ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

কন্যা কথা

  ফারজানা ইয়াসমিন

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২২, ১৬:৩৭

কন্যা কথা

মফস্বল শহরের ডাক্তার বাবা আর কলেজ শিক্ষক মায়ের একমাত্র সন্তান রূপা সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে মেডিক্যালে ভর্তির জন্য কোচিং শুরুর পরিকল্পনা করছে। এক রাতে ল্যাপটপ অন করতেই রূপা দেখল তার ফেসবুকে কে যেন একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে।

ভিডিও ক্লিপে ক্লিক করতেই চমৎকার একটি গান স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ‘প্রেমে পড়া বারন, কারণে অকারণ...।’ গানটি তার প্রিয়। দুই, তিন, চার... এভাবে কয়েকবার শোনার পর কে পাঠালো ভিডিওটি সেটি খুঁজে বের কারার চেষ্টা করল। সেন্ডার অপরিচিত। কাজেই এ ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে সে তার নিজের কাজে মন দিল। এভাবে কয়েক দিন চলল। তবে ফেসবুকে প্রতিদিনই সে কয়েকবার গানটি শোনে। গানটির প্রতি তার এক ধরনের মোহ জন্মে যায়।

দিন পাঁচেক পর এক রাতে হঠাৎ রূপা অসুস্থ হয়ে পড়ে। দ্রুত তাকে তার বাবার ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তেমন কোনো সমস্যা না পাওয়ায় পরদিনই বাসায় নিয়ে আসা হয়। রূপা খুব ক্লান্ত, তার চারপাশের সবকিছু ঘুরছে, বমিবমি ভাব, কিছুই খেতে মন চায় না। সারাক্ষণ এক আতঙ্কের মধ্যে থাকে রূপা। মা-বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। মেয়েকে সময় না দেওয়া, খোঁজ খবর না রাখা ইত্যাদি অভিযোগ রূপার বাবার। স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রূপার মায়েরও। নিজেদের মধ্যে ছোট্ট একটা ঝগড়াও হলো রূপাকে নিয়ে। চিকিৎসা চলছে, কিন্তু কোনো উন্নতি নেই, বরং রূপার অসুস্থতা বেড়েই চলছে। রূপার মায়ের অভিযোগ মেয়ের কোনো চিকিৎসাই হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত হলো মেয়েকে ঢাকায় বড়ো হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর।

দ্রুতই মা বাবাসহ ঢাকায় এলো রূপা। নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তাকে। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সিদ্ধান্ত দিলেন রূপা সম্ভবত ভার্টিগো রোগে আক্রান্ত। ভার্টিগো হচ্ছে এক ধরনের শারীরিক অনুভূতি যেখানে রোগীর মনে হয় তার চারপাশে পৃথিবী ঘুরছে অথবা স্হির পৃথিবীর চারপাশে রোগী ঘুরছে। এছাড়াও এ রোগের লক্ষণ হলো বমিবমিভাব, শ্রবণশক্তি হ্রাস, কানে অস্বাভাবিক শো শো শব্দ শুনা ইত্যাদি। এ রোগটি পুরুষের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এ রোগটি সম্পর্কে মানুষের ধারণাও কম। তবে এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার আছে। ডাক্তার কথা শেষ করার আগে রূপাকে একজন মনোবিজ্ঞানীর নিকট রেফার করে তার মতামত নেওয়ার জন্য লিখে দিলেন। রূপার বাবা ভুলেই গেলেন তিনি একজন ডাক্তার। নানারকম দুঃচিন্তা পেয়ে বসেছে রূপার মা-বাবা কে।

পরদিন সকালেই রূপাকে দেখতে আসেন ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী একজন নারী মনোবিজ্ঞানী। রূপাকে নিয়ে যান তার চেম্বারে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর চোখ মুছতে মুছতে বের হলো রূপা। দেখেই অজানা এক আতঙ্কে কেঁপে উঠলো রূপার মা-বাবা। দিশেহারা বোধ করছেন তারা। কেবিনে গিয়েই শুয়ে পড়লো রূপা, কারো সাথে কোনো কথা বললো না। রূপার বাবা ছুটে গেলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার অভয় দিয়ে বললেন সমস্যা নেই, অপেক্ষা করুন সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। এদিকে বাসা থেকে খবর আসে যে, রূপাদের বাসায় সাদা পোশাকের পুলিশ এসেছিল। বাসা থেকে রূপার ল্যাপটপ নিয়ে গেছে।

রূপার মামা পুলিশের দেওয়া নম্বরে কথা বললেন। প্রায় পনের মিনিট কথা হলো। ডিবি পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাকে জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর রূপার ল্যাপটপটি তারা পরীক্ষা করে সাইবার ক্রাইমের অভিযোগ পেয়েছেন। ল্যাপটপটির ফরসেনিক পরীক্ষার জন্য আদালতের মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে এবং অভিযুক্তকে শনাক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে পাশের জেলা থেকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি রূপাকে কখনো দেখেনি, তবে সে আইটি এক্সপার্ট। যদিও এ বিষয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢু মারতে গিয়ে কৌতূহলবশত রূপার প্রোফাইলে ঢুকে তার সম্পর্কে ধারণা নেয় এবং দুটি বিশেষ সফটওয়্যার রূপার একটি প্রিয় গানের সাথে ট্যাগ করে ওর ল্যাপটপে পাঠিয়ে দেয়। রূপা কৌতূহলবশত গানটি শুনতে ক্লিক করতেই গোপন সফটওয়্যারগুলো সচল হয়ে যায়। এ সফটওয়্যারগুলো ল্যাপটপ বন্ধ থাকা অবস্থায়ও ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম। এভাবেই রূপার কিছু অসচেতন মূহুর্তের ব্যক্তিগত ছবি অভিযুক্তের কাছে চলে যায়। আর এটা নিয়ে রূপাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে সে। রূপা ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখন আর ভয়ের কারণ নেই, সবকিছু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখছে।

এক মাস পর, জেলা পুলিশের আয়োজনে শতাধিক স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক ও সুধীজনের উপস্থিতিতে এক অবহিতকরণ সভায় বক্তব্য রাখছেন জেলা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি প্রথমেই রূপার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিলেন। রূপার মা-বাবা এসময়ে কী কী ভুল করেছেন তারও বর্ণনা দিলেন। তারা সমাজের সচেতন ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মানুষ। অথচ বিপদের সময় তারাও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এর কারণ হলো তারা ঠাণ্ডা মাথায় সমস্যাটি বিশ্লেষণ করতে পারেননি, ঘটনার আকস্মিকতায় তারা হতবিহবল হয়ে পড়েছিলেন।

ডিজিটাল অপরাধ সংগঠিত হওয়ার কারণ হিসেবে সম্ভাব্য ঝুঁকিহীনতা ও অপরাধীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম এবং লাভ বেশি। এ ধরনের অপরাধীদের থেকে সর্তক থাকতে হবে অর্থাৎ ডিজিটাল ডিভাইসগুলোতে এরা নানারকম লোভনীয় বা আর্কষণীয় কন্টেন্ট পাঠায় এগুলোতে ক্লিক করা, লাইক দেওয়া বা কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারো পোস্টে লাইক, কমেন্ট করার আগে একাধিকবার ভাবতে হবে, বন্ধু নির্বাচনে সর্তক থাকতে হবে।

এরপর সেই কর্মকর্তা ডিজিটাল অপরাধের শিকার হলে ভুক্তভোগী, মা-বাবা অভিভাবক, সহপাঠী বন্ধুবান্ধব এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করলেন। এর মূলকথা হলো ভয় পাওয়া এবং একে অপরকে মিথ্যা দোষারোপ না করে ঠাণ্ডা মাথায় সমস্যাটি মোকাবিলা করতে হবে। বিষয়টি কালবিলম্ব না করে মা-বাবা অবিভাবক বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে শেয়ার করে দ্রুত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে। কোনোভাবেই অপরাধীর ফাঁদে পড়া যাবে না। মনে রাখতে হবে এটাই নিজেকে রক্ষার প্রথম পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। কোথায় কিভাবে জানাতে হবে সেটা তিনি উল্লেখ করেন। সবচেয়ে সহজ হলো ৯৯৯ এ জানানো, পুলিশকে ৯৩৪২৯৮৯, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে ০১৭১৩৩৯৮৩১১, র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)কে ০১৭৭৭৭২০০২৯, বিটিআরসিকে ০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮ এ ফোন করে অভিযোগ দেওয়া যাবে। এ সব ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্বের সাথে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।

সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সবার আগে প্রয়োজন ইন্টারনেট ব্যবহারে সচেতনতা ও সতর্কতা। দিনে দিনে পাল্লা দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও আমাদের সচেতনতা বাড়েনি। আমরা যদি সচেতন হই, তাহলে এ জগত সবার জন্য নিরাপদ হবে এবং তথ্য সুরক্ষিত থাকবে। সাইবার জগতকে নিরাপদ করতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং সাইবার স্মার্ট হতে হবে। (পিআইডি ফিচার)

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত