ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

বর্ষসেরা খলচরিত্র: করোনা

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:২৭

বর্ষসেরা খলচরিত্র: করোনা

পৃথিবী ইতিহাসের ভয়াল বাঁক পার করছে এখনো। তবুও অনেক সাড়া জাগানো ঘটনা, দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে একের পর এক। দেশ বিদেশে সবখানেই। যা বর্ষসেরা খবর বা চরিত্র হিসেবে উঠে আসতে পারে। তবুও বছরের মাঝখানে হঠাৎ করে উঠে আসা করোনার আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ঢেউকেই বেছে নিতে হয়। অতিমারি করোনা ভাইরাসটা এত দ্রুত চরিত্র বদলাচ্ছে, এত পিছলা সে, চিকিৎসাবিজ্ঞান কোনভাবে সাইজে আনতেই পারছে না। এমনিতেই প্রায় দু'বছর আগে করোনা নামের অচেনা শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর প্রথম ছড়িয়ে পড়ে আমাদের গ্রহে! পরপরই অসংখ্য দেশ আক্রান্ত হয় ভাইরাসে। ভয়াল অতিমারীর চাপে খ্রিস্টীয় বা গ্রেগরিয় ২০২০ সালকে টপকে গতবার একলাফে চুপচাপ ঢুকে পড়ে ২০২১ সাল। কোন উৎসব, আয়োজন, হুল্লোড়, জমকালো পার্টি কিছুই ছিল না। বিশ্বের সব নামিদামি হোটেল, পর্যটন রিসোর্ট, নাইট ক্লাব, পাব, ডিজে পার্টির হুল্লোড় একদম না, চুপচাপ ঠাণ্ডা। বিশ্বকে ইতিহাসে প্রথম নিরামিষ খ্রিস্টীয় নববর্ষ বরণ করতে বাধ্য করে কভিড-১৯! এবারও প্রায় ঢুকে পড়ছে ২০২২। কিন্তু করোনা বারবার স্ট্রেইন বদলে হামলা চালু রেখেছে এখনো। শক্তিশালী ডেল্টা ও ডেল্টা প্লাসের চেয়েও সংক্রমণে শক্তিশালী করোনার ওমিক্রন ভাইরাস যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকা ও লাতিনে জোর ছোবল চালাচ্ছে। ২৭ ডিসেম্বর একদিনেই বিশ্বে করোনার নতুন ঢেউয়ে মারা গেছেন ৭ লাখের বেশি মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রে একই দিনে আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ভেঙে প্রায় দুই লাখ। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর রেকর্ড রাশিয়ায়। ভারতেও আক্রমণ প্রবল। রাজধানী নয়াদিল্লীতে জারি করা হয়েছে নৈশ কার্ফু। অস্ট্রেলিয়া ওমিক্রনে একজনের মৃত্যুর পর সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়। ওমিক্রনের নতুন ঢেউয়ের পর দৈনিক করোনা আক্রান্তের সংখ্যা লাখের অঙ্ক পার করছে বৃটেনও। অন্য দেশগুলোর অবস্থাও খুব ভালো না। গত বছরের মতো পৃথিবীর নানা দেশে এবারের নববর্ষেও উম্মাদনা আর উচ্ছ্বাসের সুনামি বইবে না, এটা একরকম ধরে নেয়া যায়। বড়দিন তথা মেরি ক্রিসমাস উৎসব কিছু ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। আনন্দ উচ্ছ্বাসের বদলে ইউরোপ এবং খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশগুলোতে আনন্দ ছাটাই করে গির্জায় প্রার্থনা সভার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। উৎসবও হয়েছে কাটছাট। গির্জায় গির্জায় মানবজাতিকে করোনার স্ট্রেইন বদলানোর কবল থেকে সুরক্ষায় প্রার্থনা করেন খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা।

ইংল্যান্ড বিশেষ করে রাজধানী লন্ডনে নতুন চরিত্রের ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন ভাইরাসের হামলা এক কথায় ভয়াবহ। সপ্তাহের ব্যবধানে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং আরও বহু দেশ শত শত আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক দেশ কিছু দেশের নাগরিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। ভাইরাসটির চরিত্র বদল ও হামলার তীব্রতা পুরো বিশ্বকে বিস্মিত করে দিয়েছে। কেন এমন হচ্ছে, প্রশ্নের জবাব নেই। করোনার কোন কার্যকর ওষুধ ২০২১ সালেও আসেনি। ভাইরাসটির চরিত্র বদল ও টানা আক্রমণ, বিশ্ব অর্থনীতি এমনকি রাজনীতিকেও নাজুক অবস্থায় ঠেলে দেয়। বিশ্ব অর্থনীতি বিশেষ করে বিমান পরিষেবা,পর্যটনসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ খাত স্বাভাবিক হয়নি। দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন আমাদের দেশেও এর প্রভাব বিশাল। সবকিছু নতুন করে সাজিয়ে নেয়ার প্রস্তুতিপর্বে আবারও হামলা চালাল করোনার নতুন স্ট্রেইন ওমিক্রন। এটা ফুসফুসের জন্য বিপজ্জনক না হলেও সংক্রমণের মাত্রা খুবই শক্তিশালী।

আমরা জানি, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মহামারি অতিমারির হামলা হয়েছে। অসংখ্য জনপদ রাতারাতি মৃত্যুপুরিতে পরিণত হয়েছে। প্লেগ, কলেরা, জলবসন্ত, কালাজ্বরে আমাদের উপমহাদেশেও লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। বর্ধিষ্ণু জনপদ রাতারাতি বিরানভূমি হয়ে গেছে। তখন এসব মহামারির কোন চিকিৎসা বা প্রতিষেধক ছিল না। তাই আক্রান্ত হওয়া মানেই ছিল মৃত্যু।

কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান অনন্য উচ্চতায়। হাড়গোড়সহ হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভার, ফুসফুস পর্যন্ত প্রতিস্থাপন এখন জটিল কিছু না। ফাইবার তন্তু দিয়ে মানব প্রত্যেঙ্গও তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে মানব জীবনকে অনেক সহজ ও স্বচ্ছন্দ করে দিয়েছে। গড় আয়ু কোন কোন উন্নত দেশে এখন শত বছরের কাছাকাছি। আমাদের দেশেও মানুষের গড় আয়ু ঔপনিবেশিক আমলের ২৭ বছর গড় থেকে উন্নীত হয়ে এখন ৭৪ বছর। এসব উন্নয়ন এক কথায় অবিশ্বাস্য। অতি বিরল ছাড়া সব রোগের ওষুধ এখন হাতের কাছেই। কিন্তু ব্যতিক্রম করোনা। ২০১৯ সালের শেষ দিকে চিনে রোগটি প্রথম শনাক্ত হয়। পরে চিন ছাড়িয়ে ২০২০ সালে পুরো পৃথিবী দাপাচ্ছে কভিড-১৯ ভাইরাস নামের অতিমারিটি। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১১ কোটির ওপরে। মৃত্যুর সংখ্যা তিন মিলিয়নের কাছাকাছি। পৌনে দুই বছরেও রোগটির কার্যকর ওষুধ আসেনি। প্রতিষেধক টিকা আবিস্কৃত হলেও ভাইরাস দ্রুত চরিত্র পাল্টানোর কারণে কিছুটা ধোঁয়াশাও ছড়াচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য অগ্রযাত্রাকে জবরদস্তি থামিয়ে দিয়েছে এই অতিমারি! ২০২০/২১ সাল পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছে ভাইরাসটি। করোনার প্রধান উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গেলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বাড়তি অক্সিজেন প্রয়োগ করে স্যাচুরেশন স্বাভাবিক করা হয়। শ্বাসকষ্ট কত যন্ত্রণার, যারা মৃত্যুর গুহা থেকে ভাগ্যক্রমে ফিরেছেন একমাত্র তারাই জানেন। হাসপাতাল ও রোগীর অবস্থানভেদে অক্সিজেন কিনতে ঘণ্টায় ২০০ থেকে হাজার টাকা খরচ হয় একজনের। দিনের হিসাবে প্রায় ৫ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা। অথচ সুস্থ অবস্থায় আমৃত্যু ফ্রি পেয়ে যাচ্ছি জীবনদায়ী অক্সিজেন। যার মূল্য হাজার হাজার কোটি টাকা! প্রশ্ন উঠেছে, করোনা কি প্রকৃতির প্রতিশোধ? অনেক প্রকৃতি বিজ্ঞানীও তাই বলছেন। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ আমরা পুরোই দূষিত করে ফেলেছি। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা, ওজন স্তরের ক্ষয় এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা মেরামত মানুষের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। ভোগবাদের জঞ্জাল আধুনিক ও বিলাসবহুল গেজেট, সাজসরঞ্জাম, প্রকৃতি বিনাশ, বেপরোয়া পাহাড়, বৃক্ষ নিধন, প্রাকৃতিক জলাধারসহ পুকুর দিঘি ভরাট করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছিন্নভিন্ন করে আমরা নিজেদের কবর খনন করেছি। এর প্রথম বিষফল, করোনার মতো অজেয় ভাইরাস। স্বাভাবিক কারণে ২০২০ এর প্রথম পক্ষ থেকে ২০২১ পৌনে দু'বছর ছিল করোনার ঝোলায়। ২০২২ সালে কী ঘটবে বা আসবে তা ভবিষ্যতের গোপন পকেটে। জ্যোতিষ মহারাজ বা সম্রাটের সাল গণনায় এর কোন প্রভাব পড়বেই না। মজার ব্যাপার, রাষ্ট্রীয় সতর্কতা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু করোনার কথা প্রায় ভুলেই গেছি। বিয়ে, পার্টি, জলসা, মাহফিল, ওরশ, পিকনিক, পর্যটন কেন্দ্রে মানবঢল, সমাবেশ, মেলা সব চলছে মহা উৎসাহে। কোমর বেঁধে করোনার উৎসব ও সফর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যেন মাঠে নেমেছি আমরা! নববর্ষ নিয়েও হুলস্থুল হবে না, গ্যারান্টি নেই। ওমিক্রন বা করোনা ভীতি আমাদের নেই! যদিও রোগী আছে, মৃত্যুও আছে। অন্য দেশ কী করছে, কী হচ্ছে তাতে আমাদের যেন কিচ্ছু এসে যায় না! সরকারের দায়িত্বশীল মহল সর্বোচ্চ সতর্ক না হলে কপালে হয়তো বড় দুঃখ আছেই।

মোস্তফা কামাল পাশা, সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত