ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি: ‘অদম্য’ সুফিয়া কামাল

  অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন

প্রকাশ : ২০ জুন ২০২২, ০২:৪৪  
আপডেট :
 ২০ জুন ২০২২, ১৬:৪১

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি: ‘অদম্য’ সুফিয়া কামাল
ফাইল ছবি

১.

‘গোল করো না গোল করোনা খোকন ঘুমায় খাটে,' আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা', 'বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল'- এইসব ছড়া আর কবিতার মধ্য দিয়ে কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে পরিচয় সেই সুদূর শৈশব-কৈশোর কাল থেকেই।সহজ,সরল, আবেগময়,স্মৃতিকাতর আর মননশীল শব্দচয়নসমৃদ্ধ ছড়া বা কবিতায় নিজের প্রতিচ্ছবিটিই আবিষ্কার করেছি বারবার। বিশেষ ভাবে বলতে হয়‘পল্লীস্মৃতি’কবিতাটির কথা।এই কবিতার পল্লীবালা হিসেবে নিজেকে কল্পনা করে নিয়েছিলাম সেই বয়সেই।প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও এই কবিতার প্রতিটি শব্দ আর পঙক্তিতে খুঁজে ফিরি হারিয়ে যাওয়া শৈশব আর কৈশোরের দিনগুলোকে।আরো একটু বড়বেলায় পৌঁছে পড়লাম ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটা,যে কবিতার চরণে চরণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রিক্ততা আর বিষণ্ণতার সুর কবির প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছিল।সেইসাথে পরবর্তীকালে ‘নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক, পুষ্প বিকাশের প্রয়োজনে’, কবি সুফিয়া কামাল রচিত চরণটি বারবার স্মরণ না করে পারিনি। প্রকৃত অর্থে সুফিয়া কামাল জীবনব্যাপী এই ফুল ফোটানোর কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন।

২. আশির দশকের গোড়ার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর কবিকে চেনা-জানার সুযোগ হলো বই-পত্রিকা আর টেলিভিশনের মাধ্যমে।মনে আছে সেই সময় এমন দিন খুব কমই ছিল যেদিন সুফিয়া কামাল সংক্রান্ত কোন খবর পত্রিকা বা টেলিভিশনের থাকতো না।সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি,ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-কোথায় ছিলেন না তিনি!নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়াকে জেনেছি বই পড়ে আর সুফিয়া কামালকে চিনেছি,জেনেছি তাঁর প্রতিদিনের কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। এ পর্যায়ে এসেই জানলাম,শুধু সাহিত্যচর্চার মধ্যেই তাঁর কর্ম পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল না,দেশ ও জাতির যে কোন দুর্যোগে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন অতন্দ্র প্রহরীর মত।কবি বা নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবেও তাঁর পরিচয়কে সংকুচিত করে দেখারও কোন সুযোগ নেই। কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষক, দার্শনিক, সমাজসেবক, রাজনীতি সচেতন, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী,সর্বোপরি আজীবন সংগ্রামী এই নারী হয়ে উঠেছিলেন অন্যতম প্রেরণার উৎস।

৩. তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্ব আর মহান কর্মযজ্ঞের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জ্ঞাপনের সামান্যতম সুযোগ আমার হয়েছিল ঢাকার একটি বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি তিতুমীর কলেজে মেয়েদের হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালনকালে।ছাত্রী হোস্টেলটির কোন নামকরণ করা হয়নি তখনো।একাডেমিক কাউন্সিলের এক সভায় প্রস্তাব করা হলো কবি বেগম সুফিয়া কামালের নামে হোস্টেলটির নামকরণের।সবার সম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহিত হলো এবং কলেজের তৎকালীন তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. দিলারা হাফিজ সানন্দে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে হোস্টেলটির নামকরণ করলেন-সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাস। কবি সুফিয়া কামালের সুযোগ্য কন্যা স্বনামধন্য মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল স্বামী সুপ্রিয় চক্রবর্তীসহ উপস্থিত হয়ে ২০১৩ সালে সুফিয়া কামালের ১০২তম জন্মবার্ষিকীতে ছাত্রীনিবাসের নামফলক উন্মোচন করেছিলেন।আজ এই মহীয়সী নারীর স্মতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কিছু বলার প্রাক্কালে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটুকু ব্যক্ত না করে পারলাম না। সুফিয়া কামালের সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করা আমার লক্ষ্য নয়। তাঁর সুবিশাল বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের সংগ্রামী আলেখ্য থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

৪. বাংলায় নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সুফিয়া কামাল এক অনবদ্য নাম। কিন্তু আমাদের সমাজে বিরাজমান পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের কারণে এ রাষ্ট্র গঠনে সুফিয়া কামালের যে ত্যাগ, তিতিক্ষা ও অবদান তা সম্পর্কে আমরা বর্ণাঢ্য আলোচনা দেখতে পাই না। বাংলায় গণমানুষের সামাজিক বঞ্চনা, সামাজিক অসাম্য বিশেষ করে নারী শিক্ষার অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, এমনকি আইনগত অধিকার নিয়ে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন তিনি। একজন আটপৌরে সরল জীবনযাত্রার স্বকীয় সৌন্দর্যের নারীর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে যে মাতৃমুখের অবয়ব অন্তরের মাধুর্য ও চরিত্রশক্তির দৃঢ়তা নিয়ে পরম মমতায় পাশে দাঁড়ান তিনিই সুফিয়া কামাল। তিনি নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও আজীবন নারী শিক্ষার অধিকারসহ নানাবিধ অধিকারের প্রশ্নে সংগ্রাম করে গেছেন। তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে বাস করেও তিনি নিজ প্রচেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত। পরিবারে উর্দু ভাষার চর্চা থাকলেও নিজের সাধনায় বাংলা ভাষা রপ্ত করে আজীবন বাংলায় সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গেছেন এই মহীয়সী নারী।

৫. সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। সুফিয়া কামালের বয়স যখন সাত তখন থেকেই শুরু হয়েছিল জীবন সংগ্রাম।এই সময় তাঁর বাবা সুফিসাধক হওয়ার উদ্দেশে বাড়ি ছেড়ে চলে যান।মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন ছিলেন বরিশালের শায়েস্তাগঞ্জের নবাব পরিবারের মেয়ে। স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি শায়েস্তাগঞ্জে চলে আসেন।সুফিয়া কামাল মায়ের তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীল এবং অভিজাত পরিবেশে লালিত-পালিত হতে থাকেন। নবাব পরিবারে মুখের ভাষা ছিল উর্দু।বাড়ির অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি-ফারসি শেখার সুযোগ থাকলেও বাংলা ছিল নিষিদ্ধ।মায়ের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণায় সুফিয়া কামাল মামাদের বিশাল পাঠাগারে গোপনে বাংলা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তিনি পাননি। শৈশবে স্কুলে যাওয়ার জন্য জেদ করলে টুপি-পাঞ্জাবি পরিয়ে তাকে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল কয়েক দিন।কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।তারপরেও বৈরী এবং রক্ষণশীল পারিবারিক - সামাজিক পরিবেশে নিজ প্রচেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। অবরোধের ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে একজন পরিপূর্ণ আধুনিক মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন।আমরা জেনেছি শৈশব থেকেই তাঁর মনোজগতে দেশ,দেশের মানুষ,সমাজ-ভাষা-সংস্কৃতি মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর কন্যা সুলতানা কামালের লেখা ‘ছিলাম কোথায় যেন নীলিমার নীচে' বইটি থেকে এ প্রসঙ্গে একটি উদ্ধতি তুলে ধরছি,‘‘তিনি জন্মেছিলেন নবাব পরিবারে।খুব দু:খ করে বলতেন,আমার যে পা ধুয়ে দিয়েছে,তাকে আমাদের মুখের দিকে তাকাতে দেয়া হয়নি। ওদেরকে বাঁদিই বলত।নবাব পরিবারের ভাষায় বাঁদি এসে পানি দিয়ে পা ধুইয়ে,মুছে ওভাবেই বেরিয়ে চলে যেত।মুখের দিকে তাকাতে পারবে না। এই যে মানুষের সঙ্গে অমার্যাদা,ছোটবেলা থেকে সেটা তাঁকে খুব স্পর্শ করেছিল।”এভাবেই ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে মানবিকতাবোধেরও উন্মেষ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে আমরা দেখি মানুষ,প্রকৃতি, সৌন্দর্য, সততা, শুদ্ধতা,ন্যায়বোধ ছিল তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং সামগ্রিক জীবনাচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

৬. মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাই নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়া কামাল পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। উদার,আধুনিক, প্রগতিশীল স্বামীর অনুপ্রেরণা আর সহযোগিতায় সুফিয়া কামাল পড়াশুনা, সাহিত্যচর্চা আর সমাজসেবার মত কাজগুলো চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন। তাঁর কথা থেকে আমরা জানতে পারি,"চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালে প্রথম সমাজসেবার সুযোগ পাই। বাসন্তী দেবী ছিলেন অশ্বিনী কুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলের বৌ। তার সঙ্গে দুস্থ মেয়েদের বিশেষ করে মা ও শিশুদের জন্য মাতৃসদনে আমি কাজ শুরু করি।"১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধী একবার বরিশালে এসেছিলেন, সুফিয়া কামাল তখন তাঁর হাতে চরকায় কাটা সুতা তুলে দিয়েছিলেন।বেগম রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নারীর অধিকার আদায় এবং প্রথাগত গণ্ডির ভেতর থেকে নারীকে মুক্ত করে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার ব্রতে অবিচল ছিলেন আজীবন।সুলতানা কামালের লেখা থেকে আরো জানা যায়, "বেগম রোকেয়ার একটা বিরাট প্রভাব ছিল মার চিন্তা,চেতনা,কাজকর্মের মধ্যে।আমার বাবাও সেটাকে ভীষণভাবে শ্রদ্ধা করতেন।"সুফিয়া কামালের মধ্যে যে নেতৃত্ব দেয়ার একটা বিশাল গুণ ছিল,তাঁর সার্বিক কর্মকাণ্ডের মাঝে সে পরিচয়ও সুস্পষ্ট হয়ে আছে।দেশভাগের আগে ও পরে কোলকাতা এবং ঢাকায় একাধিক সমিতি বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।নুরজাহান মুরশিদকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, "প্রথম জীবনে জীবনে কাজ করার পর আঠার থেকে বিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ‘আঞ্জুমান খাওয়াতিনে’কাজ করি। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল কলকাতার বস্তি এলাকার মুসলমান মেয়েদের মনোভাবে একটু শিক্ষিত করে তোলা।মিসেস হামিদা হোসেন,মিসেস শামসুন্নাহার মাহমুদ,সরলা রায়,জগদীশ বাবুর স্ত্রী অবলা বসু,বহ্মকুমারী দেবী এরা সকলেই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে।আমার স্বামী ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ,এসব কাজে তার কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়েছি।এরপর ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় বর্ধমানে এবং '৪৬ এর ডাইরেক্ট একশন ডে'র হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর বিপন্ন এবং আহতদের মধ্যে কাজ করেছি।এই সময়ই তো হাজেরা মাহমুদ,রোকেয়া কবীর,হোসনা রশীদ ও তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় হল।১৯৪৭ এর পরই ঢাকায় এলাম।প্রথমে ওয়ারি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত করি এবং এই সমিতির মাধ্যমেই কাজ শুরু করি।এরপর পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন,গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি।”

৭. সেই ১৯২৮ সালে মুসলিম নারীরা যখন কঠোর পর্দাপ্রথায় বন্দী,সুফিয়া কামাল তখন সমস্তপ্রকার সংস্কার আর বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে কোলকাতায় বিমানে উড্ডয়ন করেন।আবার ১৯৩০ সালে সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন যখন ছবিসহ মহিলাদের লেখা ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানেও প্রথম সুফিয়া কামালের ছবিসহ লেখা ছাপা হয়েছিল। ১৯৩১ সালে সুফিয়া কামাল মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।প্রথম মুসলমান নারী হিসেবে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন তিনি। ১৯৩৩-১৯৪১ সাল পর্যন্ত সুফিয়া কামাল কোলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৩২ সালের ১৯ ডিসেম্বর ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বামী নেহাল হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েও দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালনে তিনি ছিলেন অবিচল। ১৯৩৯ সালের ৮ এপ্রিল কামালউদ্দীন আহমদ খানের সঙ্গে পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সুফিয়া কামাল।দাম্পত্যজীবনের পরবর্তী সময়গুলো সুফিয়া কামালের সকল কর্মের মর্মসহচর হয়ে তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা দান করেছেন কামালউদ্দীন খান।

৮. ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর কোলকাতা থেকে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন সুফিয়া কামাল।এখানে এসে নতুনভাবে শুরু করেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। ১৯৫১ সালের শেষের দিকে ঢাকা শহর শিশু রক্ষা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।এরপর ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং ভাষা আন্দোলনকে উপজীব্য করে অনেক কবিতা ও প্রবন্ধ রচনা করেন। নারীদেরকেও তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬০ সালে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কমিটি’গঠিত হয় এবং এ কমিটির পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রীনিবাসের নাম রোকেয়া হল রাখার প্রস্তাব করা হয়। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।সে বছর সারা বিশ্বে রবীন্দ্রজন্ম-শতবার্ষিকী উদযাপন করা হয়,অথচ রেডিও পাকিস্তান রবীন্দ্রনাথের প্রতি কোনরকম শ্রদ্ধা জানানো থেকে বিরত থাকে,উপরন্ত কিছু বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে রবীন্দ্রবিরোধী প্রচার চালানো হয়।ব্যতিক্রম ছিলেন সুফিয়া কামালসহ কিছু সাহিত্যিক,সংস্কৃতিকর্মী এবং বুদ্ধিজীবী।পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁরা রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।তাঁদের উদ্যোগে ছায়ানট নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়,যার সভাপতি নির্বাচিত হন সুফিয়া কামাল। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন পাকিস্তানি আদর্শের সঙ্গে না মিললে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন।এ মন্তব্যের প্রতিবাদে ঢাকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে যে ১৯ জন বিশিষ্ট বাঙালি প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন,সুফিয়া কামাল ছিলেন তাঁদের অন্যতম একজন।

৯. পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে সুফিয়া কামাল ছিলেন পূর্ণমাত্রায় সক্রিয়। এ সময় তিনি মহিলা পরিষদের সভাপতি ছিলেন,মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনে ঢাকায় নারী সমাবেশ ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন।এ পর্যায়ের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দুই কন্যা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারতে চলে যান। আগরতলায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিযুক্ত থাকেন। সুফিয়া কামাল এবং তাঁর স্বামী ঢাকায় অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন।এরমধ্যে মার্চ মাসে অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে সুফিয়া কামাল এবং নীলিমা ইব্রাহিমও আছেন এমন খবর রটে যায় সারা বিশ্বে।সুফিয়া কামাল পাকিস্তান-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির চেয়ারপার্সন ছিলেন বলে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ আরো অনেক দেশ পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে।হত্যা না করেও সুফিয়া কামালকে হত্যার দায় নিতে চায়নি ইয়াহিয়া।সুফিয়া কামাল বেঁচে আছেন এই বার্তাটি সারা বিশ্বে পৌঁছে দেয়ার জন্য আর্মি অফিসারদের চাপের মুখে ক্যামেরার সামনে এসে সাংবাদিকদের কেমন আছেন প্রশ্নের জবাবে সুফিয়া কামাল শুধু এইটুকুই বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ আমি বেঁচে আছি।’’পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। সুলতানা কামালের লেখা থেকে জানা যায়, ‘‘বাসার পেছনেই সোভিয়েত কালচারাল সেন্টার ছিল।ওরা ঐ দেয়াল টপকে অনায়াসে আমাদের বাসায় আসত।কথাবার্তা আলোচনা হতো কে কীভাবে যাবে,পথের মধ্যে টাকা-পয়সা খরচা,২ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ করে শাহাদত ভাইয়ের গ্রুপের ছেলেদের সমস্ত লেনদেন,আলোচনা,শলাপরামর্শ আমাদের বাসায় হতো।’’

১০. সোভিয়েত সরকার সুফিয়া কামালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বিশেষ বিমানযোগে তাঁকে সে দেশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে সবিনয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।দেশের মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে তিনি কোথাও যেতে রাজি হননি।মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সুফিয়া কামাল বাড়িতে চালডাল জমিয়ে রাখতেন,সুযোগমত মুক্তিযোদ্ধারা এসে নিয়ে যেতো।১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা আবদুল কাহহার চৌধুরীকে হারিয়েছেন সুফিয়া কামাল, তবু শোকে মুষড়ে পড়েননি। অগ্নিস্নানে শুচি করতে চেয়েছেন একাত্তরে লাখ লাখ সন্তানহারা বাংলা মায়ের হৃদয়ের ক্ষত। স্বজন হারানো কবি সুফিয়া কামাল দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁর লেখনির মধ্য দিয়ে সাহস যুগিয়েছেন। প্রতিদিনের কথা, ঘটনাগুলোও লিখে রাখতেন নিয়মিত, ‘একাত্তরের ডায়েরী’ নামে যা পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশিত হয়।এ সময়ের আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা না করে পারছি না। আমরা জানি ১৯৭১-এর যুদ্ধের পুরো সময়টা বঙ্গবন্ধুর পরিবার ধানমন্ডির একটি বাড়িতে নজরবন্দী অবস্থায় ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন। হাসিনা অসুস্থ্য হয়ে পড়লে আর্মিদের ব্যবস্থাপনায় তাকে হলি ফ্যামিলি (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়,বেগম মুজিব বা অন্য কাউকে সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।সুফিয়া কামালের কাছে কোন ভাবে খবরটা পৌঁছে যায়। তিনি দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে গেলেন,কর্তব্যরত গার্ড ভেতরে ঢুকতে বাধা দিলে তিনি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে যান।সুফিয়া কামাল ছিলেন এমনি সাহসী আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একজন মানুষ। প্রসঙ্গক্রমে আরো দু-একটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। আমরা জানি ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি করা হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসাকে বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়ে দেয় বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে তখন কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে রাজি হয়নি। তখন সুফিয়া কামাল বঙ্গবন্ধু-পরিবারকে সেগুনবাগিচায় বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলা বাজার স্কুল থেকে বের করে দেয়া হলে সুফিয়া কামাল তাঁকে নারী শিক্ষা মন্দিরে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। সুফিয়া কামালের কন্যা সুলতানা কামালও ঐ স্কুলে একই শ্রেণিতে পড়তেন। তিনি হাসিনা সম্পর্কে সুলতানা কামালের উদ্দেশে বলেছিলেন “তোমরা ওর সঙ্গে সবসময় খুব ভালোভাবে মিশবে, ওকে খেয়াল করে রাখবে, খেলবে ওর সঙ্গে। যাতে করে ও না বুঝে যে ওর কোনো বিপদ হয়েছে।’ ১৯৬২ সাল থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এবং ‘সাঁঝের মায়া’ বাড়ি দুটিতে বঙ্গবন্ধু আর সুফিয়া কামালের পরিবার পাশাপাশি বসবাস করেছেন। দুই পরিবারের মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সুফিয়া কামালকে বঙ্গবন্ধুর ছেলে-মেয়েরা ফুপু ডাকতেন। সুলতানা কামালের লেখা থেকে জানা যায়, ‘৭৫এর পরে মায়ের কাছে এলে শেখ হাসিনা সবসময় বলত, ফুপুর কাছে এলেই মনে হয় মায়ের আদরটা আমি পাই।’ এজন্য মার কাছে এসে বসেও থাকতে। বিশেষ করে যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিল ৩২ নম্বরের বাড়িতে আসত, প্রায়ই এসে মার কাছে বসে থাকত।” ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বৈরী পরিবেশেও তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন,বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠনে অন্যতম সহায়কও ছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট এই ট্রাস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিকে জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করে সেটিকে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’-এ রূপান্তরিত করে।

১১. আমাদের জননী সাহসিকা সুফিয়া কামাল কেবল কবি ছিলেন না, ছিলেন বড় একজন মানুষ। দেশ ও দশের মঙ্গলে ঝাঁপিয়ে পড়তে কুণ্ঠা বোধ করতেন না। মানুষের জন্য দাবি আদায় আর অন্যায়ের প্রতিবাদে থাকতেন মিছিলের নেতৃত্বে। অন্যের কষ্টকে নিজের বলে ভাবতেন। দুঃখ-কষ্টে মানুষের পাশে ছুটে যেতেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সুফিয়া কামাল সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। তাঁর সারা জীবনের কর্মকাণ্ড আমাদের পথচলার পাথেয়। তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় কাজ হলো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত, ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মা-বোনদের পাশে থাকা। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত নারীদের উদ্ধার, চিকিৎসা, আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২২ দিনের মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে তদানীন্তন সাংসদ বেগম বদরুননেছা আহমেদের সহযোগিতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা’ যাত্রা শুরু করে। ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি তদানীন্তন ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী কামারুজ্জামানের দপ্তরে তাঁর সভাপতিত্বে প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গঠিত সংস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসনে সমাজকল্যাণ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় থেকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

১২. ১৯৬১ সালে সুফিয়া কামালকে পাকিস্তানের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে তিনি সে পদক বর্জন করেন। সাঁঝের মায়া, মন ও জীবন, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া সোভিয়েতের দিনগুলি এবং একাত্তরের ডায়েরী তার অন্যতম ভ্রমণ ও স্মৃতিগ্রন্থ। সুফিয়া কামাল দেশ-বিদেশের ৫০টিরও বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, সোভিয়েত লেনিন পদক, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও স্বাধীনতা দিবস পদক। মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সব প্রগতিশীল আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

১৩. সুফিয়া কামালের জীবিত অবস্থায় নারীর অগ্রগতি,মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি,জনগণের অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে যত আন্দোলন হয়েছে,তার প্রত্যেকটির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৯০ সালে আশি বছর বয়সে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে রাজপথে কারফিউ উপেক্ষা করে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরই পরামর্শে ১৯৯২ সালে শহীদ জননী বেগম জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়।এই কমিটির উদ্যোগে গণ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়।সুফিয়া কামাল গণ আদালতের সদস্য নির্বাচিত হন।তিনি স্বৈরাশাসকের শাসনামলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বেগবান করেন। ধর্মান্ধ ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই সোচ্চার ছিলেন। এদেশের নারী-পুরুষের মধ্যে মুক্তি চেতনায় জাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন বলে সুফিয়া কামাল সাহিত্য সংস্কৃতিতে অমর হয়ে আছেন।

১৪. এ দেশের নারী ও মানবাধিকার আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামাল একটি নাম,একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে তিনি একটি আলোকিত অধ্যায়,ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।তিনি শুধু নারী জাগরণের পথিকৃৎ নন,বলা যায় বাঙালি জাগরণেরও পথিকৃৎ। তাঁর কর্মপরিধি ছিল বিশাল,কোন একটি বিশেষ পরিচয়ে তাঁর পরিচয়কে সংকুচিত করে দেখার সুযোগ নেই। কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী কবি সুফিয়া কামালকে নিয়ে লিখেছিলেন- ‘দুই হাতে অন্ধকার প্রাণপণে ঠেলে ঠেলে/ দৈত্য বধের কঠিন সত্য বুকে ধরে/ তুমি এলে।/ একটি মাটির প্রদীপ থেকে লক্ষ প্রদীপ জ্বেলে / তুমি এলে।’ মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তমনের মানুষের নিকট সুফিয়া কামালের কর্মময় জীবনের স্মৃতি অক্ষয় এবং অবিনশ্বর হয়ে থাকবে। তাঁর সাহিত্য কর্ম ও জীবন্ত কবিতাগুলো এখনো এদেশের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে। কবি সুফিয়া কামালের আদর্শ যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারলে এদেশ থেকে অপসংস্কৃতি বিদায় নিবে। নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় যোদ্ধা ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। আজীবন মুক্তবুদ্ধির চর্চার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে সংগ্রাম করেছেন তিনি। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর জীবনাদর্শ ও সাহিত্যকর্ম বৈষম্যহীন-অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করবে বলেই গভীরভাবে বিশ্বাস করি। মানুষের মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি অনন্য ও অদম্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন, নিশ্চিত করেই বলা যায়।

(তথ্যসূত্র: ‘ছিলাম কোথায় যেন নীলিমার নিচে’-সুলতানা কামাল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

লেখিকা:

অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন অধ্যক্ষ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসএস

  • সর্বশেষ
  • পঠিত