একাত্তরের সংশপ্তক: এখলাসুর রহমানের ছয় পাপড়ির এক ফুল
তুহিন তৌহিদ
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৮:০৯ আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:৪৭

কখনো ব্রিটিশ ভারতের সিলেট-ত্রিপুরা অঞ্চলের ইতিহাসের আবহ, কখনো চা বাগানের মানুষের জীবন, সেখানে ইডিপাস কমপ্লেক্সের মতো জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের সংযোগ, কখনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ওপর আলোকপাত- গল্পগ্রন্থ ‘একাত্তরের সংশপ্তক’ যেন ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব ও সংবেদনশীলতার ছয়খণ্ড উপাখ্যান।
গল্পকার এখলাসুর রহমান যেন এক জাদুকর- যিনি গল্পে একইসঙ্গে সমাজের দলিত শ্রেণির মানুষের জীবন যেভাবে তুলে এনেছেন, তেমনি রাজা-মহারাজাদের অন্দরমহলের চিত্রও এঁকেছেন সুনিপুণভাবে।
‘একাত্তরের সংশপ্তক’ সবমিলিয়ে ছয়টি গল্পে সাজানো। প্রত্যেকটি গল্প একটি থেকে অন্যটি পৃথক, যেন গ্রন্থটি ছয়টি পাঁপড়ির একটি ফুল। প্রত্যেকটি পাঁপড়ির আলাদা আলাদা ঘ্রাণ।
পেশায় চিকিৎসক লেখকের অন্তর্দৃষ্টি অসামান্য। প্রত্যেকটি গল্পে তিনি চরিত্রের গভীরে যাওয়ার অসাধারণ চেষ্টা করেছেন। এটি তার গভীর জীবনবোধেরই পরিচায়ক।
প্রথম গল্প ‘মহারাজার মহাপরাজয়’-এ ত্রিপুরার এক জমিদারের অন্দরমহল ও তার অবস্থা চিত্রিত হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের আবহে গল্পে তিনি অনেকগুলো চরিত্র তুলে এনেছেন।
এরমধ্যে রয়েছে কাবিল মুস্কুরি নামের একটি চরিত্র, যিনি ব্যক্তি হিসেবে সৎ, সাহসী এবং বুদ্ধিমান। তিনি ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্রের সঙ্গে জমিজিরাত নিয়ে আইনী লড়াইয়ে জেতেন। গল্পের উপজীব্য এটা হলেও এর মধ্য দিয়ে তখনকার সময়ের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার একটি স্পষ্ট ধারণা পাঠকের চোখে ভেসে ওঠে।
‘নিরাকার ভালুকের দাঁত’ শিরোনামের গল্পটি একটি মেয়েকে নিয়ে, যে মানসিকভাবে অসুস্থ। একটি হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তার চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করেন সজল নামের তরুণ চিকিৎসক।
অধ্যাপক ডা. এখলাসুর রহমান
এক সময় রোগী ইলোরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়েন চিকিৎসক সজল নিজেই। গল্পের শেষে তাকে ইলোরার মতোই অসুস্থতা নিয়ে চিকিৎসাগ্রহণ করতে দেখা যায়। অনেকটা সিনেমার ট্রাজেডি।
বাবার দ্বিতীয় বিয়ে ও সৎ মায়ের আচরণকে কেন্দ্র করে ইলোরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও চিকিৎসক সজলের অসুস্থতার কারণ নিয়ে ছিল রহস্য। হতে পারে ইলোরার জন্য তার মনের গহীনে জন্মেছিল অব্যক্ত প্রেম, যা তিনি প্রকাশ করেননি। আর শেষ পর্যন্ত ইলোরার বিয়ে ও ভালো থাকাটাকে মেনে নিতে পারেননি।
গল্পগুলোর মধ্যে ‘পবিত্র পাপী’ লেখা হয়েছে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’ থিমের ওপর। গল্পটি যেন গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের ‘কিং ইডিপাস’ নাটকের ব্যতিক্রমী বাংলা ভার্সন।
গল্পের পরতে পরতে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। এখানে অবিনাশ ও মালিনী মূল চরিত্র। সম্পর্কে এরা একইসঙ্গে স্বামী-স্ত্রী এবং মা-পুত্র। চা বাগানের প্রকৃতিক পরিবেশের মধ্যে এ যেন ভয়ঙ্কর এক ট্র্যাজেডির রূপায়ণ।
শেষ গল্পটি ‘একাত্তরের সংশপ্তক’। এটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি ঘটনার উপাখ্যান। একটি পরিবার যুদ্ধ চলাকালে কীভাবে দেশ ছেড়ে ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় নিলো, সে চিত্রই উঠে এসেছে গল্পটিতে।
গল্পের শেষে প্রধান চরিত্র শাহনুর খান গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হন। তিনি মারা গিয়েছিলেন কিনা, গল্পকার তা শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট করেননি।
কিন্তু তার মৃত্যু ছিল রহস্যের আবর্তে। কারণ, মেধাবী এ মানুষটিকে দেশকে মুক্তি করার লড়াইয়ে দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত তাকে রাজাকারের তকমা নিয়ে গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে।
লেখক: অধ্যাপক ডা. এখলাসুর রহমান।
অধ্যক্ষ আনোয়ার খান মডার্ণ মেডিকেল কলেজ
দেশের অন্যতম শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ জার্নাল/টিটি/আরকে