ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

আপত্তিকর ভিডিও হাতিয়ে ব্লাকমেইল, চক্রের মূলহোতাসহ গ্রেপ্তার ৯

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২২ মে ২০২৩, ১৭:৩০

আপত্তিকর ভিডিও হাতিয়ে ব্লাকমেইল, চক্রের মূলহোতাসহ গ্রেপ্তার ৯
ছবি: সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রাপ্ত বয়স্ক তরুনীদের আপত্তিকর ভিডিও ফাঁস করে ব্ল্যাক মেইলিং এবং ভিডিও দেশে-বিদেশে ক্রয়-বিক্রির সাথে জড়িত চক্রের মূল হোতাসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- চট্টগ্রামের শ্যামলী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. আবু সায়েম ওরফে মার্ক সাকারবার্গ (২০), বেসরকারী চাকরিজীবী মো. মশিউর রহমান শুভ (২৬), সিলেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী মো. সাহেদ খান (২২), নর্থ-সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগগের শিক্ষার্থী কেতন চাকমা (২০), ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাজমুল হাসান সম্রাট (২২), ঢাকার তেজগাঁও কলেজের ফাইন্যান্স এ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. মারুফ হোসেন (৩৪), শাহরিয়ার আফসান অভ্র (২৪), চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের শিক্ষার্থী জুনাইদ বোগদাদী শাকিল (২০), ও বেসরকারী চাকরিজীবী মো. জসীম উদ্দীন (৩৮।

রোববার চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এই ৯জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি'র সাইবার পুলিশ সেন্টার। তাদের কাছে মার্ক সাকারবার্গ নামক টেলিগ্রাম আইডিসহ অসংখ্য টেলিগ্রাম গ্রুপ, বিভিন্ন টেলিগ্রাম চ্যানেলের অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের কয়েক হাজার ন্যুড ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে। এছাড়াও তাদের কাছ থেকে মোট ১১টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে।

সিআইডি জানায়, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল করে আসছে। একইসঙ্গে অভিভাবকদেরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে তারা। চক্রটি তরুণীদের ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম আইডি হ্যাক করে ‘পমপম’ নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে গোপন ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখাত। পরে তারা ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ দাবি করত। অর্থ দিতে না পারলে সেসব তরুণীদের ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করা হতো। আর কোনো প্রস্তাবেই সাড়া না দিলে ভিকটিমদের নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্যসহ সেসব গোপন ছবি ও ভিডিও লাখ লাখ সাবস্ক্রাইবারের টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিত। গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভিকটিমের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আয় করে তা নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করেছে।

সোমবার দুপুরে মালিবাগ সিআইডি হেডকোয়ার্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মতো দেশের অসংখ্য ক্রেতা গ্রুপটির সদস্য হয়েছে। এসব দেশের নাগরিকরা উঠতি বয়সের মেয়েদের (১২-১৮ বছর) আপত্তিকর কন্টেন্ট কিনে সংরক্ষণ করতো।

সিআইডি প্রধান বলেন, চক্রটির নেতৃত্ব দেয় মার্ক-সাকারবাগ নামের এক ব্যক্তি। শুরুতে খুবই চতুর এই মার্ককে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না। আমরা প্রযুক্তির সহায়তায় তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয়েছি। মার্কের আসল নাম আবু সায়েম। বেকার সায়েম থাকে চট্টগ্রামে। এনআইডি অনুযায়ী তার বয়স ২০ বছর। সে শ্যামলী পলিটেনিক ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম থেকে ইলেকট্রিক্যাল এ ডিপ্লোমা করেছে। তার বিভিন্ন একাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। এরইমধ্যে এক ভুক্তভোগী ও তার প্রেমিকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পমপম গ্রুপে ছড়িয়ে দেয়া হয়। পরে ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মার্ক-সাকারবার্গ ও তার দলের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা দায়ের করে ভুক্তভোগীরা।

তিনি বলেন, তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় চট্টগ্রামের লালখান বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে মার্ক ওরফে সায়েমকে গ্রেপ্তার করা হয়। মার্কের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তার ঘনিষ্ট দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রামের হাউজিং এলাকা থেকে এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মার্ক ওরফে সায়েমের মোবাইল ফোন তল্লাশী করে মার্ক-সাকারবার্গ আইডিটি লগইন করা অবস্থায় পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে আবু সায়েমই মার্ক সাকারবাগ।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পমপম গ্রুপের যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপ আছে তার এডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। এডমিনদের কাজ ছিল মার্কের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট যোগাড় করা। নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেইক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রাম আইডি হ্যাক করতো এক সময়। তবে এখন এত কষ্ট করতে হচ্ছে না। আরও সহজ হয়ে গেছে ওরিজিনাল কন্টেন্ট পাওয়ার পদ্ধতি।

মূলত ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকরাই এই চক্রটিকে নতুন নতুন কন্টেন্ট দিত। অর্থাৎ সুসময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তারা ক্যামেরাবন্দি করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে নেশায় তুলে দিত। মার্ক তার অ্যাডমিনদের ফেসবুক থেকে ছবি নিয়ে ও মিউজিক বসিয়ে ৩০-৪০ সেকেন্ডের ভিডিও বানিয়ে গ্রুপগুলোতে আপলোড করত। এ প্রমো দেখে যারা ফুল ভার্সন দেখতে চায়, তাদের এক থেকে দুই হাজার টাকা খরচ করতে হয়।

মার্ক ওরফে সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেজের অ্যাডমিনদের আসল পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে। দেখা যায়, তাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা ও নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া। মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করে। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার সহযোগী জসীমকেও।

সিআইডি প্রধান বলেন, সায়েম ও মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়- এই অ্যাডাল্ট গ্রুপগুলোর অ্যাডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। ফলে তাদের গ্রেপ্তারে বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেট টুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় গুরুত্বপূর্ণ অ্যাডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তুর্য ওরফে মারুফ ও মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সর্বমোট ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।

মার্ক-সাকারবার্গ এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। আর সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও ও প্রায় ৩০ হাজার কন্টেন্ট রয়েছে। অন্যদিকে মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা ফি দিয়ে তাদের প্রিমিয়াম গ্রুপের সদস্য হয়েছেন দেশ-বিদেশের প্রায় সাড়ে ৭০০ মানুষ। আমরা তাদের বিস্তারিত পরিচয় পেয়েছি। তাদের নিয়েও কাজ করছি। তরুণীদের অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট কেনা-বেচার সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

এ ঘটনায় মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়ে তদন্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সিআইডি প্রধান। এতে করে টেলিগ্রাম চক্রের হোতাদের পাশাপাশি তাদের দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সবাইকে সচেতন করে মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ভুক্তভোগী তরুণীদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, একান্ত মূহূর্তের ভিডিও আদান-প্রদান করে তারা ভুল করেছে। পরে বিপদে পড়লে নির্ভরযোগ্য কাউকেই তারা পাশে পায়নি। এছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তারা কোনো আইনের আশ্রয় নিতে পারেনি। সংকট ক্রমে বেড়ে বেড়ে মহীরুহ হয়ে গেছে।

মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, অভিভাবকদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে সন্তানের ভুলে তাকে একা করে না দিয়ে পাশে থাকুক, আইনের আশ্রয় নিন। অপরাধী যত শক্তিশালী হোক না কেন আমরা তাকে আইনের আওতায় আনবো।

আরও পড়ুন:বিআরটিএর সার্ভার হ্যাক করে কোটি টাকা আত্মসাত, গ্রেপ্তার ৬

বাংলাদেশ জার্নাল/ সুজন

  • সর্বশেষ
  • পঠিত