ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

পাঠদানবহির্ভূত কাজে নাকাল প্রাথমিক শিক্ষকরা

  মো. সিদ্দিকুর রহমান

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৯, ১২:১০

পাঠদানবহির্ভূত কাজে নাকাল প্রাথমিক শিক্ষকরা

শিক্ষিকা তাহমিনা খাতুনের ওপর ২০১৭ সালে সংঘটিত নির্মম ঘটনাটি আজও মনে পড়ে। সে ঘটনার কোনো সুবিচার পাননি তিনি। শিক্ষক সমাজও পায়নি সে কাজ থেকে অব্যাহতি। রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে ঢাকার কোতোয়ালি থানার বংশাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারুক চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বংশাল চৌরাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

প্রতিবাদমুখর হয়ে মহানগরীর সব প্রাথমিক শিক্ষক জমায়েত হয়েছিলেন তাদের সহকর্মী হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে। পুরো প্রশাসন নেমে এসেছিল প্রাথমিক শিক্ষকদের শান্ত করতে।

বিচারও হয়েছিল ফারুক চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের। অথচ বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষকদের সহকারী প্রধানসহ সমিতিগুলো বড় বড় নেতার দৃষ্টি কাড়তে পারেনি সেদিনের নির্মম ঘটনাটি।

ঘটনাটি ঘটেছিল খোদ রাজধানীর খিলগাঁও ৫৬০/সি চৌরাস্তার চার তলা একটি বাড়িতে। দেশের শিক্ষাবিষয়ক একমাত্র অনলাইন পত্রিকা দৈনিক শিক্ষা ডটকমে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

জানা যায়, মালিক রোকসানা খানমের বাসগৃহে একত্রে বসবাস করত একটি কুকুর। স্বাধীন দেশের নাগরিকের মতো কুকুরটিকে বেঁধে রাখত না। ভোটার তালিকা হালনাগাদে নিয়োজিত মানুষ গড়ার কারিগর তাহমিনা খাতুন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিদ্যালয় ছুটির পর ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজে তিনি ওই বাসায় যান। তাহমিনা যথারীতি চার তলায় দরজায় টোকা দেন।

একটি মেয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির পাশ দিয়ে কুকুরটি তাকে আক্রমণ করে। প্রথমে দাঁত বসিয়ে তাহমিনার পায়ে কামড় দেয়। কুকুরের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হাত দিয়ে ছাড়াতে গেলে হাতেও কামড় দেয়। এরপর কুকুরটি তার মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে।

নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি না করে স্বল্পসংখ্যক ভোটারের জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে বা কোনো স্কুলে কেন্দ্র করে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তির কাজ করতে পারত। কোনো কোনো বাড়িতে দরজা খুলে শিক্ষক পরিচয় পাওয়ার পরও গৃহকর্তার মধ্যে বসতে দেয়ার মানসিকতা জাগ্রত হয় না। দায়িত্বের বাইরে সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর অনেক কাজ চাপিয়ে দেয়, যার মধ্যে আছে পাঠদানবহির্ভূত ও পাঠদান সংশ্লিষ্ট অনেক কিছু।

পাঠদানবহির্ভূত কাজ: ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও হালনাগাদ করা, ভোট গ্রহণ, শিশু জরিপ, কৃষিশুমারি, আদমশুমারি, উপবৃত্তি তালিকা প্রণয়ন ও প্রাপ্তিতে সহযোগিতা, খোলাবাজারে চাল বিক্রি তদারকি, বিস্কুট খাওয়ানো ও হিসাব সংরক্ষণ, কাঁচা-পাকা ল্যাট্রিনের হিসাব-তথ্য সংগ্রহ করা, কৃমির ট্যাবলেট, ভিটামিন-এ ক্যাপসুলসহ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাজ, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল খেলা প্রতিযোগিতায় ৪ থেকে ৫ দিন মাঠে অবস্থান রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দর্শকের সারিতে বসে থাকা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ প্রাথমিকের অনুষ্ঠান ছাড়াও দর্শকের সারি পূরণ করার কাজ শিক্ষকদের দিয়ে করান হয়। সমাপনী পরীক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞে প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে ওঠে শিক্ষকশূন্য, অফিস হয়ে ওঠে শিক্ষকদের পদচারণায় কানায় কানায় পূর্ণ।

শিক্ষাদান সম্পর্কিত কাজ : প্রত্যেক মাসে ছাত্র হাজিরা খাতায় নাম ওঠানো, দৈনন্দিন উপস্থিতি-অনুপস্থিতি হিসাব সংরক্ষণ, হোম ভিজিট, উপকরণ তৈরি, দৈনিক পাঠ পরিকল্পনা তৈরি, বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি তথ্য, প্রাথমিক শিক্ষক সমাপনী সার্টিফিকেট লেখা, বছরে তিনটা পরীক্ষা ছাড়াও মডেল টেস্ট, সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষার নির্ভুল তথ্য পূরণসহ বিশাল কাজ শিক্ষকদের করতে হয়।

এ ছাড়াও প্রগতিপত্রের রেকর্ড হালনাগাদ করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করে অভিভাবকদের স্বাক্ষর নিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। প্রতি মাসে সব শিক্ষকের স্বাক্ষর সংবলিত তথ্য লিখে মাসকাবারি ফরম অফিসে দাখিল করতে হয়। ১ জানুয়ারির পূর্বে বিনা মূল্যে বই সংগ্রহ করে সিল মেরে শিক্ষার্থীদের কাছে বিতরণ, মাস্টার রোল রাখা, মিলাদ মাহফিল, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছুটির দিনে জাতীয় দিবস ও বিশেষ দিবস কর্মকাণ্ড করা।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি, স্লিপ কমিটি, বিদ্যালয়ের কল্যাণ সমিতি, শিক্ষক অভিভাবক সমিতিসহ ১১ ধরনের কমিটির সভা আহ্বান ও যাবতীয় আনুষঙ্গিক কাজ করা, বিদ্যালয়ের সব পরীক্ষাসহ সমাপনী, মডেল টেস্ট পরীক্ষার খাতা দেখে রাত জেগে স্বল্পসময়ে ফলাফল দেয়া, মা সমাবেশ, উঠোন বৈঠকসহ অসংখ্য ফাইল হালনাগাদ রাখতে হয়। অফিসে তথ্য পাঠানোর কাজে শিক্ষকদের দ্রুত কাজ করতে হয়।

নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকায় অনেক সময় পারিবারিক অনুষ্ঠান ও বহু বাৎসরিক ছুটি তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়। শিক্ষকদের শিক্ষাদান ছাড়া নানা কাজে ব্যস্ত রাখলে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। এ অবস্থা নিরসনে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি-

১. বিদ্যালয়কে শিক্ষক সংকটমুক্ত রাখতে হবে। ২. এক বা একাধিক অফিস সহকারী, অফিস সহযোগী, নাইট গার্ড, পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দিতে হবে। ৩. জাতীয় দিবসসহ বিশেষ দিবস কর্মদিন দেখিয়ে ৭৫ দিনের ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা।

৪. নির্বাচন সংক্রান্ত কাজসহ সরকারি অন্যান্য কাজ সম্পাদনের জন্য ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে নির্ধারিত অফিস স্থাপন করে কর্মচারীর মাধ্যমে কাজ করান। কোনো অবস্থায় শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কাজ করতে দেয়া সমীচীন নয়। ৫. মাসকাবারি ফরমে স্বাক্ষর ও তথ্য বাতিল করে প্রধান শিক্ষকদের আয়-ব্যয়ের ক্ষমতা দিয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মাসিক বেতনসহ নানা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে পাওনার জন্য শিক্ষকদের অফিসমুখী না হতে হয়।

প্রত্যেক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করতে হবে। তবে তা সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকদের পরের গ্রেড থেকে বঞ্চিত করে নয়।

৬. পাবলিক পরীক্ষার মতো সমাপনী পরীক্ষার সব কর্মযজ্ঞ বোর্ডের আওতায় আনা প্রয়োজন।

৭. বিদ্যালয়ের ১১ ধরনের কমিটি বাতিল করে প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে দাতা, অভিভাবক সদস্য ও সব শিক্ষককে নিয়ে কার্যকর বিদ্যালয় কল্যাণ সমিতি গঠন করা। ৮. পরিদর্শককে বিদ্যালয় পরিদর্শনকালীন সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে আদর্শ পাঠ বাধ্যতামূলকভাবে দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। আদর্শ পাঠ অনুসরণ করা হয় কি না, তা পরবর্তী পরিদর্শনে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

৯. শিক্ষক সময়ানুবর্তিতার মতো সর্বস্তরে সময়মতো কাজ করার ওপর জবাবদিহিতা থাকতে হবে।

বিদ্যালয়ের বাইরের শিক্ষাদানবহির্ভূত সব কাজের চাপ কমিয়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকদের প্রতি মর্যাদাবোধ সবার মাঝে জাগ্রত হোক।

মো. সিদ্দিকুর রহমান : আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ

[email protected]

এনএইচ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত