ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

পারলে ক্ষমা করে দিও

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২২, ১৯:২৭  
আপডেট :
 ০৮ জুলাই ২০২২, ২০:১১

পারলে ক্ষমা করে দিও

কিছু ফুল নিয়ে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীকে দেখতে যাই। উনি তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তবুও তর তর করে স্মৃতির মই বেয়ে বাক্স পেটরা খুলে আমাকে হাসিমুখে এটা সেটা বলতে লাগলেন, দেখাতে লাগলেন।

আমি মনে করেছি

‘আজ,আমার জীবনের মহান স্মরণীয় দিন।’ একজন ঋদ্ধ বিপ্লবীর দীর্ঘ সঙ্গ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এর মাঝে ঘণ্টাখানেক আলাপ সেরেছি। এক পর্যায়ে বিপ্লবী আমার কথাবার্তা মেপে জিজ্ঞেস করলেন

- আপনি কি পুলিশ?

- হ্যাঁ,

- কোন পদে আছেন?

সাব-ইন্সপেক্টর।

- ও! দারোগা?

মুহূর্তে আমার মনে হলো, বিপ্লবীর স্মৃতির তপোবনে বৃটিশ পুলিশের খাকি দারোগা সিপাই হাবিলদার নায়েক গুপ্তচর ঝটিকা আক্রমন চালিয়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে! উনি যে - আমাকে আরও কিছু বলবেন; সে পরিস্হিতি সুযোগ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমনের মতো বৃটিশ পুলিশও দেয়নি। বিপ্লবীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে স্মৃতির বাক্সপেটরা কেড়ে নেয়া হলো। বিপ্লবীর চোখে মুখে হতাশার শিলাবৃষ্টি বইছে।

এখন বিপ্লবীর মুখের ভাবে বৃটিশ পুলিশের রিমান্ড জিজ্ঞাসাবাদে ধূর্ততা ও বুদ্ধিমত্তা মেশানো ভাষা নেই। চোয়ালের গড়নে দৃঢ়তা -ব্যঞ্জক অনুপস্হিত! চোয়ালের নিচের চামড়াগুলো বয়সের অভিমানে ঝুলে পড়েছে। শতাব্দীর রূঢ় বাস্তব পরাবাস্তব মিশেল গল্প বলার ইচ্ছেগুলো এখন বিপ্লবীর কাছে মৃত! রূপকল্পের অবকাঠামো পলেস্তারা খসে পড়ছে।

চোখগুলো স্থির, মাছের মতো ঘুমিয়ে আছে। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে,কিন্তু কপালে শিশির বিন্দু ঘামগুলো চটচট করছে। পাশে কিঙ্করি চা নিয়ে ডাকছে। বিপ্লবীর শরীর খারাপ করছে; আমি চরম আত্মগ্লানি নিয়ে বিপ্লবীর দীর্ঘশ্বাসগুলো বুকে জমা রেখেছি। পরে যতোবার বিজ্ঞ আদালতের হুকুমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল করতে কিংবা কোনো মামলার প্রয়োজনে কাউকে গ্রেপ্তার করেছি; আত্মশ্লাঘা দূরে থাক, আমার পূর্বসূরি বৃটিশ পুলিশের নির্মমতা বার বার স্মৃতির দরজা জানালা খুলে তাকিয়ে দেখেছে।

প্রচলিত আইনের ভাষায়,পুলিশ মূলত আদালতের আজ্ঞাবহ আইনের দাসমাত্র। এ মানব রোবট দাসের জন্ম হয়েছে একমাত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রয়োজনে। ক্ষুধার্ত নেকড়ে, কামুক পুরুষ যেভাবে জ্ঞানশূন্য হয়ে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও রোবট পুলিশ মানবের জন্ম দিয়েছে। রোবট যন্ত্র মানবের যেমন: আহার মৈথুন বিশ্রাম নেই, সে ভাবে একবিংশ শতাব্দীর মধ্যগগনে এসেও পুলিশের পবিত্র গ্রন্থখ্যাত পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) বৃটিশের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পুলিশের আহার নিদ্রা বিশ্রামের সময় নিরূপণ করতে কেউই সাহস করেননি। পুলিশের চাকরি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা। এ জন্যে পুলিশের ভোর দুপুর সন্ধ্যা রাত নেই। যখন ডাক পড়বে,আসতে বাধ্য। বৃটিশ পুলিশের রিমান্ড-ডিমান্ড শেষ করে একজন বিপ্লবীর হাতে তেমন কিছু থাকেনি। ওদের হয়নি -একটি সুখের ঘর, পরিবার সংসার। অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠ পেরিয়ে অনেক বিপ্লবীর চাঁদ সূর্যদেব দেখা হয় নি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা একাই লড়তে হয়েছে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সে যুদ্ধ সাম্য প্রতিষ্ঠার,সমঝদারের নয় -একজন মজদুরের।

