ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

নারী ও পল্লী উন্নয়নে

  মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন

প্রকাশ : ১১ মে ২০২২, ১৬:৪৩

নারী ও পল্লী উন্নয়নে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে তার পল্লী উন্নয়নের দর্শন ছিলো। এ সাথে নারীদের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে, বৈষম্য অবস্থান হতে উত্তরণে এবং নারীর অগ্রযাত্রাকে স্থায়ী রূপ দিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি।

একই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করার সাথে সাথে পল্লী উন্নয়নে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একটি সমাজ গড়তে চান, যে সমাজে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না; ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিতে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না; মানুষের জীবনের নূন্যতম চাহিদা পূরণ হবে, যেখানে গ্রামকেই করতে হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। তাইতো তিনি ঘোষনা দিয়েছেন ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ পল্লী উন্নয়নের মেগা প্রকল্প। শহরের সব ধরনের সুবিধা ও উন্নয়নের প্রবাহমান ধারা গ্রামে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত হচ্ছে নানা প্রকল্প ও কার্যক্রম।

রূপকল্প-২০২১ এর ধারাবাহিকতায়, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠ অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে চলেছে। পল্লীর আর্থসামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব, জাতীয় অর্থনীতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার দৃঢ়ভাবে তা বিশ্বাস করে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার মধ্যেই রয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথ। টেকসই পল্লী উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিলোপ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জেন্ডার সমতা অর্জন, খাদ্য নিরাপত্তা, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশের সাফল্য আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত ।

বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের কাজটি মূলত শুরু করেছেন তৃণমূলের নারীরাই। নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের কারণেই নারীরা আজ অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হতে পেরেছেন। পল্লী নারীরাই বেশি উৎপাদনশীল, এ জনসম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে তৃণমূলের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। সরকার প্রত্যন্ত পল্লী এলাকায় নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বচ্ছলতা পৌঁছে দিতে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ এর ধারণা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও কার্যকর। দেশের সামগ্রিক ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে পল্লীউন্নয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। পল্লীতে বাসবাসকারীরা দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ। এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। একটি জনগোষ্ঠীর জীবিকার উন্নয়ন হতে হবে সমতা ও সাম্যের ভিক্তিতে তাহলে উন্নয়ন হবে টেকসই।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার অনেকগুলো নারীবান্ধব আইন প্রণয়ন করেছে এতে করে নারীর ক্ষমতায়ন আরো তরান্বিত হয়েছে, নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু আইন নারীকে সম্মান এনে দিয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১ তে নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতায়নের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। জেন্ডার বৈষম্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে সকল উন্নয়নের বাধা। মানব প্রজাতির উন্নয়ন শুধুমাত্র পুরুষের উন্নয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নারী পুরুষের মিলিত অবস্থান ও উন্নয়নই প্রগতির পথকে সচল রাখতে পারে।

নারীরা আজ স্বাবলম্বী হয়েছে, পরিবারের আয়ও বেড়েছে আগের তুলনায়, যা পল্লী এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সরকারি সেবা বিভাগের পাশাপাশি অনেক এনজিও তাদের কর্মসূচির মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পল্লী এলাকা উন্নত ও সমৃদ্ধ হলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নেয়া সম্ভব হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুব নারীরা যাতে চোখের আড়ালে থেকে না যান, সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। এসডিজির গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। কারণ প্রযুক্তি স্বচ্ছতার ক্ষেত্রকেও প্রসারিত করে। নেতৃত্ব বিকাশের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন আর্থিক সহায়তা। একটি উন্নয়ন তখনই টেকসই হবে যখন সেবাগ্রহণকারীরা উন্নয়নকে দরদ দিয়ে নিজেদের আর্থসামাজিক অস্তিত্বের একটি বৃহৎ অংশ বলে মনে করবে।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অগ্রাধিকার ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ প্রকল্পের ৬০ শতাংশই নারী। ৬১ শতাংশ নারী নানা কারণে ঋণ নিয়ে থাকেন, যা জাতীয় পর্যায়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ । একজন নারী যে শুধু আর্থিক জোগানই দিচ্ছেন, শুধু তাই নয়, ঘর-সংসারও সমানভাবে সামাল দিচ্ছেন। এই প্রকল্প সফল করতে গ্রামীণ নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। দেশের গ্রামীণ নারীরা প্রায় প্রত্যেক বাড়ির উঠানে হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এগুলোর জন্য খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ এবং সেবাযত্ন নারীরাই করে থাকে। গবাদিপশু পালন এবং দুধ ও ডিম উৎপাদনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রোটিনের অভাব দূরীকরণে গ্রামীণ নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সরকার গ্রামীণ নারীদের খামার স্থাপনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছে। নারী উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে স্বল্পসুদে ঋণ দিচ্ছে। নারী তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রতিবছর অর্জন করছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুরুষের চেয়ে নারীর অবদান বেশি। নারীর অবদান ৫৩ শতাংশ এবং পুরুষের অবদান ৪৭ শতাংশ। নারীরা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত কাজের ২১টি ধাপের মধ্যে মোট ১৭টি ধাপেই কাজ করে থাকেন। ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের সঙ্গে ৬৮ শতাংশ নারী কাজ করেন। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির মধ্যে ৫০ লাখই নারী শ্রমিক। দেশের অর্থনীতিতে ২৫ শতাংশ অবদান তাদের । ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারী কৃষি, শিল্প ও সেবাসহ নানা খাতে কাজ করছে(BBS)৷ গার্মেন্টসকর্মীর প্রায় ৫৪ শতাংশই নারী৷

বর্তমানে অনেক চ্যালেঞ্জিং পেশা নারীরা গ্রহণ করছেন। লিঙ্গ সমতার ক্ষেত্রে আমরা অনেক পথ এগিয়েছি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে তাদের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে লিঙ্গ সমতা না আসার পেছনে আমাদের আর্থসামাজিক কারণ যেমন আছে, তেমনি আছে মনস্তাত্বিক বাধা, যা সমাজের সার্বিক কাঠামোতে প্রভাব ফেলে। এখনও অনেকে মনে করেন, পরিবারের আর্থিক সংগতি থাকলে নারীরা ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি করার প্রয়োজন নেই।

এখন নারীদের হাতে অর্থ এসেছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে নারীরা, সমাজে নারীদের ক্ষমতায়ন ঘটেছে, অবদান বেড়েছে। জনসংখ্যার অর্ধেক অংশকে উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন হবেনা। শ্রমশক্তি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার অন্যতম সম্পদ যা দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণে অবদান রাখছে । ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে স্থান করে নেবে।

বর্তমানে প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখের বেশি। এরমধ্যে প্রায় ১০ লাখ নারী, এরা প্রায় সবাই গ্রামাঞ্চলের। এ হিসাবে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ১২ শতাংশ নারী। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে নারী শ্রমিকরা বেশি হারে টাকা পাঠিয়েছেন। রামবুর সূত্র মতে তাঁরা পাঠিয়েছেন ৬৯ শতাংশ, পুরুষ ৩০ শতাংশ। বিদেশ যেতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা গড়ে পাঁচ মাসের মধ্যে নারী কর্মীরা তুলে আনতে পারেন।

বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, লাটভিয়া, লুক্সেমবার্গ ও সুইডেনে নারী পুরুষের সমান অর্থনৈতিক অধিকার শতভাগ। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতে রয়েছে ৭১ শতাংশ আর বাংলাদেশে ৪৯.৩ শতাংশ। যুক্তরাজ্য ৯৭.৫, যুক্তরাষ্ট্র ৮৩.৭, পাকিস্তানে ৪৬.২ এবং সৌদি আরবে ২৫.৬ শতাংশ। আমাদের সচেতনতা এবং উন্নত মানসিকতাই বাংলাদেশের রেমিটেন্সের হার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। আমাদের অর্থনীতি এবং ২০৪১ সালের সমৃদ্ধশালী দেশের মর্যাদা আমাদের হাতেই। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই আমাদের সমৃদ্ধির সোপান। আর সে অঙ্গীকারেই আমাদের এগিয়ে চলা দৃপ্ত পায়ে। পিআইডি ফিচার

লেখক: পিআরও, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) প্রকল্প কার্যক্রম।

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত