ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

মাদক শনাক্ত ও উদ্ধারে প্রয়োজন ডগ স্কোয়াড

  ইমদাদ ইসলাম

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:৪৯

মাদক শনাক্ত ও উদ্ধারে প্রয়োজন ডগ স্কোয়াড
প্রতীকী ছবি

মাদক প্রকৃতিতে পাওয়া লক্ষ্য কোটি বস্তু সামগ্রীর অন্যতম। সভ্যতার বিকাশের ধারায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে মানুষ জীবনের প্রযোজনে যা কিছু সৃষ্টি ও উদ্ভাবন করছে, মাদক তার অন্যতম। মাদকের নিয়ন্ত্রণ প্রযোজন কারণ এর নেশা বা আসক্তির অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্ত রাখা, মানুষের দেহ-মন, স্বাভাব ও আচরণের উপর এর নানারকম নেতিবাচক প্রভাব ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া রোধ করা। এ ছাড়াও মাদকের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত অপরাধকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যও মাদক নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।

বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে মাদককে ঘিরে। বাংলাদেশে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ মাদক বেচাকেনার সাথে জড়িত তার সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। তবে অর্থনীতিবীদরা এ বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারণা দেন,সেটা হলো কম বেশি নব্বই হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে কম বেশি ৩২ ধরনের মাদকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি বছরে গড়ে মাদকের জন্য ব্যয় করে ৫৬ হাজার ৫৬০ টাকা থেকে ৯০ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। মাদক হিসেবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ইয়াবা।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০২০ সালে ৩৬ লাখ ৩৮ হাজারেরও বেশি ইয়াবা জব্দ করেছিলো। বাংলাদেশে যে সমস্ত মাদকের ব্যবহার বেশি দেখা যায় সেগুলো হলো ইয়াবা, গাজা,ফেনসিডিল, হেরোইন, কোকেন। এছাড়াও এলএসডি,হুক্কা/ শিশা, আইসের ব্যবহারও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শতকরা ৮৫ শতাংশ মাদকাসক্তির বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন উদীয়মান অর্থনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫ তম অর্থনীতির দেশ। আমাদের আছে অপার সম্ভবনাময় ভবিষ্যত। আমাদের মাথাপিছু আয় এখন ২৮২৪ মার্কিন ডলার।

আমাদের দেশের ৩ কোটিরও বেশি মানুষের মাথাপিছু আয় ৫ হাজার মার্কিন ডলারের উপরে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে এলডিসি তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল ভোগ করছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হচ্ছে একটি দেশের জনসংখ্যার বয়স চিত্রের তারতম্য, যা জন্মহার ও মৃত্যুহার হ্রাস বৃদ্ধির কারণে ঘটে থাকে। এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ১৫-৬৪ বছর বয়স পর্যন্ত কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। বর্তমানে আমাদের দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ। দেশে এখন কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৬১ লাখের মতো। এর মধ্যে কম বেশি ৬ কোটি মানুষ সরকারি বেসরকারি কাজে নিয়োজিত। অবশিষ্ট ৪ কোটি ৬১ লাখ মানুষের মধ্যে বড়ো একটা অংশ সম্পূর্ণ বেকার। বাকিরা মাঝে মধ্যে কাজ করে থাকেন,তাদের নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। এদের অনেকেই মাদকাসক্ত। আমাদের সমাজে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত এবং ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত।

১০ কোটি ৬১ লাখ কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে কম বেশি এক কোটি মানুষ কোনো না কোনভাবে মাদকাসক্ত। এটা আমাদের মতো একটা উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটা ভয়াবহ অবস্থা। আমাদের দেশে কম বেশি ৬০ হাজার মানুষ প্রতক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। এরমধ্যে ২৭ হাজারেরও বেশি মহিলা মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও বাংলাদেশকে অনেকরকম বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর অন্যতম একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্র তাদের বৈশ্বিক অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আমাদের দেশে পরিচালনা করছে। যার অংশ হিসেবে মাদক, অস্ত্র, মানব পাচার,অর্থ পাচার ও মানিল্ডারিং অন্যতম। এসব অপরাধীরা অভিনব কৌশল অবলম্বন করে অপরাধ সংগঠিত করে থাকে এবং প্রতিনিয়তই তাদের কৌশল পরিবর্তন করে থাকে। আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যম অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের বৃহৎ মাদক উৎপাদনকারী দুইটি বলয়ের মাঝে। সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে দেশে যুবকদের সংখ্যা বেশি সে দেশে মাদকের চাহিদাও বেশি। একদিকে আমাদের কর্মক্ষম শিক্ষিত যুবকদের সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি বেকারত্বের সংখ্যাও বেশি। এদুটোই আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতির কারণে মাদকের উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহের মতো কাজগুলো ডিজিটাল ফরম্যাটে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ফলে মাদক ব্যবসায় এখন নতুন একমাত্রা যোগ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীরা এখন আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রীতিমতো গবেষণা করে নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধানসহ মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য অভিনব কৌশলে নানারকম প্রচার প্রচারনা চালাচ্ছে।

এরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে মাদক পৌঁছানোর জন্য নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে নেয়। এসব ক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়িরা কোনরকম ঘাটতি রাখেনা। আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেও মাদক পাচার করার অভিযোগ পত্রিকায় এসেছে। আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরা বিভিন্ন লাগেজের মাধ্যমে গার্মেন্টস সামগ্রীসহ অন্যান্য জিনিস প্রেরণের আড়ালে অভিনব পদ্ধতিতে লাগেজে ক্যাভিটি তৈরি করে মাদক পাচার করে থাকে। লাগেজে ক্যভিটি তৈরি করা হলে স্ক্যানিং মেশিনে মাদক ধরা পড়ে না। এজন্য বিভিন্ন দেশে মাদকসহ বে- আইনি পণ্য চেকিং এর জন্য প্রশিক্ষিত কুকুর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মাদক উদ্ধারের কাজে প্রথম কুকুর ব্যবহার করে ইসরায়েল ১৯৬০ সালে। তাদের সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৫ সালে ফ্রান্স,পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেসহ অনেক দেশেই কুকুরের ব্যবহার শুরু করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও তাদের বিমানবন্দরগুলোতে ড্রাগডগ ব্যবহার করে থাকে।

কুকুর এমন একটি প্রণি যার রয়েছে অসংখ্য উপকারী বৈশিষ্ট্য। প্রখর ঘ্রাণশক্তি কুকুরকে অন্য সকল প্রাণি থেকে আলাদা করে দিয়েছে। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি মানুষের চেয়ে লক্ষ্যগুণ বেশি এবং একবার কোনা ঘ্রাণ কুকুরের নাকে পৌঁছালে তা দীর্ঘ সময় ধরে তার স্মৃতিতে সংরক্ষিত থাকে। এর কারণ হচ্ছে কুকুরের আছে মানুষের চেয়ে কম বেশি ২ শত মিলিয়ন সেন্ট রিসেপ্টর। এর মধ্যে ১৫ মিলিয়ন রিসিপ্টরের আছে ইনফ্রারেড ক্যাপাবিলিটি। ২ শত লিটার পানির মধ্যে এক ফোটা অন্য যে কোনো তরল পদার্থ মিশিয়ে দিলেও কুকুর ঠিকই ঐ তরলকে শনাক্ত করতে সক্ষম। কুকুর বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে মানুষের শরীরের গন্ধও শনাক্ত করতে সক্ষম। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সামরিক বাহিনীতে ডগ স্কোয়াড রয়েছে। আমাদের দেশেও ডগ স্কোয়াডের ব্যবহার রয়েছে। সামরিক বাহিনী ছাড়াও বিজিবি, পুলিশ ও RAB এর ডগ স্কোয়াড রয়েছে। মদকদ্রব্য শনাক্ত,উদ্ধার ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের দেশেও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াড গঠন এখন সময়ের দাবি। কুকুরের দৈহিক গঠন, আকার,রং ইত্যাদি বিবেচনায় পৃথিবীতে কম বেশি ১৭০ প্রজাতির কুকুর দেখা যায়। ব্যাবহারের দিক থেকে কুকুরকে সাত শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ঃ হাউন্ড,হার্ডিং ডগস,স্পোর্টিং ডগস,নন- স্পোর্টিং ডগস,টেরিয়ার,টয় ব্রিডস,ওয়ার্কিং ডগস।

আমাদের সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে মাদক নিয়ন্ত্রণের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ এ মাদক নিয়ন্ত্রণের সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা উল্লেখ করা হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়েও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে, তবেই হবে সম্ভব হবে মাদক নিয়ন্ত্রণ। (পিআইডি ফিচার)

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত