ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

মহামারী মোকাবিলায় আমাদের স্বাস্থ্যখাতের ভূমিকা

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২১ জুন ২০২২, ২১:৪০

মহামারী মোকাবিলায় আমাদের স্বাস্থ্যখাতের ভূমিকা
ড. জান্নাতুল ফেরদৌস

মহামারী শুরুর পর থেকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশও যথাসম্ভব দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে। করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা ধাপে ধাপে বাড়ানো, কোভিড-১৯–এ আক্রান্তদের আলাদা জায়গায় রাখা ও তাদের সংস্পর্শে আসা লোকদের শনাক্ত করা, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সঠিক তথ্য দিয়ে সব শ্রেণীর মানুষকে মহামারী মোকাবিলায় শামিল করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যথেষ্ট তৎপরতা দেখিয়েছে।

তবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির বছরে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের বেশিরভাগ খরচ করতে না পারার একটা কথা উঠে এসেছে। সেজন্য অর্থনীতিবিদদের অনেকে স্বাস্থ্যখাতে সক্ষমতার অভাব এবং ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন, মহামারী মোকাবেলায় চাহিদার বিপরীতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারায় ভ্যাকসিন কার্যক্রম থেকে শুরু করে চিকিৎসাসেবা- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংকট থাকছে।

২০২০ সালের সরকারি হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে সরকারি চিকিৎসক আছেন ৩০ হাজার৷ আর সবমিলিয়ে নিবন্ধিত চিকিৎসক আছেন এক লাখের মতো৷ এর সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীর হিসেব ধরলে সব মিলিয়ে এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি নয়৷

আবার বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট হাসপাতালের সংখ্যা সাত হাজার ৩১২টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতাল দুই হাজার ২৫৮টি, যার মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকও অন্তর্ভুক্ত৷ পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ২৫৪টি৷ অর্থাৎ বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি এক হাজার ৫৮১ জনের জন্য একজন নিবন্ধিত চিকিৎসক আছেন৷ সরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৫২ হাজার ৮০৭টি৷ আর বেসরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি৷ সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি৷ অর্থাৎ বাজেট কম হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের এই চিত্র চলমান। বিশ্লেষকদের মতে, স্বাস্থ্যখাতের কোথায় কী প্রয়োজন তার সঠিক পরিকল্পনার অভাবে মূলত পূর্ণাঙ্গ সুফল থেকে দেশবাসী বঞ্চিত হয়ে থাকে।

অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় করোনা-পূর্ববর্তী অবস্থায় আমরা এখনও আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি। বৈশ্বিক অর্থনীতিও একটা সংকটের মধ্যদিয়ে গেছে এবং তা এখনো বজায় রয়েছে। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিগুলো হলো রপ্তানি খাত, রেমিট্যান্স এবং দেশীয় অর্থনীতির শিল্প, কৃষি ও সেবা খাত। সেগুলোও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারিভাবে এই ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমরা উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখেছি। করোনার পুরো বিষয়টাই অনিশ্চয়তাপূর্ণ ছিল। কখনো মনে হয়েছে যে করোনার সংক্রমণ কমে আসছে। আবার নতুন নতুন ধরনের আঘাতে অর্থনীতির পুরোনো গতি ফিরে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে করোনার সময়ে আমাদের অর্থনীতির যে ক্ষতিটা হয়েছে, তা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের সময় লাগবে এবং আরও অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। তবুও করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় বাজিমাত করেছে বাংলাদেশ। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে।

জাপানভিত্তিক ‘নিক্কেই এশিয়া’ প্রকাশিত ‘নিক্কেই কোভিড-১৯ রিকভারি সূচকে’ এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। এই সূচকে মূলত তুলে ধরা হয় করোনা মহামারীর শুরু থেকে বিশ্বের শতাধিক দেশের কোভিড-১৯ মোকাবিলার এই পরিসংখ্যান। এতে বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে রিকভারি ইনডেক্সে শীর্ষস্থানে রয়েছে কাতার। এছাড়া তালিকায় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), কম্বোডিয়া ও রুয়ান্ডা। এরপরই পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

নিক্কেই এশিয়া বলছে, করোনার সংক্রমণ ব্যবস্থাপনা, ভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান এবং এ সংক্রান্ত সামাজিক তৎপরতার ওপর ভিত্তি করে ‘নিক্কেই কোভিড-১৯ রিকভারি সূচক’-এ দেশ ও অঞ্চলের মূল্যায়ন করা হয়েছে। সূচকে কোনও দেশের অবস্থান যত ওপরে হবে, করোনা মোকাবিলায় দেশটির অবস্থান তত ভালো বলে বোঝা যাবে।

অর্থাৎ সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশ মহামারী মোকাবিলায় যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। যদিও অর্থ বরাদ্দের সিংহভাগ অব্যবহৃত এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যেও আমাদের এই অর্জন। এতে ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ প্রসারিত হয়। সেটি হল যদি আমাদের সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যেত তাহলে সামগ্রিক উন্নতি আরও প্রখর দৃষ্টিগোচর হতো।

সম্প্রতি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। এ বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য সরকারের বরাদ্দ বেড়েছে চার হাজার ১৩২ কোটি টাকা। গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকায়।

তবে একই সমীকরণে অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি আবারও সামনে আসছে। আমাদের স্বাস্থখাত সব সময় বরাদ্দের ভিত্তিতে পরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্বল ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে চিকিৎসা সেবার দৈনদশা থাকলেও তা সেভাবে নজরে আসতো না। কারণ সরকারি স্বাস্থ্য সেবার ওপর নিম্ন আয়ের মানুষ বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল।

আবার সঠিক অর্থ ব্যয় নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে অন্যতম আরেকটি কারণ হলো প্রতি তিন মাস অন্তর হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী এসব সামগ্রীর জন্য অর্থ ছাড় করা হলেও ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হয় না। সারাদেশে ভারী যন্ত্রপাতি কেনার কাজের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারও প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করেনি। এসব কারণে সিংহভাগ অর্থ অব্যয়িত থেকে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সংস্কারে হাত দিতে হবে নাকি, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার করার পর সেই অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে হবে, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান চলমান মহামারির মধ্যেই ভবিষ্যৎ মহামারী মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে এবং জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তাই আমাদের স্বাস্থ খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি ভবিষ্যৎ যেকোন দুর্যোগ কিংবা জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় এখনি সতর্ক হওয়া জরুরি। একইসাথে সকল অব্যবস্থাপনা দূর করে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে গণউন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • পঠিত