ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১২ মিনিট আগে
শিরোনাম

মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষকতা ছাড়ছে কেন?

  মাহফিজুর রহমান মামুন

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০১৯, ২০:১০

মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষকতা ছাড়ছে কেন?

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। সারা বিশ্বে অন্য যে কোনো পেশার থেকে শিক্ষকতা পেশার সম্মান ও মর্যাদা অনেক বেশি। সেটা বেতন ও পদমর্যাদা যে দিক দিয়েই হোক না কেন। একটি দেশ বিশ্বের মধ্যে কতটা এগিয়ে যাবে সেটা সেদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকদের প্রতি গুরুত্ব অনুধাবন করে বলে দেওয়া যায়।

কোন দেশের সেরা মেধাবীরা যদি সেরা বেতন-পদমর্যাদা পেয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসতে সচেষ্ট হয় তবে বুঝা যায় সেই দেশ অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বে উন্নত মর্যাদায় স্থান করে নিবে। শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদন্ড হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থার মূলভিত্তি প্রাথমিক শিক্ষা বলেই অধিকাংশ দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। সারা বিশ্বের মধ্যে যে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে উন্নত সেই ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ও বেতন পদমর্যাদা দেখুন। ফিনল্যান্ডে একজন প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন-পদমর্যাদা কিছু কিছু ক্ষেত্রে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের থেকেও বেশি।

সেদেশে সেরা ১০০জন মেধাবীকে শিক্ষকতা পেশার জন্য নির্বাচিত করা হলে সেই ১০০জনের মধ্যে সেরা ২০ জনকে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে হাইস্কুল,কলেজ ও সর্বশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আমাদের সার্কভুক্ত দেশ শ্রীলংকায় প্রাথমিক শিক্ষকরা ১ম শ্রেণির মর্যাদাপ্রাপ্ত। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ব্যাংকার ও অন্যান্য পেশার থেকে প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশার বেতন-পদমর্যাদা অনেক বেশি। তাইতো সেদেশে মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষক হতে আকৃষ্ট হয়।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও এটাই সত্য আমাদের দেশ অর্থনীতিতে অনেক এগিয়ে গেলেও প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের প্রতি সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়া হয় ।প্রাথমিক শিক্ষকরা বেতন-পদমর্যাদার দিক দিয়ে আমাদের দেশে সবচেয়ে অবহেলিত। নিম্ন আর্থ-সামাজিক মর্যাদার কারণে মেধাবীরা প্রাথমিক শিক্ষক হতে আকৃষ্ট হয় না এবং যেসব মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় আসে তারাও কিছুদিন পরে এ পেশা থেকে চলে যাচ্ছেন বা যাওয়ার চেষ্টা করছেন যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত।

দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যেতে হলে প্রাথমিকে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মর্যাদা(উচ্চ বেতন-পদমর্যাদা) না দিয়ে শুধু শিক্ষকদের মর্যাদা সবার উপরে এই কথা বলে মেধাবীদেরকে এই পেশায় আকৃষ্ট করানো অথবা তাদেরকে এ পেশায় ধরে রাখা যাবে না। মেধাবীদেরকে আকৃষ্ট অথবা ধরে রাখতে হলে অবশ্যই মানসম্মত বেতন-পদমর্যাদা দিতে হবে।

বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার। সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের উন্নয়নে অনেক কিছু করেছে এবং করার চেষ্টা করছে। তারপরও অনেক ঘাটতি এখনো বিদ্যমান রয়েছে যা নিরসন করা আশু প্রয়োজন। ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন। দেশের অন্য সকল পেশায় ২য় শ্রেণিতে কর্মরত সবাই ১০ম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন,শুধু প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা ১১তম গ্রেডে বেতন পাচ্ছেন যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। ৩৪,৩৫ ও ৩৬তম বিসিএস থেকে ২য় শ্রেণির নন-ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত অন্য সবাই সরাসরি ১০ম গ্রেডে নিয়োগ পেলেও প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের ১১তম গ্রেডে নিয়োগ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই দেশে একই নিয়োগে এই বৈষম্যের কারণে এই ২য় শ্রেণির নন-ক্যাডার অনেক প্রধান শিক্ষক সম্প্রতি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। অথচ মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য এই মেধাবীদেরকে এ পেশায় ধরে রাখা অত্যন্ত জরুরী।

তাই অবিলম্বে ২য় শ্রেণির গেজেটেড পদমর্যাদাসহ প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড কার্যকর করা উচিত। অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাণ বলে অভিহিত সহকারী শিক্ষকরা আরো অবহেলিত এবং শিক্ষক হয়েও এখনো ৩য় শ্রেণির কর্মচারী পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত যা শিক্ষক জাতির জন্য চরম লজ্জাজনক। একজন শিক্ষক কীভাবে ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হন? বঙ্গবন্ধু যেখানে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে কোন পার্থক্য রাখেননি সেখানে বর্তমানে প্রধান শিক্ষকদের সাথে সহকারী শিক্ষকদের বেতনের পার্থক্য ৩ ধাপ। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৫ সালের পে-স্কেল পর্যন্ত পদ অনুসারে প্রধান শিক্ষকদের পরের গ্রেডে সহকারী শিক্ষকরা বেতন পেতেন। সেখানে ১ধাপের পরিবর্তে বর্তমানে ৩ ধাপ বৈষম্য সহকারী শিক্ষকদের জন্য অপমানজনক। নিম্ন বেতন গ্রেডের জন্য যেসব মেধাবী প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তারাও এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সহকারী শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেডের (প্রধান শিক্ষক ১০ম হলে, সহকারী শিক্ষক ১১তম) জন্য আন্দোলন করে আসছেন এবং সরকারও তাদের দাবী যৌক্তিক বলে স্বীকার করেছে। তারপরও শিক্ষকদের নায্য দাবী এখনো পূরণ করা হয়নি। পূর্বে সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাশ নির্ধারণ থাকলেও গত ৩ মার্চ ২০১৯ মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদনকৃত সংশোধিত নিয়োগবিধিতে মহিলা সহকারী শিক্ষকদেরও শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষকদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাধ্যতামূলকভাবে ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারী এডুকেশন নামে উন্নতমানের একটি ডিপ্লোমা কোর্স করতে হয়। দেশের অন্য ডিপ্লোমাধারীরা যেখানে ২য় শ্রেণির মর্যাদায় কর্মরত সেখানে একমাত্র প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা শিক্ষক ও ডিপ্লোমাধারী হয়েও ৩য় শ্রেণির কর্মচারী পদমর্যাদায় কর্মরত।

মেধাবীদেরকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে আকৃষ্ট করতে ও কর্মরত মেধাবীদেরকে ধরে রাখতে হলে সহকারী শিক্ষকদেরও দ্রুত ২য় শ্রেণির পদমর্যাদাসহ ১১তম গ্রেড কার্যকর করতে হবে।গ্রেড বৈষম্য ছাড়াও আরো অনেক বৈষম্যের কারণে প্রাথমিকের মেধাবী শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যেমন শিক্ষকদের কোন পদোন্নতি নেই, যে পদে যোগদান সে পদেই অবসর। অথচ কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হয়ে ইচ্ছে করলেই সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রিপদ ধরে সিনিয়রিটি ও বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে মহাপরিচালক পর্যন্ত পদোন্নতি দিতে পারেন।

আবার অন্য পেশাজীবীদের থেকে কম ছুটি ভোগ করেও প্রাথমিক শিক্ষকদের ভ্যাকেশনাল কর্মচারী হিসেবে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন করা হচ্ছে। এছাড়াও দীর্ঘ সময়সূচি,হয়রানি,মর্যাদাহীনতা ও যথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়ার কারণে মেধাবী প্রাথমিক শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশা থেকে চলে যাচ্ছেন।

লেখক: সহকারী শিক্ষক

  • সর্বশেষ
  • পঠিত