ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

পরিচিত হয়েও অপরিচিত জনগোষ্ঠী ‘বেদে সমাজ’

  সাভার প্রতিনিধি

প্রকাশ : ৩১ মে ২০২২, ১৫:২০  
আপডেট :
 ৩১ মে ২০২২, ১৫:৩৫

পরিচিত হয়েও অপরিচিত জনগোষ্ঠী ‘বেদে সমাজ’
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের দেশের অতি পরিচিত এক জনগোষ্ঠী ‘বেদে সমাজ’। এই জনগোষ্ঠীর রয়েছে ভিন্ন এক ইতিহাস, ভিন্ন এক ঐতিহ্য। যদিও তাদের সমাজ ব্যবস্থা, জীবনচিত্র বা জীবন যাপন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানিনা আমরা।

বেদে সমাজ মূলত নারী শাসিত। অর্থাৎ এ সমাজে সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় পরিবারের নারী সদস্যদের মাধ্যমে। বসবাসের জন্য এদের নির্দ্দিষ্ট কোনো এলাকা নেই। সময় সুযোগ বুঝে এরা বিভিন্ন এলাকায় বসতি গড়ে তোলে। বেদে নারীদের জীবন সংগ্রামের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায় তাদের সংগ্রামী জীবনের না বলা ইতিহাস।

নেত্রকোনার কাঞ্চনপুর থেকে শিশু মহুয়াকে চুরি করেছিলো হুমরা বাইদ্যা। প্রেমিক নদের চাঁদকে বাঁচাতে শেষ মুহুর্তে বিষলক্ষা ছুড়ি দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলো যুবতী মহুয়া। প্রায় পৌনে চারশ বছর আগে কানাইয়ের ‘মহুয়া পালার’ মূল গল্পের এই নারীকে কেন্দ্র করে বেদে জনগোষ্ঠীর জীবন। জন্মগতভাবে না হলেও মহুয়া ছিলো বেদে কন্যা।

বিপুল আয়োজনে এ প্রজন্মের মানুষের কাছে বেদে কন্যা হয়ে উঠে এসেছিলো বেদের মেয়ে জোছনা। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের নাগিন কন্যার কাহিনীতে হিজল বিলের ‘বিষ বেদে’ সম্প্রদায়ের নারী অথবা আল মাহমুদের জলবেশ্যায় উঠে আসা এই চরিত্ররাই প্রান্তিক এক জনগোষ্ঠিীর নারী চরিত্রের প্রতীক।

সাহিত্যের সাথে যে বাস্তবের বিস্তর ব্যবধান, তার প্রমান মেলে রাজধানীর পান্থপথ মোড়ের সিগনাল, বেইলি রোড বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হঠাৎ দেখা বেদে নারীদের বাস্তব জীবন দেখে।

১০ হাত শাড়ির আড়াই প্যাঁচের ঢঙ্গে জড়ানো শরীরে থাকে অসংখ্য পুঁতির মালা। পায়ে মল বা নুপুর। দুই হাত ভর্তি চুড়ির সঙ্গে থাকে নাকে-কানে দৃশ্যমান গয়না। এসব আমাদের চোখ টেনে রাখে। কিন্তু তাদের হাতে থাকা ছোট কাঠের বাক্সটি দেখা মাত্রই চোখ বন্ধ করে রাখতে ইচ্ছে করে। ওর মধ্যে সাপ না থাকলেও আমাদের জন্য থাকে ভয়। অদেখা যেকোনো কিছুতেই এ ভয় মানুষের মজ্জাগত। সেটিই কাজে লাগিয়ে উপার্জন করে তারা।

সত্যি বলতে কি, এ দিকে তাদের ঠেলে দিয়েছি আমরাই। বেদে সমাজের আয়ের পথ হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বেদে জনগোষ্ঠীতে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি কর্মঠ। সেই ভোরবেলা গাওয়াল করতে বের হয়। ফেরে বিকেলে। পায়ে-পায়ে বাড়ি খায় পেটিকোটের ফুল দেয়া কুঁচি। কিন্তু এই নারীদের স্বাস্থ্য ও সচেতনতা বেদনাহত হওয়ার মতো উপেক্ষিত। অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৪-১৫ বছরের মধ্যে।

ফরিদপুরের মুন্সিবাজারে পথের পাশে একজনের ফেলে রাখা জমিতে আছে ১৮ ঘরের বেদেপল্লী। হলুদ শাড়ি পড়ে মাঠের মধ্যে বসেছিলেন সন্তানসম্ভবা কোহিনুর। জানতে চেয়েছিলাম ঝড় এলে কোথায় থাকবেন। হাতে থাকা গাছের এক শুকনা ডাল উঁচু করে এমন ভঙ্গিমায় দেখালেন , যেনো প্রাসাদের সুরক্ষিত নিরাপত্তা। অথচ ওটা বাঁশের দুটি টানা দিয়ে টাঙ্গানো একটা কালো প্লাস্টিকের ছাউনি। মাটির ওপর একটা ছেঁড়া পাটি পেতে ঘুমানোর ব্যবস্থা। মাত্র ২১ বছর বয়সী শাবনুরের তিনটি সন্তান আছে এরই মধ্যে। চতুর্থ সন্তান জন্মের সময় এমন অপুষ্টিতে ভুগছেন যে নিজেরই টিকে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে এখন।

বেদে সম্প্রদায়ের নারীরা সন্তান জন্মের জন্য সাধারণত সদর হাসপাতালেও যায়না। তাদের অভিযোগ নার্স বা চিকিৎসকদের অবহেলা নিয়ে। নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই আছেন কয়েকজন দাইমা। তাদের একজন সদরপুরের তসলিমা বেগম। তিনি বলছিলেন, ওপরে আল্লাহ আর নিচে আমি। আমার হাতে যতক্ষণ রোগী আছে, জান থাকা পর্যন্ত আমি ছাড়বোনা। তসলিমা খাতুনের হাতে জন্ম নিয়েছে কয়েক’শ শিশু। তিনি এ বিদ্যা শিখেছেন তার শাশুড়ি আর দাদি শাশুড়ির কাজ দেখে-দেখে। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্টার ডা. শরিফুন্নেছা বলেছিলেন, নরমাল ডেলিভারির সময় যে নিয়মকানুনগুলো মানতে হয়, বেদে জনগোষ্ঠীর নারীদের সেটুকু প্রশিক্ষণও নেই। এ মানুষদেরকে মেডিকেল ক্যাম্পের মাধ্যমে মৌলিক কিছু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া দরকার। কিশোরীদের মাসিকের সময়ের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও কোনো সাধারণ ধারণা নেই। এই অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা শুধু নারীর নিজের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তা-ই নয়। একই সঙ্গে তার সন্তানের জন্যেও ঝুঁকিপূর্ণ।

এ দিকে মুন্সিগঞ্জের গোয়ালীমান্দা হচ্ছে এ অঞ্চলের বেদে সম্প্রদায়ের আদি নিবাস। এখানে এখন বসবাস করেন কয়েক হাজার মানুষ। যারা নৌকা ছেড়ে স্থলভাগে বাস করছেন বহুদিন হলো। অনেকের জীবিকায় এসেছে পরিবর্তন। নারীরা শিঙ্গা ফুকা বা ব্যথা নামানোর পেশা বাদ দিয়েছেন। মেয়ে শিশুরা যাচ্ছে স্কুল-মাদ্রাসায়। তবে স্বাস্থ্য বিষয়ে অসচেতনতা একই রকম।

পোশাকে ও সাজে তারা অনিন্দ্য অথচ সেদিন দুপুরে হঠাৎ উপস্থিত হয়ে দেখা গেলো সতর্কতার কোনো বালাই নেই। করোনা নামের অতিমারিও তাদের বিচলিত করেনি এতটুকুও।

চার নারী সেখানে বসে গল্প করছেন। সেখানে কিছুক্ষণ আগেই মারা হয়েছে কোনো প্রাণী। উঠানের এখানে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধা। মাছি ঘুরছে ভন ভন করে। সেই পরিবেশে বসে শিশুদের থালায় ভাত মেখে দিচ্ছেন দু’জন। করোনার কথা বলতেই হেসে উড়িয়ে দিলেন। তাদের কোমরে রুপার বিছা আর হাতের বাজু বন্ধনী চমকাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সুন্দর মুখে, শরীরের ত্বকে নানা রকম ছত্রাকের বাসা।

বাংলাদেশ জার্নাল/রাজু

  • সর্বশেষ
  • পঠিত