতার বিষ ঢালছে পলাতক দেলু, কনক, শহীদ, তাজু, ইলু প্রমুখরা। কাপালিক জোব্বাদাদা আছেন চুপচাপ। দেশকে ভয়াল অন্ধকার আবর্তে ঠেলে দেয়ার নেপথ্য নায়কটি কর্পোরেট দয়া-দক্ষিনায় আছেন মোটামুটি। কিন্তু রাজনীতি ও পেশাজীবী গোত্রের মুখোশের আড়ালে ফনা লুকানো ভাইরাসচক্র হচ্ছে, ভয়ঙ্কর গৃহশত্রু। এদের মুখোশ দ্রুত খুলতেই হবে।

ফেরা যাক ভয়াল নভেম্বর প্রসঙ্গে। বাস্তবে ৭ নভেম্বর দিনটি শুধু মুক্তিযোদ্ধা-সেনা হত্যা দিবস ছিল না, ছিল প্রিয় দেশকে সরাসরি পাকি আইএসআই'র হাতে তুলে দেয়ার দিন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বেঁচে না থাকলে বা দেশের হাল না ধরলে আজকের মৃত তথা ভিখারি পাকিস্তানের ছেঁড়া ডানার ছায়ার থাকতো প্রিয় দেশ। নিষ্ঠুর সত্যটি কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারে না, কাপালিক জোব্বাদাদা ও তার ছিন্নভিন্ন অসংখ্য টুকরোয় বিভক্ত জাসদ বা সহযোগিরা। এসব পিছে রেখে এখন বর্ণচোরা গৃহশত্রু বিষাক্ত ভাইরাস নির্মূল জরুরি সবার আগে।

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • পঠিত