ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

১১তম গ্রেড সহকারী শিক্ষকদের দাবী নয় অধিকার

  মাহফিজুর রহমান মামুন

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০১৯, ১৬:৪১

১১তম গ্রেড সহকারী শিক্ষকদের দাবী নয় অধিকার

সিঙ্গাপুরে একটি কথা প্রচলিত আছে ‘যদি উদীয়মান ব্যাঘ্র হতে চাও তবে প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ কর’। সেই কথাটি শুধু কথায় নয় বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন বলে আজকে মাত্র ৭২১.৫ বর্গ কিলোমিটারের একটি ছোট্ট দেশ সিঙ্গাপুরকে দেখুন, তারা আজ কত উন্নত! সিঙ্গাপুর স্বাধীন হওয়ার কিন্তু খুব বেশিদিন হয়নি। ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয় এবং আমাদের দেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়। আমাদের দেশের থেকে মাত্র ৬ বছর আগে সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয়েছিল এবং আয়তন ও জনসংখ্যায় আমরা ওদের থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। তারপরও আজ সিঙ্গাপুর উন্নত দেশের কাতারে অন্যদিকে আমরা এখনো উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।

এটা কেন হয়েছে জানেন? সিঙ্গাপুর উন্নত দেশের মর্যাদা আদায়ের জন্য তাদের দেশের জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করেছিল। আর এই জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য তারা সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিল। তাদের মতামত হচ্ছে একজন নাগরিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ নাও পেতে পারে কিন্তু প্রতিটি নাগরিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবশ্যই অধ্যয়নের সুযোগ পাবে।

তাই সিঙ্গাপুর তাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে এমনভাবে সাজিয়েছে যে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পরে একজন নাগরিক উচ্চ শিক্ষা অর্জনের আর সুযোগ না পেলেও সেদেশের জনসম্পদে পরিণত হতে বাধ্য। সিঙ্গাপুর সেদেশের সেরা মেধাবীদেরকে উন্নত বেতন-পদমর্যাদা দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত করেছিল। সেদিন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে গিয়ে সেদেশের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করলাম যার নাম এডমিরালিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

সেই বিদ্যালয়টির অবকাঠামো,সিলেবাস,পারিপাশ্বিক অবস্থা এত উন্নত যে আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তা ভাবাই যায় না। তাইতো বলি ৭২১ বর্গ কিলোমিটারের একটা ছোট্ট দেশের হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য কেন আমাদেরকে এখনো ছুটে যেতে হয়? অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা এত নিম্ন যে কোন মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় না, যারা আসে তারাও লজ্জায় পালায় অথবা পালানোর চেষ্টা করে।

অথচ পৃথিবীতে যতগুলো উন্নত দেশ আছে সবগুলোতেই প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ার জন্য সেই দেশগুলোর সেরা মেধাবীরা সবসময় সচেষ্ট থাকে। প্রাথমিক শিক্ষা যেহেতু সকল শিক্ষার মূল তাই এই শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার কারণে আমাদের দেশের উন্নয়নের গতি এখনো মন্থর। প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাইতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রাজকোষে অর্থ না থাকা সত্বেও তিনি ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের জাতীয়করণ করেছিলেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু সকল শিক্ষকদের সমান মর্যাদা দিয়েছিলেন বলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে কোনরকম পার্থক্য রাখেননি। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের দেশও আজ সিঙ্গাপুরের মতই উন্নত হত।

প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা,জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি একযোগে ২৬০০০ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীকরণ করেছিলেন এবং প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদেরকে ২য় শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেখানে শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে গিয়ে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে কোন পার্থক্য রাখেননি সেখানে বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকদের চেয়ে ৪ ধাপ নিচের গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন উভয় প্রধান শিক্ষকরা এখন ১৬০০০ (১০ম গ্রেড) টাকা স্কেলে বেতন পাচ্ছেন (কোর্টের রায় অনুসারে)। অথচ সহকারী শিক্ষকরা এখন বেতন পাচ্ছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০২০০ টাকা (১৪গ্রেড), প্রশিক্ষণবিহীন ৯৭০০(১৫গ্রেড) টাকা স্কেলে যা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের আসল কারিগর সহকারী শিক্ষকদের জন্য একটি নির্মম কৌতুক। অথচ পদ অনুসারে প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেডে অর্থাৎ ১১তম গ্রেডে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন উভয় সহকারী শিক্ষকদের বেতন পাওয়ার কথা।

প্রধান শিক্ষকদের পরের গ্রেডে বেতন পাওয়ার জন্য সহকারী শিক্ষকরা অনেকদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিল এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৩শে ডিসেম্বর শহীদ মিনারে আমরণ অনশন শুরু করেছিল। তৎকালীন গণশিক্ষামন্ত্রী তখন সহকারী শিক্ষকদের দাবী যৌক্তিক বলে তা পূরণের ওয়াদা করে অনশন ভাঙ্গান। কিন্তু দাবী পূরণ আর করা হয়নি। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সহকারী শিক্ষকদের দাবী পূরণের আশ্বাস দিলে সহকারী শিক্ষকরা আবারও আশায় বুক বাধে এবং ভোটের আগে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানায়। সহকারী শিক্ষকরা বিশ্বাস করে যে জননেত্রী নিজে প্রাথমিক শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন সেই জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। তিনি অবশ্যই প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবী পদ অনুসারে প্রধান শিক্ষকদের পরের গ্রেড অর্থাৎ ১১তম গ্রেড প্রদান করে বঙ্গবন্ধুর দেয়া মর্যা1দায় অধিষ্ঠিত করবেন।

তাছাড়া সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড প্রদান করলে সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে,মেধাবীরা এ পেশায় আকৃষ্ট হবে। মেধাবী শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জিত হবে এবং সেইদিন বেশী দূরে থাকবে না যেদিন আমাদের সোনার বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের চেয়েও উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা পাবে। পরিশেষে একথাই বলা যায় যে ১১তম গ্রেড প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের দাবী নয় বরং অধিকার।

লেখক: সহকারী শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • পঠিত