ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

বালিশগুলো উপরে উঠাতে জিন আনা হয়েছিল

  মোকাম্মেল হোসেন

প্রকাশ : ২৭ মে ২০১৯, ১৭:১১

বালিশগুলো উপরে উঠাতে জিন আনা হয়েছিল

বিমানবন্দর রেলস্টেশনের প্লাটফরমে পা ছড়িয়ে বসে আছি। ময়মনসিংহগামী যমুনা এক্সপ্রেস নির্ধারিত সময়ে কমলাপুর ছাড়লে ঘড়িতে পাঁচটা দশ বাজার আগেই এখানে পৌঁছে যাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে, আজ ট্রেন লেট হবে। এদেশে ট্রেন লেট হওয়াকে কেউ অপরাধ হিসেবে গণ্য করে না। কাজেই এটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এই মুহূর্তে আমার ভাবনার বিষয় হল মানুষ। চারপাশে অগণিত মানুষের মুখ। প্রতিটি মুখের ভাষা ও অভিব্যক্তি আলাদা। আমি মনোযোগ দিয়ে সেসব ভাষা বোঝার চেষ্টা করছি। এ সময় নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস হুইসেল বাজাতে বাজাতে প্লাটফরমে প্রবেশ করল। পাশে বসে থাকা এক যুবক আমাকে সাক্ষী মেনে বলল-

: ড্রাইভারের কারবারটা দেখছুইন ভাই! ব্যাটা আমার কান-মান তবদা লাগাইয়া দিছে!

পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় ট্রেন প্লাটফরমে ঢোকার আগেই আমি আঙুল দিয়ে দুই কানের ছিদ্র বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তাকে বললাম-

: এইখানের যে পরিবেশ, হুইসেল না মাইরা উপায় কী?

: তাই বইলা এই রকম আতকা হর্ন বাজাইব? প্লাটফরমে ঢোকনের আগে বাজাইতে পারে না!

কিছুক্ষণ থুম ধরে থাকার পর হাসতে হাসতে তাকে বললাম-

: রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা থেইকা শুরু কইরা সাধারণ যানবাহনের চালকের আসনে বইসা থাকা মানুষগুলার আক্কেল-পছন্দ একেবারেই কম। কী করবাইন, মাইন্যা নেন।

: আর কত মাইন্যা নিবাম! মানতে মানতে তো হাতে লোডা ধরাইয়া দিতেছে...

কথাবার্তা শুনে যুবকের গন্তব্য অনুমান করা কঠিন হল না। জিজ্ঞেস করলাম-

: মমিসিং যাবাইন?

: হ।

পাঁচ মিনিট সময়সীমার বিরতিকাল অতিক্রান্ত হতেই উপকূল এক্সপ্রেস লেংচাতে-লেংচাতে স্টেশন ছেড়ে চলে গেল। এসময় যুবক বলল-

: ভাই, আপনেরে একটা জিনিস দেখাই!

: কী জিনিস?

: সামনের দিকে তাকাইন!

সামনে তাকালাম। বিপরীত দিকের ৩ ও ৪ নম্বর প্লাটফরমে যাত্রীরা ঢাকাগামী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। ট্রেনের অপেক্ষায় থাকা লোকজনের চিরাচরিত দৃশ্যের বাইরে অস্বাভাবিক কোনোকিছু চোখে পড়ল না। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকাতেই সে বলল-

: কিছু দেখলাইন?

না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। যুবক এবার বলল-

: ভালা কইরা খেয়াল করুইন।

: করছি রে ভাই!

: একটা মেয়ে দেখতাছুইন না? মোবাইল ফোনে কথা বলতেছে!

: হ।

: আমি প্রায় একঘণ্টা আগে ইস্টিশনে আইছি। আওনের পর থেইকাই এই সিনারি দেখতেছি। নন-স্টপ কথা চলতেছে!

যুবকের কথায় ভালো করে লক্ষ করলাম। মেয়েটির বয়স খুব বেশি বলে মনে হল না। প্লাটফরমের একপাশে রোদের মধ্যে আপ-ডাউন করতে করতে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। যুবক গভীর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল-

: কী বুঝলাইন?

: বাঙালি মোবাইল ফোন হাতে পাইয়া উন্মাদ হইয়া গেছে।

আমার কথা শুনে যুবক ঠা-ঠা শব্দে হেসে উঠল। হাসি শেষ হওয়ার পর যুবকের উদ্দেশে বললাম-

: তবে মোবাইল ফোনের ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। এর মাধ্যমে সমাজের মানুষ নানাভাবে উপকৃত হইতেছে। অবশ্য বিরিংতালও কম ঘটতেছে না! পত্রিকায় দেখলাম, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রেম হওয়ার পর এক মেয়েরে নর্থবেঙ্গল থেইকা ভাগাইয়া টঙ্গীতে আনার পর প্রেমিক ভাইজান মেয়েটির বাবা-মার কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে। বুঝেন ঠেলা!

একটু পরে আমাদের সামনে একজন পানি বিক্রেতা উপস্থিত হল। তার ডান হাতের একটা আঙুল ফেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে যুবক পকেট থেকে ওয়ান টাইম ড্রেসিং প্যাড বা স্ট্রিপ, ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলা হয় ইলাস্টিক অ্যাডহেসিভ ড্রেসিং, সেটা বের করে লোকটির আঙুলের মাথায় লাগিয়ে দিল। এ দৃশ্য দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম-

: আপনের পরিচিত নাকি?

: উহু।

: তাইলে?

: বেচারার অবস্থা দেইখা সামাইন্য সাহায্য করলাম...

অভিভূত হওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়; তারপরও ঘটনাটা আমার মনে দাগ কাটল। যুবকের পরোপকারিতায় মুগ্ধ হয়ে বললাম-

: ভাই! পট্টি দেওনের ফলে আক্রান্ত স্থান নিরাপদ হইল ঠিকই; কিন্তু ব্যথা-বেদনা তো দূর হইল না। ওনার এখন ব্যথানাশক ওষুধ দরকার।

আমাকে অভিভূত করে দিয়ে পকেট থেকে ব্যথানাশক ট্যাবলেট বের করে লোকটির হাতে দিয়ে যুবক বলল-

: রোজা রাখছুইন?

: জে।

: ইফতারির পরে এইটা খাইয়া নিবাইন।

এ সময় যুবকের উদ্দেশে আমি বললাম-

: ভাই! ব্যথানাশক ট্যাবলেট খাওয়ার পর এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ খাইতে হয়। ওনারে এন্টাসিড দিবেন না?

আমার কথা শুনে যুবকের চোখে-মুখে দুষ্টুমি ঝিলিক দিল। লোকটিকে সে বলল-

: আমার কাছে তো এই মুহূর্তে কোনো এন্টাসিড নাই। ভাইজান, আফনে এক কাম করুইন। ওই যে ওইপাশের প্লাটফরমে দেখা যাইতেছে- মোবাইল ফোনে এক আপামনি কথা বলতেছেন! তার কাছে এন্টাসিড ট্যাবলেট আছে! যান, একটা লইয়া আসেন।

যুবকের কথা শেষ হতে না হতেই মেয়েটি ওপাশের প্লাটফরম থেকে রেললাইন পার হয়ে এপাশের প্লাটফরমের দিকে আসতে লাগল! মুচকি হেসে যুবককে বললাম-

: ভাই! আপামনি আপনের মনের ভাব টের পাইয়া এন্টাসিড দিতে নিজেই আগাইয়া আসতেছে।

এপাশের প্লাটফরমের এক কোণায় মোবাইল ফোনে টাকা ভরার একটা দোকান। মেয়েটি সেই দোকানে গিয়ে রিচার্জ করে পুনরায় ওপাশের প্লাটফরমে ফিরে গেল। এ দৃশ্য দেখে যুবক বলে উঠল-

: কারবার দেখছুইন ভাই! কথা বলতে বলতে মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ হইয়া যায়; কিন্তু কথা আর শেষ হয় না!

দেশের মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও এটাই চায়। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টাই মানুষ যাতে কথার ওপর ভাসতে থাকে, সেজন্য একেক কোম্পানি একেক ধরনের কর্মসূচি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের ঝাঁপাঝাঁপির মধ্যে পড়ে এক মিনিটের একটা কথা বলতে গিয়ে আমরা আধাঘণ্টা পার করে দিচ্ছি। এতে অর্থহানি ও স্বাস্থ্যহানি তো হচ্ছেই; আরও একদিক থেকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কথার উৎসবে যোগ দিয়ে আমরা লিখতে ভুলতে যাচ্ছি। কয়েকদিন আগে আমার বড় ছেলে তাসিন মিয়া একটা বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠাল- আব্বু! ডোন্ট অরি...। এই হচ্ছে এ যুগে পিতার কাছে পুত্রের পত্র। এখন লোকজনের মধ্যে কথার পরিসর যত বাড়ছে; লেখার পরিসর ততই সংক্ষেপ হয়ে টরে-টক্কা যুগের টেলিগ্রামের আকার-আয়তন পাচ্ছে। আজকাল ক’জন ছেলেমেয়ে তাদের বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব অথবা প্রেমাস্পদের কাছে চিঠি লেখে জানি না। ছাত্রজীবনে আমরা মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে নিয়মিত চিঠি লিখতাম। সেসব চিঠির শুরু ও শেষ ছাড়াও প্রতিটি ছত্রে আবেগ-অনুভূতির নানা আলপনা আঁকা থাকত। আজকাল মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটে বাংলা-ইংরেজির মিশেল দেয়া লেখায় সেসব আবেগের দেখা পাওয়া দুষ্কর। এখন একজন অন্যজনকে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠায়- কুইক আসো। অন্যজন উত্তরে লেখে- কামিং। ব্যস, মামলা ডিসমিস। এই হচ্ছে এ যুগের চিঠির আকার-আয়তন।

চিঠি লিখতে গিয়ে স্কুলজীবনে একবার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একদিন এক সহপাঠী এসে আমাকে ধরল-

: দোস্ত! তোর ভাষাজ্ঞান ভালো। তুই আমার হইয়া বিলকিসরে কমসে কম দশ পৃষ্ঠার একটা চিঠি লেইখা দিবি। না করতে পারবি না দোস্ত! এইটা আমার জীবন-মরণ সমস্যা।

বন্ধুর পীড়াপীড়িতে আমাদের একক্লাস নিচের ছাত্রী বিলকিসের উদ্দেশে একটা প্রেমপত্র লিখে ফেললাম। চিঠিটা লেখার পর মনে হল- এত উপমা দিয়ে, এত খাটাখাটনি করে চিঠিটা লিখলাম, এর প্রকৃত লেখক কে- তা প্রাপক জানবে না, এটা কী করে হয়? এই ভাবনা থেকে চিঠির এক কোণায় ছোট করে লিখে দিলাম- পত্রলেখক, এমএইচ। কয়েকদিন পরে টিফিন পিরিয়ডে বিলকিস আমাকে ডাক দিল-

: এই যে শুনেন...

: আমারে বলতেছ!

: জি! আপনেরেই বলতেছি।

: কও।

: আরেকজনের হইয়া চিঠি লেখতে যান কেন? নিজে লেখার সাহস নাই?

অতীতের স্মৃতির জাল আষ্টেপৃষ্ঠে আমাকে ভালোই জড়িয়ে ধরেছিল। যুবকের ডাকে সম্বিত ফিরল। সে জানতে চাইল-

: তন্ময় হইয়া এত কী ভাবতাছুইন!

সত্যের পাশ কাটিয়ে সামান্য রহস্য করলাম। বললাম-

: ভাবতেছি বালিশ লইয়া।

: নেত্রকোণার বালিশ মিষ্টি?

: না।

: তাইলে?

: এইটা হইল রূপনগরের বালিশ।

: আসলেই ভাই! জবর ঘটনা একখান ঘটছে। বালিশের ঘটনা শুইন্যা তো প্রথমে আমি ধুন্ধা মাইরা গেছিলাম। পরে একজনে কইল- বালিশগুলা উপরে উঠানোর লাইগা নাকি ইয়া বড় একটা ক্রেন ভাড়া করা হইছিল। সেইজন্যই খরচটা অত্যধিক মাত্রায় বাইড়া গেছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম-

: আপনের কথা সত্য কিনা জানি না; তবে আমি অন্য একটা তথ্য পাইছি।

: কী তথ্য?

: আমরার এলাকার এক লোক ব্রেনে ডিফেট খাইয়া পাবনা হাসপাতালে ভর্তি আছিল। কয়েক আগে রিলিজ হইয়া সে বাড়িতে ফিরছে। ঘটনাটা তার মুখেই শুনলাম।

চোখেমুখে গভীর আগ্রহ নিয়ে যুবক জানতে চাইল-

: কী ঘটনা কওহাইন, শুনি।

: প্রকৃত ঘটনা হইল- বালিশগুলা তো আর যেনতেন বালিশ না; পারমাণবিক বালিশ। তাই যারা এইগুলা উপরে উঠানোর দায়িত্ব পাইছিল, তারা ভাবল- মানুষ দিয়া এইসব বালিশ উপরে উঠানো ঠিক হবে না; অ্যাক্সিডেন্ট ঘটতে পারে। তখন তারা স্থানীয় এক কবিরাজের মাধ্যমে কয়েকটা জিন ভাড়া করল।

চোখ বড় করে যুবক জানতে চাইল-

: জিন?

: হ, জিন। আগুনে আগুনে কাটাকাটি; দুর্ঘটনার কোনো ভয় নাই। এরপর একদিন পূর্ণিমার রাইতে জিনেরা আইসা কাজ সমাধা কইরা দিল। কাজ শেষ হওয়ার পর ঠিকাদার তাদের হাতে টাকা দিতে গেছে, অমনি এক জিন কটমট কইরা কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকার পর বলল-

: আরে ব্যাটা! জিনেরা টাকা-পয়সার কাঙাল না; যদি পারস মিষ্টি খাওয়া। আমরা মিষ্টি খুবই পছন্দ করি।

দেখলাম, যুবক হা করে আমার গল্প গিলছে। হঠাৎ ব্রেক মারায় মুখ ভালোভাবে বন্ধ না করেই সে বলে উঠল-

: এরপরের ঘটনা কী?

: এরপর আর কী? জিনদের আবদার পুরণ করার জন্য মিষ্টির ব্যবস্থা করা হইল। জিনেরা সেই মিষ্টি মুখে দিয়াই ওয়াক থু, ওয়াক থু বইলা মাটিতে ফেইলা দিল। বলল, আমরা ভেজাল মিষ্টি খাই না; খাঁটি মিষ্টি আন। এরপর অন্য এক জায়গা থেইকা মিষ্টি আনা হইল। দেখা গেল, ওই মিষ্টিও ভেজাল। তারপর আরেক জায়গার মিষ্টি আনা হইল। হায় আল্লাহ! দেখা গেল, ওইটাও ভেজাল। এদিকে জিনেরা তো খামটি মাইরা বসছে, মিষ্টি না খাইয়া নড়বে না। এক-দুই করতে করতে একদিন যায়, দুইদিন যায়, তিনদিন যায়- একে একে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেইকা নানা পদের মিষ্টি আনা হইল। এই মিষ্টি আনাআনির ফলেই টাকা খরচ হইয়া গেল অত্যধিক; যা পরে বালিশ উত্তোলন ব্যয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হইছে। বুঝলাইন!

প্লাটফরমের দিকে অগ্রসরমান ট্রেনের প্রতি আঙুল তুলে যুবক বলল-

: আমগর গাড়ি আইসা পড়ছে। চলেন আগে গাড়িতে উঠি। এরপর আপনের বাদবাকি কথা শুনবাম...

মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • পঠিত