ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

বেঁচে থাকলে শতবর্ষে পা দিতেন সামাদ আজাদ

প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ১১:১৯  
আপডেট :
 ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ১২:১১

বেঁচে থাকলে শতবর্ষে পা দিতেন সামাদ আজাদ

আজ বেঁচে থাকলে শতবর্ষী রাজনীতিক হতেন আব্দুস সামাদ আজাদ। ৫০ বছরের রাষ্ট্র বাংলাদেশের দু’দুবারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ,পাচবারের এমপি আব্দুস সামাদ আজাদের শততম জন্মদিন আজ।

তিনি ১৯২২ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান ভারতের এমন কোনো গনতান্ত্রিক আন্দোলন নেই, যার সাথে ছিলেন না আব্দুস সামাদ আজাদ। নব্বইয়ের দশকে যখন আমরা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ও একই সাথে মাঠের শিক্ষানবীশ রিপোর্টার,তখনই মিছিলেই পরিচয় আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে। পায়জামা-পাঞ্জাবীর সাথে কেডস পায়ে মিছিলে হাটতেন দৃঢ়তার সাথে,তখনই বয়সে প্রবীন কিন্তু তরুণ রিপোর্টারদের সাথে তার সখ্যতায় আমরাই ঋদ্ধ হতাম প্রতিদিন।

একজন সিরিয়াস বর্ষীয়ান রাজনীতিক কতটা তারুণ্য আর হাস্যরস ধারণ করতে পারেন, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন আব্দুস সামাদ। আমার অনুজপ্রতিম সাংবাদিক এখন বাংলাদেশ প্রতিদিনের নগর সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেনের কাধে হাত দিয়ে একমাত্র বোধহয় সামাদ আজাদের পক্ষেই বলা সম্ভব ‘আমি আর জাহাঙ্গীর সমান সমান, আমরা ছাপা শার্ট পরি।’

১৯৯৬ সালের ২৩ জুন ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন আব্দুস সামাদ আজাদ। যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পরবর্তী সরকারেও একই দায়িত্বে ছিলেন। আরও দায়িত্ব পালন করেছিলেন কৃষি,সমবায় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েরও।

১৯৯৬ সালের ২৩ জুন মন্ত্রী হবার কিছুদিন পরেই বাংলাদেশ জার্নালের সম্পাদক শাহজাহান সরদারের (তখন দৈনিক ইত্তেফাকে কর্মরত) সাথে গেলাম সামাদ আজাদেন দপ্তরে। তখন রাষ্ট্রপতি পদে আছেন বিএনপির আব্দুর রহমান বিশ্বাস। আওয়ামী লীগের মধ্যে ব্যাপক গুঞ্জন কে হবেন রাষ্ট্রপতি? আমরা শুনলাম মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান ও আব্দুস সামাদ আজাদের কাছে কাগজ পাঠানো হয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদের টেবিলের উল্টোদিকে আমি আর শাহজাহান ভাই বসা। তো আমি জানতে চাইলাম ‘লিডার একটা খবর পাচ্ছি, বঙ্গভবনে গেলে কিন্তু আমরা এখানেই থাকবো,গেস্টহাউস নাকি আছে সেখানে?’ তুখোড় রাজনীতিক প্রশ্নকর্তা আমার দিকে তাকাচ্ছেনই না, উল্টো শাহজাহান সরদারের কাছে জানতে চান ‘ছেলে কি বলে,কিতা খবর আছে নাকি ?’

এমন অনেক হাস্যরসের ঘটনার স্মৃতি আমাদের অনেক সাংবাদিকের সাথেই আছে। ১৯৯৪ সালের কোনো এক সময় একবার রাত দশটায় সামাদ আজাদের কলাবাগানের বাসার টিএন্ডটি নম্বরে (তখন অবশ্য মোবাইল ফোন ছিলোনা) ফোন করার পর একজন নারী ফোন ধরে বললেন ‘ন্যাতা ঘুমায় গেছে’। কথাটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ নেতা ঘুমাতেন গভীর রাতে। পরের দিন ২৯ মিন্টোরোডে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে আব্দুস সামাদ আজাদকে পেয়ে, অনুযোগের সুরে বললাম ‘লিডার রাত দশটায় আপনি ঘুমান, কিন্তু কাল বাসা থেকে বলে দিল আপনি ঘুমিয়ে গেছেন। কেন ফোন ধরলেন না ? সম্পর্কের অধিকারটাই এমন ছিলো যে বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য সত্বেও অনেক খোলামেলা কথা আমরা বলতে পারতাম।

আবার সামাদ আজাদ ‘চাচা’ ডাকা পছন্দ করতেন না, আমরাও ভাই বলতে সংকোচ বোধ করতাম ওনার বয়সের কারনে। তাই মাঝামাঝি লিডার বলেই সম্বোধন করতাম। তো উনি অনুযোগের জবাবে মুখ টিপে হেসে বললেন ‘ভোরের কাগজের ফোন ধরতে হয়, কিন্তু যখন কাজের মেয়ে বললো ঘুমায় গেছে, তখন আমি ঘুমায় পরলাম, এখন কও কি তা জানতে চাও? আমি প্রশ্ন করলাম, স্নেহের হাত ঘাড়ে রেখে মিন্টোরোডের সবুজ লনের এমাথা থেকে ওমাথায় গিয়ে সত্যি অনেকগুলো তথ্য দিলেন। আমি আস্তে হাতটা ঘাড় থেকে নামিয়ে হ্যান্ডশ্যাক করে সোজা দৌড় দিলাম বাংলামটরের ভোরের কাগজের অফিসের দিকে। একটা বিশেষ রিপোর্ট লিখতে পারার আনন্দ এ লেখায় বোঝানো সম্ভব নয়।

কিন্তু এখনো স্পষ্ট মনে আছে পরের দিন একটু দেরিতে গিয়েছিলাম মিন্টো রোডে, গেটের কাছেই দেখি আব্দুস সামাদের গাড়ী ,কাচ নামিয়ে শুধু ভোরের কাগজটা দেখলাম, আর তার চোখের ঝিলিকে বুঝলাম খুশী হয়েছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক, তখনকার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ।

মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারে যিনি মন্ত্রীর মর্যাদায় বিাভন্ন দেশে গিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য। যার রাজনীতি শুরু হয়েছিলো ছাত্রজীবনেই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। ন্যাপের রাজনীতি দিয়ে বামপন্থী রাজনীতি দিয়ে শুরু করে আব্দুস সামাদ আজাদ ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল মারা যান। তখন তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য। খুব মনে পরে মৃত্যুর কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে ভারত যাবার আগে একদিন বাসায় গিয়ে দেখা করলাম। খুব খুশী হলেন, আর ক্ষীণকণ্ঠে বললেন ‘দেখতে আইছো দোয়া কইরো ,নিউজ করার দরকার নাই ’।

আপাদমস্তক রাজনীতিক আব্দুস সামাদ আজাদের সাথে পরিচয় বিরোধীদলে থাকতে। মন্ত্রী হওয়ার পর জোর করে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের জন্মভূমি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ হেলিকপ্টারে সুনামগঞ্জ থেকে ফেরার পথে বিপদজনক পরিস্থিতিতে পরেছিলাম। আজ সেটা বিস্তারিত না বললেও শুধু এটুকু বলি,পরের দিন অফিসে গিয়ে পিআরও আব্দুল্লাহ ভাইকে পাঠিয়েছিলেন প্রেসক্লাবে। তিনি এসে পেয়েছিলেন আমাকে। গিয়ে দেখি দুপুরের খাবার নিয়ে বসে আছেন।

আজ আব্দুস সামাদ আজাদের জন্মদিনে তাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানালাম। কারণ যে কয়জন রাজনীতিকের সহযোগিতা এবং স্নেহ পেয়ে রাজনীতিক রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতার সূচনায় হাত পাকিয়েছিলাম আব্দুস সামাদ আজাদ তাদের অন্যতম। এমনকি সিলেটের রাজনীতিতে অপর তুখোড় র্পালামেন্টেরিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথে সামাদ আজাদের রেষারেষি অনেকটাই প্রকাশে ছিলো, কিন্তু দুজনের স্নেহই পেয়েছি বরাবর। পরস্পরের বিরুদ্ধে টিকা-টিপ্পনি বরং আমরা উপভোগই করতাম। রাজনীতির সেও এক ভিন্নধরনের সৌন্দর্য। আজ যা একেবারেই অনুপস্থিত। সেই অভাব বোধ থেকেই বারবার স্মরণ করি আব্দুস সামাদ আজাদের মত সিজনড পলিটিশিয়ানদের।

সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত