ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

একজন আনলাকি থারটিন সিইসির অপেক্ষায়!

প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:৪৭  
আপডেট :
 ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:০৫

একজন আনলাকি থারটিন সিইসির অপেক্ষায়!

আমরা দেশের ১৩ তম প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অপেক্ষায় আছি। আর এবারই প্রথম একটি আইনের বিধানে গঠিত হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সেই নির্বাচন কমিশন কেমন হবে? সার্চ কমিটি তাদের পক্ষ থেকে ১০জনের নামের তালিকা হস্তান্তর করেছে রাষ্ট্রপতির কাছে। পত্রিকায় এরইমধ্যে শিরোনাম হয়েছে ‘চোখ এবার বঙ্গভবনের দিকে’।

সংবিধান রচনার ৫০ বছর পর, সংবিধানের বিধান বাস্তবায়নের জন্য আইন হয়েছে। আর সেই আইনের আওতায় গঠিত সার্চ কমিটির দেয়া নামগুলো এখন রাষ্ট্রপতির কাছে। দু-একদিনের মধ্যেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। জাতি অপেক্ষায় আছে দেশের ১৩তম নির্বাচন কমিশন কেমন হয়,তা দেখার জন্য।

এখন পর্যন্ত আমরা ১২ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে এক ডজন নির্বাচন কমিশন পেয়েছি। দুর্ভাগ্যবশত কোনো কমিশনই পূর্ন সম্মান নিয়ে বিদায় নেয়নি, আর কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনই পুরো জাতির কাছে সবোর্চ্চ সম্মান অর্জন করেনি। সব নির্বাচন নিয়েই ‘সুক্ষ-স্থুল কারচুপির’অভিযোগ ছিল। আর নির্বাচন পরিচালনা এমন একটি দুরূহ কাজ যে, সকল পক্ষকে শতভাগ সন্তুষ্ট করাও সম্ভব নয় বলে, ব্যাক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করেন বেশ কয়েকজন নির্বাচন কমিশনার। আর একটি সুষ্ঠ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের একার ওপর নির্ভর করে না বলেও মনে করেন তারা।

কিন্তু এখন আমরা তাকিয়ে আছি সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন কেমন হয়, বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে হন তা দেখার জন্য। ইংরেজিতে ১৩ সংখ্যাটিকে অপয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এজন্যই UNLUCKY 13 বলে একটি প্রবাদ চালু আছে। ১৩ তম নির্বাচন গঠনের আগেই রাজপথের প্রধানবিরোধীদল বিএনপি সেই নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের অনাগ্রহের কথা জানিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন পাশের প্রক্রিয়ায় সংসদে বিএনপির হাতে গোনা কয়েকজন সদস্য অংশ নিলেও দলগতভাবে বিএনপির অবস্থান ছিল ভিন্ন। তারা নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপে যোগ দেয়নি। একইভাবে সার্চকমিটির আহবানে সাড়া দিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের সম্ভাব্য নামও প্রস্তাব করেনি। ফলে এই সপ্তাহে যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, তা যে বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না , তা বলাই বাহুল্য। তাহলে কি আমরা পাচ্ছি ‘আনলাকি থারটিন ইলেকশন কমিশন’?

দেশ স্বাধীনের পর এ পর্যন্ত যে ১২টি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে ,সেগুলোকে তিনপর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্ব ৭৫ এর আগে, দ্বিতীয় পর্ব ১৯৯০ পর্যন্ত। তারপর সংসদীয় গনতন্ত্রের আমল যা শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের পর।

১৯৭২ সালের ৭ জুলাই দায়িত্ব নেন দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি এম ইদ্রিস। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তার অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়। পচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পরও তিনি বহাল ছিলেন ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তার পূর্ণ মেয়াদে।

এরপর ১৯৯০ সার পর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসনের সময়ে আরো তিনজন বিচারপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যেসব নির্বাচন হয়েছে তার কোনোটাই সার্বিকভাবে দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল এমনটা দাবি করা যায় না।

১৯৭৭ সালের ৮ জুলাই থেকে ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম। তার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের অধীনে ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন এবং হ্যা না ভোটসহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও হয়েছে।

১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিইসির দায়িত্ব নেন বিচারপতি চৌধুরী এ টি এম মসউদ। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছেন তিনি। এরমধ্যে ১৯৮৬ সালের ভোটে অংশ নেয়নি বিএনপি। আর ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ছাড়াও অংশ নেয়নি আওয়ামী লীগও। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবার আগে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সিইসি হেসেবে নিয়োগ দেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে। ঐ বছর ৬ ডিসেম্বর গনঅভূত্থানে এইচ এম এরশাদের পতন হওয়ার পর ২৪ ডিসেম্বর সিইসি সুলতান হোসেন খানও বিদায় নেন।

সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃ:প্রবর্তনের আগেই বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের অস্থায়ী সরকার সিইসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন বিচারপতি আব্দুর রউফকে। নির্বাচনের পর সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে ফিরে গিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতির আসনে। কিন্তু আব্দুর রউফ ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিলেও, ঐ নির্বাচনে পরাজিত আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সুক্ষ কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। এমনকি ১৯৯৪ সালে চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আয়োজনে সফল হলেও তার ভরাডুবি হয় মাগুড়া উপনির্বাচনে। বিতর্কিত সেই নির্বাচন থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠেছিল।

সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দেশ উত্তাল করে সফল হয়েছিল আওয়ামী লীগ। নিজের মেয়াদ পূরণ করার আট মাস আগে বিদায় নেন তিনি। আর তার উত্তরসূরী বিচারপতি এ কে এম সাদেক ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল দায়িত্ব নিয়ে বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন (যে নির্বাচনের ফলাফল খুজে পাওয়া যায় না নির্বাচন কমিশনেও ?) করে বিদায় হয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল।

বিচারপতি সাদেকের পর বিচারপতি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচারপতির বদলে একজন সাবেক আমলাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেন। দেশের সপ্তম সিইসি আবু হেনা ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচন করেন। দেশ-বিদেশে তা গ্রহণযোগ্য হলেও বিএনপ স্থুল কারচুপির অভিযোগ করতে ভোলেনি। সেই নির্বাচনে ২১ বছর সরকার গঠনের সুযোগ পেলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় মেযাদ পূরণের আগেই তিনি বিদায় নেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০০০ সালের ২৩ মে সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান এম এ সাইদ। কিন্তু ২০০১ সালে নির্বাচনে হেরে গেলে তার সমালোচনায় মুখর হয় আওয়ামী লীগ। এরপর বিএনপি আমলে আবারো একজন বিচারপতি আসিন হন সিইসির আসনে। কিন্তু শুধু বিতর্কিতই নন, হাস্যরসের জন্ম দিয়ে বিদায় হন সাংবিধানিক পদে আসীন নবম সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ । ‘সুগারকোটেড’ মার্শাল ল সরকার আবার একজন সাবেক সচিব ড. এটিএম শামসুল হুদাকে সিইসি হিসেবে নিয়োগ দেন ২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ।

২০০৮ সালের নির্বাচন সবাই মেনে নিলেও পরাজিত বিএনপি এখনো তার সমালোচনা করেন। অবশ্য বিএনপিকে দুটুকরো করার প্রয়াস সম্পর্কে নিজের অনুতপ্ততার স্বীকারোক্তি করেছেন ড. শামসুল হুদা।

এরপরের নির্বাচন কমিশনার আরেকজন সাবেক সচিব কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ। তার ‘কলংক ’২০১৪ সালের নির্বাচন। ১৯৮৬ সালের পর বিএনপি আবারো নির্বাচন বর্জন করায় ১৪০টিরও বেশি আসনে ভোট ছাড়াই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেশের প্রায় সব দলই নির্বাচনে অংশ নিলেও ‘রাতের ভোটের’অপবাদ জুটেছিল সর্বশেষ বিদায়ী সিইসি এ কে এম নুরুল হুদার কপালে।

চলতি সপ্তাহেই যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে এবং যিনি হবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বিএনপি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমনটা মনে হচ্ছে না। তবে দেশে প্রথমবারের মত দ্বিতীয় মেয়াদের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নিয়োগ করা সিইসি কতটা ভাগ্যবান বা গ্রহণযোগ্য হন, তা দেখা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। নাকি সত্যিই একজন আনলাকি থারটিনের সিইসি পেতে যাচ্ছি আমরা ,সেটাই এখন রাজনীতির মাঠের বড় প্রশ্ন।

সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএম

  • সর্বশেষ
  • পঠিত