সাক্ষাৎকারে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম
ছলনা নিজেদের সাথেই করলাম?
কিরণ সেখ
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২১:৫০ আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২৩:০০
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক), সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান ও ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ একজন নেতা। জোটের তিনি নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করায় বিএনপি অনেকটাই কোনঠাঁসা। আবার আন্দোলন শুরুর কথা বলছেন দলটির নেতারা। এছাড়া আন্দোলন, জাতীয় ঐক্য ও ২০ দলীয় জোটের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনাসহ নানা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ জার্নালের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কিরণ সেখ।
বাংলাদেশ জার্নাল: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের ভরাডুবির কারণ কি?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: নির্বাচনে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের ভরাডুবির উত্তর যদি বলতে যাই তাহলে আমাকে দুটি ব্যতিক্রমী কথা বলতে হবে। এক হচ্ছে, নির্বাচনটা আদৌ অনুষ্ঠিত হয়েছে কী না? আমার মতে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। কারণ ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হবে বলে তারিখ ঠিক করা ছিল। কিন্তু আমরা সরেজমিনে দেখতে পেলাম, নির্বাচন ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পর শুরু হলো এবং সেটা ৩০ তারিখ ভোর ৩টা-৪টা পর্যন্ত চলেছে। এই সময় তারা (আওয়ামী লীগ) তিন ভাগের দুই ভাগ ভোট মেরে রেখেছে। অতএব যদি নির্বাচন হতো, যদি ৩০ তারিখে নির্দিষ্ট সময়ে জনগণ ভোট দিতে পারতো, তাহলে নিশ্চিত সেখানে বিএনপির ভরাডুবি হতো না, বরং অবশ্যই জয়ী হতো। সুতরাং আমরা চ্যালেঞ্জ করলাম, ভরাডুবি হয়নি। তবে যে কোন নির্বাচনে একটি পরাজয়ী পক্ষ থাকবে এবং আরেকটি বিজয়ী পক্ষ থাকবে। এটাকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি। সুতরাং আগামীতে সুন্দরভাবে আরেকটি নির্বাচন হলে সেখানে কে বিজয়ী হয় আর কে পরাজিত হয় সেটা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি। ওই নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হবে না। কারণ আমি মনে করি, বিএনপির ভরাডুবি কখনো হয়নি, আর কখনো হবে না বলেও আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু সাংবাদিক ভাইয়েরা প্রশ্ন করতেই পারেন যে, অভ্যন্তরীণ কোন কারণ আছে কি না বা কোনো দুর্বলতা ছিল কিনা? আমি বলবো বিএনপির দুর্বলতা নয়। যেগুলো হয়েছে সেটা সরকার কর্তৃক সৃষ্টি করা পরিবেশ ও পরিস্থিতি। যেখানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলখানায় এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে। সেখানে দূর থেকে দলকে পরিচালনা করতে সুবিধা ও অসুবিধা থাকেই। এর একটা প্রভাব নির্বাচনে পড়তেও পারে।
বাংলাদেশ জার্নাল: জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে বিএনপির নতুন জোট গঠন নিয়ে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের দ্বিমত ছিল বলে শোনা যাচ্ছে। জোটের অনেক শীর্ষ নেতা এখন প্রকাশ্য একথা বলছেন। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: লক্ষ্যবস্তু ঠিক না করে কোনো ঐক্যে যাওয়া একটা প্রশ্ন সাপেক্ষ বিষয় হয়ে যায়। সেটা করলে তখন প্রশ্ন আসে যে- কার জন্য ঐক্য, কিসের জন্য ঐক্য, কাকে নিয়ে ঐক্য এবং কতদিনের ঐক্য। এ কথাগুলোর উত্তর সুস্পষ্টভাবে আসেনি। যদি একটি প্রশ্ন উঠে যে, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিএনপি ও তাদের শরীকদের জন্য একটি দাবি আদায় করে আনবো, এরপর নির্বাচনে যাবো, এই লক্ষ্যেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সৃষ্টি হয়েছিল? নাকি বিএনপি ও তাদের শরীকরা নির্বাচনে যাক, শেষদিন পর্যন্ত নির্বাচনে থাকে এই বন্দোবস্তটি করার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আবেদন নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট সৃষ্টি হয়েছিল? এটা এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ঐক্যফ্রন্টের সকলের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সুসম্পর্ক রাখি, তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও শুভেচ্ছামুখী। অতএব আপনার প্রশ্নের উত্তরটি বিশদ আলোচনার দাবি রাখে যেটা এখানে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ জার্নাল: আপনি বলছেন, ঐক্যে গঠনের বিষয়ে লক্ষ্যবস্ত ঠিক ছিল না। তাহলে এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থাকা উচিত কি না?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: ঐক্য জাতীয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সব সময় একটি কাম্য বিষয় এবং স্বাগত বিষয়। ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রাক্কালেও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি নির্বাচনী জোট হয়েছিল তিনটি নিবন্ধিত দল এবং একটি অনিবন্ধিত দল নিয়ে, সেই জোটের নাম ছিল যুক্তফ্রন্ট, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি সেটার শরীক ছিল। নির্বাচনের পরে সেটি আর সক্রিয় বা কার্যকর থাকেনি। আলোচনায় বিষয় হচ্ছে, ঐক্যের লক্ষ্যটা কি এবং কার কার সঙ্গে ঐক্য? কারণ যে শর্তগুলো নিয়ে ঐক্য করা হয়েছিল এবং যেসব দাবিগুলো বলা হয়েছিল, সেখানে একবারও বলা হয়নি যে- যদি দাবি মানা না হয় তাহলে আমরা নির্বাচনে যাবো না। তাহলে প্রতারণা, ছলনা বা ওয়াদা ভঙ্গ কি আমরা আমাদের সঙ্গেই করলাম? না কি আমরা জনগণের সাথে করলাম?
বাংলাদেশ জার্নাল: একাদশ সংসদ ভোটের মনোনয়ন নিয়ে ২০ দলীয় জোটের নেতা অভিযোগ করেছেন যে, মনোনয়নের বিষয়ে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টকে গুরুত্ব দিয়ে জোটকে অবমূল্যায়ন করেছে। এ বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: এ অভিযোগের মধ্যে আংশিক বাস্তবতা আছে। আর এটা আলোচনারও বিষয়। এই রূপ হওয়াটা কোনোদিনই কাম্য ছিল না। কারণ আসন বণ্টন নিয়ে ২০ দলে প্রকাশ্য কোন আলোচনা হয়নি। আমার জানা মতে, জোটের দলগুলোর সাথে আলাদাভাবে আনুষ্ঠানিক কোন আলোচনা হয়নি। কিন্তু ফ্রন্টের দলগুলোর সাথে এব্যাপারে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। যাহোক, মূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন প্রক্রিয়াটি আপেক্ষিক বা তুলনামূলক। অতএব আমি এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না।
বাংলাদেশ জার্নাল: নির্বাচনের আগে শোনা যাচ্ছিল যে, কল্যাণ পার্টি ২০ দল থেকে বের হয়ে যাবে। এখনও কি সেই সম্ভবনা রয়েছে?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: কল্যাণ পার্টি ২০ দলীয় জোটের আর্দশকে বিশ্বাস করেই এখন পর্যন্ত টিকে আছে। আমরা জাতীয়তাবাদী শক্তিতে ঈমান রাখি, আস্থা রাখি। আমরা জাতীয়তাবাদী শক্তিকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই এবং আমাদের যথাসাধ্য অবদান দিয়ে শক্তিশালী করতে চাই।
বাংলাদেশ জার্নাল: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জোটের ব্যানারে বড় কোন কর্মসূচি দেখা যায়নি। এটা কি কৌশলগত কারণে, নাকি জোটের সাংগঠনিক দুর্বলতা?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্ব বিএনপির হাতে। যেমন ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব বিএনপির হাতে না, সেটা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের হাতে। সেখানে একটা স্টিয়ারিং কমিটি আছে। কিন্তু ২০ দলীয় জোটের কোন স্টিয়ারিং কমিটি নেই। ২০ দলের নেতা বিএনপি এবং জোটের নেতাও যিনি বিএনপির নেতা তিনি। যেকোন কারণে হোক ২০ দলে স্টিয়ারিং কমিটি করা হয়নি। আর গত এক বছর বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে আমরা সমর্থন দিয়েছি। কিন্তু বিএনপি ব্যতীত আসলে কোন ২০ দলীয় জোট দাঁড়াতে পারে না, তথা মুশকিল। অতত্রব সেখানে আলাদা করে জোটের অনুষ্ঠান করা কঠিন। কিন্তু বিএনপির কর্মসূচিগুলো কি ছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, অনশন ও গণঅনশন ইত্যাদি, যেগুলোর সবকিছুতেই আমরা অংশীদার ছিলাম, উপস্থিত ছিলাম। আমরা ছোট ছোট দলগুলো আলাদা অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু আমাদের উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় সমাবেশ করা মুশকিল। এটা ছাড়া সবগুলো আমরা করেছি। আর ভবিষ্যতেও সুযোগ হলে করবো। কিন্তু মূল চালিকা শক্তি বিএনপি। এটা আমাদের বলতে কোন শরম নেই। আনন্দের সাথে এটা বলবো।
বাংলাদেশ জার্নাল: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০ দলীয় জোটের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা কি?
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: ২০ দলীয় জোটকে স্বতন্ত্রভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। জোটের আকার ঠিক করতে হবে। অর্থ্যাৎ সংখ্যা ও গুণগত মান- উভয়ের ভেতরে একটা ভারসাম্য আনতে হবে। এছাড়াও, একটি স্টিয়ারিং কমিটি করতে হবে এবং সেই স্টিয়ারিং কমিটিকে কার্যকর ক্ষমতা দিতে হবে। নির্বাচনের দুই মাস আগেই প্রস্তাব হয়েছিল এলডিপি সভাপতি কর্ণেল অলি আহমদ বীর বিক্রমকে ২০ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক বানাতে, অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্ণেল অলি দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন। এখন নির্বাচনের পরেও এটা যেন বহাল থাকে সেটা সমর্থন করি। সর্বপরি প্রধান শরিক দলের দেহ, কাণ্ড ও আকৃতিসহ সব কিছু প্রয়োজনীয় পুর্নগঠন করতে হবে। কারণ শরিক দল যদি পুর্নগঠিত হয় তাহলে জোট আপনি আপনি বেগবান হবে।
বাংলাদেশ জার্নালের পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম: আপনাকে ও বাংলাদেশ জার্নালের পরিবারের সবাইকে ধন্যবাদ।