ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ আপডেট : ২২ মিনিট আগে
শিরোনাম

ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী রাজেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

  হারুন-অর-রশীদ, ফরিদপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২০, ১৫:২৩

ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী রাজেন্দ্র কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

ফরিদপুরের ঐতিহ্যবাহী সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ। দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নামে খ্যাত কলেজটি। যে কলেজটির রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস।

পাঠকদের জন্য কলেজটির প্রতিষ্ঠার সেই ইতিহাস তুলে ধরা হলো..

অবিভক্ত বাংলার বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত বৃহত্তর ফরিদপুর ও সন্নিহিত অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে কোন বিদ্যাপীঠ ছিল না। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা লাভের মোটামুটি ভাল ব্যবস্থা থাকলেও উচ্চ শিক্ষা মূলত কোলকাতা কেন্দ্রিক। ফলে মাধ্যমিক (ম্যাট্রিক) পাশের পর অধিকাংশের পক্ষেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আর্থিক অসচ্ছলতাসহ নানা কারণে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হতো না।

বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই ফরিদপুর শহরে একটা কলেজ স্থাপনের চিন্তাভাবনা শুরু করেন তখনকার শিক্ষিত মহল। এ নিয়ে তারা জেলা কালেক্টরের বিভিন্ন সময়ে আলাপ আলোচনাও করেন কিন্তু তাতে কোন অগ্রগতি হয়নি।

এমতাবস্থায়, ফরিদপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি, কংগ্রেস নেতা খ্যাতনামা আইনজীবী ও সমাজসেবক শ্রী অম্বিকাচরণ মজুমদার কলেজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসেন। বস্তুত, তারই সক্রিয় উদ্যোগে, অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও সাহসী নেতৃত্বে ১৯১৮ সালে রাজেন্দ্র কলেজের যাত্রা শুরু।

তবে এরও আগে ১৯১২ সালে গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ফরিদপুরে এলে তার কাছে ফরিদপুর শহরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হলেও তিনি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হন। অতঃপর ফরিদপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জেলার বিখ্যাত আইনজীবী এবং প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা অম্বিকাচরণ মজুমদার।

১৯১৫ সালের ১৫ নভেম্বর উদ্যমী পুরুষ অম্বিকাচরণ মজুমদার ফরিদপুরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করেন। এ সভায় ফরিদপুর শহরে একটি দ্বিতীয় গ্রেডের কলেজ স্থাপনের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য তার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি মাস দেড়েকের মধ্যেই ফরিদপুর শহরের পূর্ব পার্শ্বে (বর্তমান শহর ক্যাম্পাস) খেলার মাঠ ও মাঠে অবস্থিত মেলা ভবনের আংশিক পরিবর্তন করে কলেজ ভবনে রূপান্তর করার পরিকল্পনা পেশ করেন। কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য ৮০ হাজার টাকার প্রাথমিক তহবিল গঠনেরও সুপারিশ করেন উক্ত কমিটি।

১৯১৬ সালের ৯ জানুয়ারি অম্বিকাচরণ মজুমদারকে সভাপতি করে কলেজ কমিটি গঠিত হয়। কমিটি শহরের ব্যবসায়ীসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন। আরো টাকা কিভাবে সংগ্রহ করা যায় সেটায় ছিল অম্বিকাচরণের সারাক্ষণের চিন্তা। এ অবস্থায় একদিন তার মক্কেল ফরিদপুর জেলার বাইশরশির জমিদার রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর নিকট আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি উত্থাপন করেন। রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী কলেজের নাম তার স্বর্গীয় পিতা রাজেন্দ্র চন্দ্র রায় চৌধুরীর নামে করার শর্তে ৫০ হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব করেন।

১৩ আগস্টের সভায় কলেজ কমিটি উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কলেজের নাম ‘রাজেন্দ্র’ কলেজ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অত:পর কলেজ কমিটির সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার খেলার মাঠ ও মেলা ভবন মাঠের জমি থেকে ৫.২০ একর খাস জমি বরাদ্দের জন্যে সরকারের কাছে এবং কলেজ অধিভূক্তির জন্যে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন জানান ।

১৯১৬ সালের ৩০ আগস্ট জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) ফরিদপুর সফরে এলে অম্বিকাচরণ মজুমদার তার সঙ্গে সাক্ষাত করে কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার সহযোগিতা কামনা করেন। জনশিক্ষা পরিচালক কলেজ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন।

উল্লেখ্য, সে সময় কোথাও কোন কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমেই ছাত্রাবাস তৈরি করতে হতো। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করা যেত না।

১৯১৭ সালের ৮ মার্চ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের নির্দেশে দুজন পরিদর্শক ফরিদপুর সফরে আসেন। পরিদর্শন শেষে তারা তাদের প্রতিবেদনে কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন। এ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কমিটি তাদের পরিকল্পনা ঢেলে সাজিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ চূড়ান্ত করার কাজে হাত দেন।

এমতাবস্থায়, বাংলা সরকারের সচিব পাঠানো পত্রে মেলার মাঠের খাস জমি মঞ্জুর করতে সরকারের অস্বীকার জানানো হয়। কিন্তু হতোদ্যম হননি অম্বিকাচরণ মজুমদার। বরং এ সময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন আইসিএস অফিসার মি. জি. জে ডানলপ। তিনি এক পত্রে সরকারের কাছে উক্ত খাস জমি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দের আবেদন করেন।

ডানলপের পত্র বলে বলীয়ান কলেজ কমিটি ১৯১৭ সালের ৩০ জুলাই জেলা কালেক্টরের মাধ্যমে জমির জন্য পুনরায় আবেদন করেন। এর কয়েকদিন পরে বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসে ফরিদপুর সফর এলে অম্বিকাচরণ মজুমদার তাকে কলেজ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরে মেলার মাঠের খাসজমি বরাদ্দ দেয়ার আবেদন জানান।

রোনাল্ডসে জানান যে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অনুমোদন করলে সরকার জমি প্রদানের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে। এ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কমিটি পুরোদমে তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অম্বিকাচরণ মজুমদারকে বাংলা সরকারের সচিব ডনমেলি তার এক বার্তায় জানান যে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যদি কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা, তার আর্থিক ভিত্তি, ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থা, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি অনুমোদন করে তাহলে সরকার কলেজকে জমি প্রদানে প্রস্তুত আছে। তারপর কলেজ কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর নতুন করে আবেদন করেন। ইতোমধ্যে কলেজ গভর্নিং বডি পুনর্গঠিত হয়। এ সময়েই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যের অভিজ্ঞ অধ্যাপক কামাখ্যা নাথ মিত্রকে নিয়োগ দেয়া হয়।

১৯১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট এর প্রস্তাবে জমি প্রদান সংক্রান্ত সরকারি আদেশ পেশ করতে বলে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত জমি বরাদ্দের আদেশ পাওয়া যায়নি।

এদিকে ১৯১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পৌর চেয়ারম্যান মথুরা নাথ মিত্র তার উপর অর্পিত ক্ষমতা বলে দলিল সম্পাদন করে মেলা ভবন কলেজ কমিটির কাছে এক হাজার টাকায় বিক্রয় করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট তা পেশ করেন। এ সময় বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে কলেজকে বার্ষিক নামমাত্র এক টাকা খাজনার বিনিময়ে মেলার মাঠে ৫.২০ একর জমি মঞ্জুর করা হয়।

কালবিলম্ব না করে অম্বিকাচরণ মজুমদার উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করে মঞ্জুরি পত্রটি প্রদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের সুপারিশসহ কলেজ কমিটির আবেদন পত্র ভারত সরকারের কাছে পাঠান অনুমোদনের জন্য। অতঃপর অনুমোদন পেয়ে ঐতিহ্যবাহী রাজেন্দ্র কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত