ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৬ মিনিট আগে
শিরোনাম

৪৭ বছরে গৌরবের অর্জন : স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০১৮, ০২:১৩  
আপডেট :
 ২৭ মার্চ ২০১৮, ০২:১৮

৪৭ বছরে গৌরবের অর্জন : স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল

দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। অর্থনীতির আকারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৪৩, আর ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় বিশ্বের ৩৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। এই উন্নয়ন এখন বিশ্বস্বীকৃত। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর সামনে রেখে দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার কর্মসূচী ‘রূপকল্প-২১’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে। বাংলাদেশের এই অর্জনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদায় পৌঁছাতে একটি ভিশন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার হাঁটছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর গরিব জাতি হিসেবে আমরা অনেক বদনাম সহ্য করেছি। বাংলাদেশের তখনকার আর এখনকার অবস্থা আসমান-পাতাল। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পাওয়ায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে আমরা পারি। আমরা নিচে ছিলাম। এখন ওপরে উঠছি। আরও ওপরে উঠব। তিনি বলেন, একসময় আমরা অন্য দেশের অনুদান নিতাম। উন্নত দেশে পরিণত হয়ে ২০৪১ সাল থেকে আমরা বিভিন্ন দেশকে অনুদান দেব।

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সহমত পোষণ করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু নিজেদের টাকায় করার ঘোষণায় বাংলাদেশের মর্যাদা দেশে এবং বিদেশে অনেক উচ্চতায় উঠেছে। একইভাবে তিনি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা করেছেন। এতে করে দেশের মর্যাদায় আরও একটি উজ্জ্বল পালক সংযোজিত হচ্ছে। তবে এই অর্জনে বেশ দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি, দুর্নীতিরোধ, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো চ্যালেঞ্জ সরকারের সামনে রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পর্যায়ের অর্জন ধারাবাহিকভাবে এসেছে। বিশেষ করে বিগত ৮-১০ বছরে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর অপরদিকে জনগণের পরিশ্রমের কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। এখন এই অগ্রগতিকে সুসংহত ও ত্বরান্বিত করা জরুরী হয়ে পড়ছে। উন্নয়নের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখা ও বেগবান করার ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে।

এদিকে জাতিসংঘ মনে করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে। অর্জিত সাফল্যকে ধরে রাখতে ও আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে সমন্বিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে উদ্ভাবনীমূলক কার্যক্রম, উৎপাদনশীলতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সুশাসন অগ্রগতি, বৈষম্য বিলোপের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী বলে মনে করে জাতিসংঘ। সূত্রগুলো বলছে, দেশ স্বাধীনের পরই সোনার বাংলা গড়ার কাজ শুরু করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এদিকে পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাতে হোঁচট লাগে।

তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর গত এক দশকে দেশের বৃহত অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের ব্যাপক বিনিয়োগ বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশ শুধু অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকেই অগ্রগতি অর্জন করেনি, প্রভাবশালী শক্তির সঙ্গে দর-কষাকষির সক্ষমতা অর্জন করেছে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয় এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংকের খবরদারির মুখে সংস্থাটিকে বিদায় দিয়ে নিজের অর্থেই ৩০ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে বাংলাদেশ। দুই দশক আগে বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মিত হয়েছে যমুনা নদীতে। স্বাধীনতার পর বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার, সেই দেশ আগামী অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করছে।

শুধু তাই নয়, এখন এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকায় নির্মাণ করছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ হতে যাচ্ছে আগামী মাসেই। বিশ্বেও তৃতীয় উচ্চতম ১৩০ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগও নিয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল মেট্রো রেল নির্মাণ ও একসঙ্গে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার পরিচয় বহন করে। ৪৭ বছর আগের উদ্যোক্তাশূন্য বাংলাদেশে এখন লাখো উদ্যোক্তা। বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে উঠছে বৃহত শিল্প-কারখানা। তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষস্থানে বাংলাদেশ। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশের ১৬ কোটি মানুষের চাহিদার বড় অংশই পূরণ করছে বেসরকারী খাত। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানে বাংলাদেশের নাম লেখিয়েছে কৃষকরা। আয়তনে বিশ্বের ৯৪তম হয়েও সবজি উৎপাদনে তৃতীয় এবং ধান, মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ শীর্ষ অবস্থান বাংলাদেশের।

১৯৭২-৭৩ সালে যেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯৯ দশমিক ৩০ লাখ টন, এখন তা পৌঁছেছে ৩৪৭ লাখ টনে। শিশুমৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুহার, স্যানিটেশন ব্যবস্থা, মানবসম্পদ উন্নয়নসহ সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের চেয়ে ভাল অবস্থায় রয়েছে। শুধু তাই নয়, দারিদ্র্যের হার ৮৮ শতাংশ থেকে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। আমদানির পরিমাণ ২২৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা থেকে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকায়। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ২৬০ কোটি টাকা, এখন বেড়ে হয়েছে দুই লাখ ৮২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। মাত্র ৮০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স ৪৭ বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৭৭ কোটি ডলারে। দুই কোটি ডলারের রিজার্ভ এখন তিন হাজার ৩৩৭ কোটি ডলার। স্বাধীনতার পর প্রথম অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ, এখন ৭.২৮ শতাংশ।

তবে এই উন্নয়নযাত্রাকে টেকসই করতে মানবসম্পদের উন্নয়ন ও সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য কমানোসহ বেশ কিছু বিষয়ে জোর দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রাণশক্তি। এদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীনতার পর পর ধনী-দরিদ্র্যের সম্পদের বৈষম্য ছিল ২.৪ শতাংশ, এখন তা দ্বিগুণ হয়েছে। এ বৈষম্য কমাতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অর্থপাচার ও দুর্নীতি বন্ধ করে দেশেই বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জনই করেছিলাম উন্নতি করার জন্য। বিশ্বদরবারে দেখিয়ে দেয়ার জন্য যে বাংলাদেশ বহু দিন নির্যাতিত ছিল, কিন্তু এরা মেধাবী এবং কর্মক্ষম জাতি। সেটা যে আমরা কাজে প্রমাণিত করতে পেরেছি, এটাই এখন সবচেয়ে বড় আনন্দের।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রভাব মোকাবেলায় সরকার এক বছর আগে থেকেই কাজ শুরু করেছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশে দ্রুতহারে দারিদ্র্য হার কমার মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট যে বৈষম্য কমাতে সরকারের নেয়া নীতি কাজ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের মর্যাদায় আসীন হবে বাংলাদেশ।

এদিকে স্বাধীনতার ৪৭ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ বেড়েছে। ১৯৭১ সালের পর এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১০০ ডলারের কাছাকাছি। এখন তা ১৬১০ ডলার। শুধু মাথাপিছু আয় নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। মানুষের গড় আয় বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৩ বছর। আর্থ-সামাজিক সূচকে জাতিসংঘের নির্ধারিত মান অর্জন করায় স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১৭ সাল শেষে এ দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১৪৯৬ ডলারে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে তা আরও বেশি। বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের খানা আয়-ব্যয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখানে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১৬১০ ডলারে। স্বাধীনতার বছর দেশের ৮০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। সর্বশেষ হিসাবে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ১৯৭১ সালে গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছরের একটু বেশি। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে তা প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে। একসময় খাদ্য আমদানি করতে হতো। এখন জনসংখ্যা বাড়লেও এবং চাষযোগ্য জমি কমলেও খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে না। অর্থনীতিতে কৃষির চেয়ে শিল্পের অবদান বাড়ছে। বাড়ছে সেবা খাতের কার্যক্রম। তিনি বলেন, সামাজিক অনেক সূচকেও বাংলাদেশ ভাল করেছে। বিশ্ব মন্দার মধ্যেও ছয় শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। তবে এখনও আরও ভাল করতে হবে। সেজন্য শ্রমের দক্ষতা ও সরকারী বিনিয়োগের গুণগত মান বাড়াতে হবে। অবকাঠামোতে আরও উন্নয়ন দরকার। জ্বালানি খাতে উন্নতি হলেও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।

প্রসঙ্গত, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা-এ তিনটি সূচকের দুটিতে উত্তীর্ণ হলে কোন দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই যোগ্য বিবেচিত হয়েছে। আগামী ছয় বছর এর যে কোন দুটি সূচকে জাতিসংঘের মানদ- ধরে রাখতে পারলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হবে। মানবসম্পদ সূচকে পাঁচটি বিষয়ের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নেয় জাতিসংঘ।

/এসকে/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত