মক্কা যেভাবে ইসলামবিরোধীদের ঘাঁটি থেকে ইসলামের তীর্থস্থানে পরিণত হলো
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫১ আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫৬
ইসলামের ইতিহাসে রমজানের মাসে ঘটেছে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হলো ফাতাহ-এ-মক্কা বা মক্কা বিজয়। এর মাধ্যমে আরব উপ-দ্বীপ একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায়। আর এর পরই মূলত ইসলামের বিশ্বজয়ের যুগের সূচনা হয়। তাই মক্কা বিজয় ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রাক-ইসলামিক যুগে মক্কার গুরুত্ব
বর্তমানে আরবের প্রধান শহর মক্কা ইসলামি বিশ্বের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কেন্দ্র। ওলন্দাজ প্রাচ্যবিদ ডোজি লিখেছেন, মক্কার ইতিহাস শুরু হয় হজরত দাউদের সময় থেকে। তাওরাত (ইহুদিদের পবিত্র গ্রন্থ তোরাহ) এবং ইঞ্জিলেও (বাইবেল) এর উল্লেখ রয়েছে।
হযরত ইব্রাহিম (আব্রাহাম) মিশর থেকে ফিলিস্তিনে আসার পর তাকে মক্কার উদ্দেশে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। স্ত্রী হজরত হাজরা ও পুত্র হজরত ইসমাইলকে নিয়ে মক্কায় আসেন তিনি। কথিত আছে তিনি মক্কায় খানা-এ-কাবার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। খানা-এ-কাবা সেই ভবনের উপর নির্মাণ করা হয়েছিল যা প্রাচীনতম ভবনের মধ্যে একটি বলে মনে করা হয়। বহু শতাব্দী ধরে নানান সমস্যায় ভারাক্রান্ত মানুষেরা সেখানে আসতেন মনস্কামনা পূরণ করতে। হযরত ইব্রাহিম (আব্রাহাম) ওই ভবনের ভিত্তির উপরই খানা-এ-কাবা পুনর্নির্মাণ করেন।
আরব উপত্যকার অধিবাসীরা সর্বদাই নিজেদের আল-আরব বা আরব উপদ্বীপের অধিবাসী বলে পরিচয় দিতেন। এর সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে এদের অধিকাংশই ছিলেন মরুভূমির যাযাবর যাদের বেদুইন বা বেদু বলা হয়।
প্রাক-ইসলামিক যুগে সমাজ বেদুইন সম্প্রদায় বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী এবং জাতিতে বিভক্ত ছিল। এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব শাসন ও রীতিনীতি ছিল। ‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইসলাম’ অনুযায়ী প্রাক-ইসলামিক যুগে বিভিন্ন ছোট ছোট নগররাষ্ট্র ছিল। যদিও এগুলি রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত বা একীভূত অঞ্চল ছিল না। তবে ইসলামের নবীর জন্মের আগেই মক্কা বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। কেন্দ্রীয় স্তরে পথপ্রদর্শকের আখ্যাও পেয়েছিল মক্কা।
‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইসলাম’ বলছে, দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। আর অন্যদিকে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল মক্কা। এছাড়া মক্কার গুরুত্বের অন্যতম কারণ ছিল বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘর, কাবা ঘর)। কুরাইশ সম্প্রদায়ের বণিকরা ইয়েমেন থেকে সিরিয়ায় যাতায়াত করতেন। বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত জিনিস এনে সেগুলি বিক্রি করতেন মক্কায়। এছাড়া প্রতি বছর মক্কায় একটি বড় মেলা হতো যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পাশাপাশি ক্রীতদাসও কেনাবেচা চলতো।
‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইসলাম’ অনুযায়ী, মক্কার গুরুত্ত্ব বোঝা যেত পবিত্র মাসগুলিতে। প্রতি বছর মক্কায় সেই সময় বহুলসংখ্যক মানুষের ঢল নামত। আর মক্কাবাসীরা বিখ্যাত ছিলেন তাদের আতিথেয়তার জন্য। বায়তুল্লাহর অতিথি মনে করে সেখানে আসা মানুষদের যথাসম্ভব সেবা করতেন মক্কাবাসীরা। একই ভাবে অতিথিরাও সম্মান করতেন মক্কাবাসীদের।
মক্কা ও হুদাইবিয়া বিজয়ের আগের ঘটনাবলী
হযরত মোহাম্মদের (সাঃ) মদিনায় হিজরতের পর মক্কাবাসীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধ লড়েছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, সেময় ইসলাম বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মক্কা। ওই আন্দোলনে মূলত সামিল ছিলেন কুরাইশ সম্প্রদায়ের মানুষ। এই পরিস্থিতিতে এক জুলকাদায় (ইসলামিক ক্যালেন্ডারের ১১তম মাস) ছয় হিজরির (৬২৮ খ্রী) ইসলামের নবী এবং তার সহচররা জিয়ারত (দর্শন) এবং ওমরাহর (হজের সংক্ষিপ্ত রূপ) জন্য রওয়ানা হন। এই ধর্মীয় সফরে আহরাম (বিশেষ কাপড়) পরিধান করেছিলেন তারা।
আরবদের ঐতিহ্য ছিল কোনো ব্যক্তি আহরাম বেঁধে মক্কায় এলে তাকে বাধা দেয়া হতো না এবং এই প্রথা কিন্তু শত শত বছর ধরে চলে আসছিল। মক্কার নয় মাইল আগে রয়েছে হুদাইবিয়ার। সেখানে পৌঁছে হযরত মুহম্মদ মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায়ের কাছে বার্তা পাঠান। তিনি জানিয়েছিলেন, তাদের আগমনের উদ্দেশ্য বায়তুল্লাহ। তারা যুদ্ধের জন্য আসেননি। তাদের বাধা দিতে উরওয়া ইবনে মাসউদকে পাঠিয়েছিল কুরাইশ সম্প্রদায়। সেই উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয়নি।
পরবর্তীকালে হযরত উসমান বিন আফফানকে (ইসলামের তৃতীয় খলিফা) মক্কার অভিজাতদের সাথে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রথমে তাকে বন্দী করা এবং তারপরে হত্যার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে হযরত মুহম্মদ প্রতিশোধ নেয়ার ‘বাইত’ বা শপথ নেন। সেই শপথ ‘বাইত-ই-রিজওয়ান’ নামে বিখ্যাত। বিষয়টি জানতে পেরে কুরাইশ সম্প্রদায়ের মানুষেরা বার্তা পাঠান হযরত উসমান বেঁচে আছেন এবং সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছেন। একইসঙ্গে তাদের অনুরোধ করেন এই বছর ফিরে যাওয়ার। হযরত মুহাম্মদ এবং তার সঙ্গীদের বার্তা পাঠিয়ে বলা হয় তারা যেন পরের বছরে আবার আসেন খানা-ই-কাবার জিয়ারত ও ওমরাহ করতে। সে সময় মক্কা তিন দিনের জন্য খালি করে দেয়া হবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। যাতে কোনওরকম সংঘাতের সম্ভাবনা না থাকে।
এই প্রস্তাবগুলি লিখিতভাবে দেয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল আরও কিছু শর্ত। এটি সুলহ-হুদাইবিয়া বা হুদাইবিয়া চুক্তি হিসাবে পরিচিত। চুক্তির বেশ কিছু শর্ত মুসলমানদের বিরুদ্ধে হলেও কোরআনে এই চুক্তিকে ফাতেহ-ই-মুবীন (স্পষ্ট বিজয়) বলে অভিহিত করেছে।
মক্কা বিজয়
দাইবিয়া চুক্তির পর এক বছর হতে না হতেই এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার ফলে কুরাইশ সম্প্রদায় এই চুক্তি ভঙ্গ করার ঘোষণা করে। ১০ রমজান ৮ হিজরির (৬৩০ খ্রিস্টাব্দ) হযরত মুহাম্মদ তার সঙ্গীদের নিয়ে মক্কার উদ্দেশে রওয়ানা হন। মদিনা থেকে যাওয়ার সময় তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় সাত হাজার। সফর চলাকালীন অন্য উপজাতির লোকজনও এই দলে যোগ দেন। এই ভাবে তাদের সংখ্যা দশ হাজারে পৌঁছায়।
মক্কা প্রবেশের দশ মাইল আগে তারা এক জায়গায় থামেন। মক্কার কুরাইশ সম্প্রদায় এই বিশাল সংখ্যক মানুষের আগমনের খবর পেয়ে তাদের প্রধান নেতা আবু সুফিয়ান হযরত মুহাম্মদের কাছে পৌঁছান এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ইতিমধ্যে চতুর্দিক থেকে মুসলমানরা মক্কায় প্রবেশ করেন এবং এর ফলে মক্কাবাসীদের জন্য বাইরে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
কিছু মানুষ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এই সংঘর্ষে ৩৩-৩৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০ রমজান, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ইসলামের নবী খানা-এ-কাবা পৌঁছান। মক্কাবাসীদের সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘তোমরা সকলে মুক্ত। আজ তোমাদের কেউ প্রশ্ন করবে না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি পরম দয়ালু।’
প্রসঙ্গত, কুরআনের সূরা (অধ্যায়) ফতাহতে হুদাইবিয়ার চুক্তিকে পূর্ণ বিজয় হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
মক্কা বিজয়ের ফলে কীভাবে ইসলামের প্রসার ঘটে?
মক্কা বিজয়ের পর মানুষের মন থেকে কুরাইশ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি থাকা ভীতি দূর হয়ে যায়। সে বিষয়ে দাইরা মা'আরিফ-এ-ইসলামিয়া (ইসলামিক এনসাইক্লোপিডিয়া)-তে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরাইশরা ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আরব ও গোত্রের একটি বড় দল মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন।
‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইসলাম’ অনুযায়ী, মক্কার বিজয় এবং হুনিয়ান যুদ্ধে জেতার অর্থ হলো মুসলমানদের বিরোধিতা করতে পারে এমন কোনও শক্তিশালী উপজাতি আর নেই। এইভাবে হযরত মুহাম্মদকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী পথপ্রদর্শক হিসাবে সম্মানিত করা হয়েছিল।
‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইসলাম’-এ বলা হয়েছে, আরবরা ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং সেই কারণে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন। সুতরাং এই বিষয়টা স্পষ্ট যে মক্কা বিজয় আরব অঞ্চলকে পথ দেখিয়েছিল। এই জয়ের আধার গোত্রীয় আনুগত্য বা সামাজিক অবস্থান ছিল না। এই জয়ের ভিত্তি ছিল ধর্মীয়। আরব যোদ্ধারা, যারা এতদিন পারস্পরিক যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতেন তারা এখন একজন পথপ্রদর্শক নেতৃত্বে এবং একটি ধর্মকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন।
‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইসলাম’ অনুযায়ী, এর ফলে এমন একটি সম্প্রদায়ের জন্ম হয়েছিল যেখানে কিছু মানুষ দীর্ঘকাল পর শান্তি খুঁজে পান অন্যদিকে কিন্তু পারস্য ও রোমের শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে।
ওই বইটিতে বলা হয়েছে, জয়ের এই ধারাবাহিকতা শুরু হয় একটি বিশেষ কারণে। এর উদ্দেশ্য ছিল আরব যোদ্ধারা যাতে তাদের শক্তি আরব উপদ্বীপের শান্তি বিঘ্নিত করতে নষ্ট না করেন। সংগঠিত আরব গোষ্ঠী ইসলাম প্রচারে সহায়তা করেন।
‘দ্য কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইসলাম’ অনুযায়ী, হযরত মুহাম্মদ সম্ভবত মক্কা বিজয়ের অনেক আগেই অনুমান করেছিলেন যে, একটা সময় আসবে যখন আরব উপদ্বীপে খুব কম সংখ্যক অন্য ধর্মের মানুষ অবশিষ্ট থাকবেন। এই পরিস্থিতিতে ইসলাম ধর্মকে আরব উপদ্বীপের সীমানা পেরিয়ে ইরাক ও সিরিয়ার দিকে প্রসার করতে হবে। এর জন্য প্রশাসনিক দক্ষতা সম্পন্ন মানুষের প্রয়োজন হবে বলেও অনুমান করেছিলেন তিনি।
মক্কায় এমন অনেক মানুষ ছিলেন যাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশে যাওয়া মরুযাত্রী দল সংগঠিত করার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ছিল। নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ সম্ভব করেছিলেন যে প্রশাসকেরা তাদের সঙ্গে মক্কা, মদিনা এবং তায়েফ-সহ হিজাজ অঞ্চলের তিনটি শহরের সঙ্গে ছিল।
এভাবে মক্কা বিজয়ের পর মুসলমান ধর্ম গ্রহণকারী এবং তাদের বংশধরেরা ইসলামি শিক্ষাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেন। ওই বংশধরদের মধ্যে কেউ ছিলেন মুজাহিদ, সৈনিক ও উলেমা। এরা ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও আফ্রিকায় ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটান। হযরত মুহাম্মদের মৃত্যুর পর, মদিনার রাজধানীর মর্যাদা বজায় থাকে, তবে হজের কারণে মক্কা ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও শিক্ষাকেন্দ্রের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে রয়ে যায়।
বনু উমাইয়ার সময়ে, ইসলামিক বিশ্বের কেন্দ্র মদিনা থেকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মক্কা ও মদিনার কেন্দ্রীয় মর্যাদা বজায় ছিল। আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মেটাতে বহু দূর থেকে মানুষ সেখানে আসতেন।
মক্কার কেন্দ্রীয় ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা আজও অক্ষুণ্ণ। প্রত্যেক মুসলমান খানা-এ-কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েন।
সূত্র: বিবিসি
বাংলাদেশ জার্নাল/এসএস