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বিবেকের আয়নাগুলো ধ্বংসের হাতিয়ার হিসেবে চালু করেছিল,অসংখ্য সংযত অসংযত পুরস্কারের টোপ। কমরেড বিপ্লবী ধরতে গুপ্তচর ভাতা,সাহসী পুরস্কার, গুডমার্ক,প্রশংসা। ব্যাণ্ডপার্টির আদলে গড়া বৃটিশের সুক্ষ্মদর্শী ধুরন্ধর চালের ফাঁদে পা দিয়ে সাময়িক বৈষয়িক লোভে পড়ে স্বদেশীরাই নিজেদের স্বদেশ মাতার মুণ্ডু কেটেছে বহুবার। স্বদেশি ভাইদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে রক্তমাখা পুরস্কার বুকে টাঙিয়ে কালের ছিন্নমস্তার মতো নিজের মা ভাই বোনের রক্ত পান করেছে বার বার। স্বদেশি বিপ্লবীর পশ্চাৎদেশে গরম ডিম দিতে পর্যন্ত হাত কাঁপেনি পাষণ্ডদের। পরে নির্বোধ পরিহাসে ওরা হেসেছে,কেতাদুরস্ত স্বভাবে প্রমোদ বিহারে ভেসে বেড়িয়েছে এ তল্লাটের সবখানে। এ তল্লাটে ইংরেজ যতোটা না ক্ষতি করেছে,তার অধিক ক্ষতি করেছে স্বদেশি আপনজন।

সাপের ন্যায় বহিরাবরণ পাল্টানো বৃটিশ পুলিশের ধারাবাহিক সিরিয়ালে নতুন করে যোগ হলো -বিজ্ঞাপন পাকিস্তান। বৃটিশদের লুকানো স্বার্থান্ধ ধীর বিষক্রিয়া প্রতিক্রিয়া -পুলিশ বাহিনী ছাড়িয়ে আস্তে আস্তে ভয়ঙ্কর পটাসিয়াম সায়ানাইড হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল স্হানে ছড়িয়ে গেল। রাষ্ট্রের আকাশ বাতাস নদ নদী পাহাড়ি প্রজাপতি মায়া হরিণের নিঃশ্বাস ভারি হলো; বৃটিশের লুকানো বিষ-গ্রাম নদী পাহাড় পর্বত রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানে জেঁকে বসলো।

বৃটিশ সাহেবদের রিমান্ড চুরি ডাকাতি পরকীয়া ধর্ষণ কর্ষণ শেষে ভণ্ড sorry please excuse me. বাক্যটি পালিয়ে গেলো।

শুরু হলো একটি করে বাঈদচোদ সংসার। সে সংসারে বৃটিশদের গোপন বিষের দরকার নাই। ততদিনে সবাই গোপন বিষ হজম করে হয়ে উঠেছেন একজন করে বিষবৃক্ষ সরীসৃপ। দয়া মায়া নাই,যাকে তাকে ছোবল মারছে গিলছে।

একদিন আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ের পরশ পাথরে বিষবৃক্ষ মরে গেল। মানব সরীসৃপগুলো সাম্প্রদায়িক বিষের আস্ত এক গবেষণাগার খুলে দিয়ে সরে গেল।

এই যে, বৃটিশদের লুকানো লোভের গোপন বিষ সুযোগ সুবিধা প্রমোশন পুরস্কারের লোভে খুনি হতে হলো - স্বদেশি সন্তান। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভয়ানক পটাশিয়াম সায়ানাইড গিলে আবার আক্রান্ত হলো লিভার ব্রেইন! এখনো চিন্তার সুযোগ পায়নি কেউই। ক্ষতি হলো, সাহিত্য সংস্কৃতি গৌরবের সিংহাসনে জেঁকে বসা মানবিক আচরণ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বৃটিশ পাকিস্তান পুলিশের রিমান্ড-ডিমান্ড মিটিয়ে পেয়েছি -প্রাণের বাংলাদেশ। দেশের সবখানে এখনও সবাই বৃটিশ পুলিশের রিমান্ড চায়। ঘরে বাইরে পাড়া মহল্লা আদালত পাড়া হাসপাতাল হয়ে নতুন সবজান্তা শমশের ইংরেজ চোস্ত, জেনারেল দোস্ত সেজে নতুন করে ধারাবাহিক নাটকে নতুন নামে ডাকছে

‘অই মিয়া, আমি কে জানো? চেয়ারের ভাষা বোঝ? তোমার নিয়তি আমার হাতে। আমি যা বলব -সেটাই হবে আইন,পারলে ক্ষমা করে দিও।’

আমি বিপ্লবীর কাছে পূর্বসূরি পেরিয়ে

উত্তরসূরি ভয়ঙ্কর রিমান্ড-ডিমান্ড ভাবনায় কী করে বলি!?

‘হে বিপ্লবী! পারলে ক্ষমা করে দিও।’

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক,বাংলাদেশ পুলিশ। মেইল:rajibkumarvandari800 @gmail.com

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত