ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

জন্মদিন

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২২, ১৫:৪৬  
আপডেট :
 ০২ অক্টোবর ২০২২, ১৬:০০

জন্মদিন

কিছুদিন আগে আমাদের এলাকার কৃষক বদরুল, আহাম্মদ ছফা, ছমিউদ্দিন, দিনমজুর রাধাশ্যাম, অজিত, গুরা মিয়ার সাথে বিস্কুট ডুবিয়ে চা খাচ্ছিলাম।

দিনমজুর রাধাশ্যাম তার নাতির জন্মদিন পালন নিয়ে গল্প করছে। আমি পাতি নেতা মনে হু হু করে যাচ্ছি। কৃষক বদরুল একেবারে চুপচাপ! তার ভাষা বুঝি এইমাত্র কোনো বর্গী, তুর্কি, মারাঠি, চুরি করেছে। এক প্রকার হতাশ মনে বলল, জন্মদিন বড়লোকের। যাদের ভাত কাপড়ের চিন্তা নাই, তাদের। এই যে ধর 'তোমাদের জন্য।' আমি মৃদু প্রতিবাদে বললাম-দ্যাখো, তুমি হয়তো বা জানো না? আমার জীবনে কোনো জন্মদিন নাই। আমি করি নাও। এই ছাড়া একটি দামি চেয়ারে বসে কারোর ‘হ্যাপি হ্যাপি’ শুনতে ভালো লাগে না। আমার গরিব আত্নীয় অনাত্মীয় প্রতিবেশি পরিজনের মনে কখনো আমার ব্যবহারে কষ্ট দূরে থাক; চিন্তা করতেও দেইনি। তা ছাড়া বাবার মুখে শোনা, মহাভারতের কিছু উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করি।

রহস্যঘেরা চিরসুখী মনের মার্গে যুধিষ্ঠিরকে অর্জুন জিজ্ঞেস করলেন; এ জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুখি কে?

উত্তর: পরিবার পরিজন নিয়ে শাকান্ন খেয়ে মিলেমিশে বাস করে সে জনা।

পৃথিবীর সুখি রাজা কে?

উত্তর: প্রজাদের সুখে সুখি, দুখে দুখি সে জন।

আমার অনেক অনেক পরিজন সুখি হতে পারেননি। অভাব তাদের পেছনে চীনা জোঁকের মতো লেগে আছে। তাদের সাথে মিশতে মিশতে মাঝে মাঝে নিজেকেই নেতা বানিয়ে ফেলি। সারি সারি পাতি নেতা বুড়ো নেতা মাঝারি নেতাদের ভিড়ে আমিও নেতাদের মতো করে উপদেশ দিই-তোমরা এটা কর, ওটা কর।

নেতা নেতা ভাব নিয়ে ওদের বাড়িতে সর্বভুক নির্লজ্জ মনে চেটেপুটে একপেট খেয়ে স্বালোক তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দিই।

‘আপনি অনেক মহান, শুভ জন্মদিন, আপনিই তো আমাদের অহঙ্কার, গৌরব কথামালা মার্কা কমেন্টস দেখে পুলকিত হই। জারিজুরি দিয়ে নিজেকে নখদন্তহীন রয়েল বেঙ্গল টাইগার মনে গরিবের সীমানা ছাড়া মনের বাগানে নিশ্চিত নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ি।

ফেসবুক, অনলাইনে কেঁদে কেঁদে বিসিএস বাধা পেরিয়ে অনেকজন বলেন, আমি নিম্নবিত্ত ছিলাম। অনাহার অর্ধাহার কাটিয়ে বিসিএস অফিসার হতে পেরেছি। আমার বাবা রিকশা চালাতেন।

স্বালোক তুলে গর্ব করে বলেন, এই হচ্ছে আমার বাবা। অন্যদল বলেন, আমার মা মানুষের বাড়িতে বাসন কোসন মেজে আমাকে পড়িয়েছেন। ঠিকমতো খেতে পেতাম না। রাতে মা ডেকচি করে যা আনতেন তাইই খেতাম।

আরেকদল বলে বেড়ান, আমি পরীক্ষা না টিকে বিষ খেয়ে মরতে গেছিলাম। পরে জীবনের কাছে বছরখানেক সময় চেয়ে দিনরাত একনাগাড় আঠারো ঘণ্টা পড়ে সবই মুখস্ত করে নিয়েছি।

প্রকাশিত এই রকমের বিসিএস সফলতার শতেক গল্প আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। এঁনারা সত্যিটা বলেছেন। এক সময়ে এঁনারা খাবারের যন্ত্রণা নিয়ে বুভুক্ষু কুকুর বেড়ালে ভর করলেও নিশ্চয় এখন সে কষ্টটা নাই। তাঁরা জনগণের সেবক মনে কে কতোটা করেন,তা জানতে পারিনি। এই দেশে উপরওয়ালার কী রহস্য! হুকুম জানি না। ম্যাক্সিমাম আমলা সরকারের বড় বড় অফিসারের সন্তান বড়জোর জুতা কাপড় সুপার সপ দোকানে টিকতে না পেরে আমেরিকা কানাডা লণ্ডন জার্মানি পাড়ি জমান। নেতাদের সন্তান নেতাগিরি করেন।

ওই দলেরই একজন উঁচুদরের এক অফিসের হল রুমে নিজের জন্মদিন কর্মচারীদের আয়োজনে কেক কেটে পালন করেন। তাদের উদ্দেশ্য একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন।

‘আপনারা একেজজন একটি করে চেয়ারে বসে আমার কিছু কথা শোনার জন্য বসে আছেন। আপনাদের মাটিতে বসে শুনতে হয়নি। আপনারা ভাগ্যবান। প্রথম কেক কাটার জাতিস্মর স্মৃতি আমার মনে নাই। মায়ের মুখে শুনেছি, আমার প্রথম জন্মদিন মায়ের পেটে পালন করেছি। আমার একেকজন আত্মীয় স্বজন আপনাদের মতো অনেক ড্রাইভার বাবুর্চির দ্বিগুণ বেতন দেন। আমার ছোট ভাই সপরিবারে আমেরিকার ব্যয়বহুল এলাকা হলিউড পরিচালক জেমস ক্যামেরনের সাথে ব্যবসা করেন।

বাড়িতে বাবার তিনটে পুকুরে মাছ চাষ হয়। মাছ কিনতে হয় না। দেশি মাগুর কই টেংরা, চাপিলা রুই মৃগেল ভর্তি। ভোদাই থানা মহুয়া গ্রামের যে কেউ আমাদের পরিবারকে এক নামে চিনবেন।

এর মাঝে চামচা মার্কা পিএ প্রশাসনিক অফিসার গদগদ কণ্ঠে বলেন- ‘স্যার বলুন। আমরা কোনোদিনই আপনার খোলা মনের কথা শুনিনি। আপনার সততা দায়িত্ববোধ প্রজ্ঞা মেধা মনন এই দেশে কারোরই চোখে পড়েনি। আজ ভিজিটর নাই। সারাদিন আপনার কথা শুনতে থাকব। সমস্বরে সবাই নোমান স্যারকে চেপে ধরেছে।

স্যার, আমরা ভাগ্যবান। আজ আপনার কোনো কথাই শুনছি না। আপনার জন্মদিবসে না বলা কথাগুলো শুনতে চাই। প্রয়োজনে লেকচার শুনতে মিনিমাম ত্রৈমাসিক অন্তর অন্তর জন্মদিন পালন করবোই। স্মিত হেসে নোমান স্যার বলতে শুরু করেন।

তোমরা কেউ কি জানো? আমার বাড়িতে পাঁচ একরের একটি গরু খামার আছে। একশর মতোন দুধেল গাই। চারশো গরু ফার্মের প্রজেক্ট নিয়ে ভেটিরিনারি কোর্সের লোকজনের ভিড় লেগেই থাকে। আম্মাকে কত কত বার বলেছি, আম্মিজান, আব্বিজানের রেখে দেয়া ব্যাংক ব্যালেন্স আমরা সবাই সারাজীবন বসে খেলে ও শেষ হবে না। খামোখা কেন কেন আপনি গরুর হিসাব রাখতে যান?

হঠাৎ বিদ্যুৎ নাই। এসি, পাখা বন্ধ। জেনারেটর! জেনারেটর আবুল আবুল বলে পিএ হেড ক্লার্ক উজির নাজির চিৎকার করে এইদিক ওইদিকে ছোটাছুটি করছে। নোমান স্যার, টাই ঢিলেঢালা করছে।

লেখক: পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ

মেইল: [email protected].

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত