ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

অনুভব আহমেদের কবিতা ‘প্রলাপ’

  সাহিত্য ডেস্ক

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:০০  
আপডেট :
 ২৯ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:১৮

অনুভব আহমেদের কবিতা ‘প্রলাপ’

এইসব বিকেলে টুপ করে ডুবে যাওয়া মুখ ঘাই মারে

দুপুরে যে টেবিলে খেতে বসেছিলাম

সেখানে এখন বসে আছে সোনালী চুলের মেয়ে

যার নখে লেগে থাকা কটাক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে

চামচ বেয়ে নেমে যাচ্ছে আরও কিছু বিকেল

শুনেছি আজকাল পাহাড়ের বুকেও গর্ত

লেলিহান যন্ত্রণা উড়ে ধোঁয়ায়

গাছের শরীরে চিৎকার

হেঁটে চলে প্রেমহীন হাইহিল, কয়েকটা কুকুর

উদোম রাস্তায় হাত পাতে ভিখারি রোদ

কিছু জটলা বেচে জীবন।

প্রলোভনের সোমত্ত দেহবল্লরী টেনে বার করে আনে

বুকের ভেতর থেকে অন্ধকার হাত

অনন্ত সঙ্গমে জন্মানো অযাচার

হাঁটতে শেখার আগেই গুঁড়িয়ে দেয় মিছিলের পা

অন্ধকালোয় ঢেকে দেয় বোধ

ভোজসভায় খুপড়িটাকে ঘিরে ধরে গোরখাদকের দল

গতাসু দীর্ঘশ্বাস

ধ্বনিত চিৎকার ফেরে না আর

নীরবতার শাণিত প্রতিধ্বনি

খুবলে খায় কালো ঠোঁট

কূপমন্ডুকতার বিভৎস কোলাহল

আপোষের দোলনায় দোল খায় দখিন হাওয়ায়

মেরুদণ্ড খুলে রেখে

পড়ে নেয় খোলস এককোষী অ্যামিবার

বাস্তুভিটার তমসায় আর্ত বেহালা

মনভোলানো প্রতিশ্রুতির অসহ্য শীৎকার

লাশবাহী ভ্যান বয়ে নিয়ে যায় মুমূর্ষু মানচিত্র

মর্গের ফ্রিজারে থেকে থেকে কালো হতে থাকে সবুজ

নিবদ্ধ স্বৈরাচার চোখের ভেতর ছাতা মেলে দিয়ে

মুছে ফেলতে চায় আকাশ

রক্তের বুননে অস্থির পায়চারী করে প্রতিবাদ

বল্গাহীন ঘোড়ার পিঠে

একবিন্দুতে

স্থির অস্তমিত দিন

এ তিমিরের বুকে

সূর্যোদয় ভাঁজ করে রাখে তার শরীর।

রাস্তার মতো শুয়ে থাকে মানুষ

রাষ্ট্রীয় ক্যারল গাইতে গাইতে বাড়ি ফেরেন বাবা

কচুরিপানার মতো ভেসে থাকা মাকে কেমন অস্পষ্ট দেখায়

মা হয়ে যান পথ,

পাশেই দুটো শিশু ভাতের দিকে তাকিয়ে হাসে

জিভের তলায় জমিয়ে রাখে হিংস্র লবণ

আমার ভীষণ ভয়

ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকা

এইসব বিকেল আমি ঠিকমতো পেরোতে পারি না

আমাকে তাড়া করে দুরূহ পাথর

শিশুর চোখ

পুরনো প্রেমিক

পাড়ার কুকুর

পাহাড় অথবা ট্রেন,

আমি ফিরতে পারি না কিছুতেই

ডাকসু হয়ে আমার দিকে এগোতে থাকে সন্ধ্যা।

মনে পড়ে

একদিন অন্ধকার শেখাবে বলে হারিয়ে গিয়েছিলো যে,

তার কাছ থেকে শুধুই শিখেছি নিদারূন স্বার্থপরতা

বেঁচে থাকার কৌশলে নির্লিপ্ত চাটুকারিতা

জীবনের কাছে নুয়ে পড়েছি বারবার

বেঁচে থাকার দায়ে

জীবনের ভয়ে

চোখের কোটরে উল্টে পড়ে থাকা দোয়াত কালিতে

শব্দের টর্চ জ্বেলে আমি আসলে আমাকেই নিশ্চিত করতে চেয়েছি আবারও

অনিশ্চয়তার দিকে ছিটকে পড়েছি

কমলালেবু পৃথিবী

স্পর্শ থেকে মুছে নিচ্ছে সারল্য

করোটির ভেতর বাজারনীতি, অর্থনীতির জরায়ু ভেদ করে স্পষ্ট হতে থাকে একটা মুখ

শৈশব থেকে উঠে আসে মার্বেল

পিংপং বল

দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া পথিকের মতো লাগে তাকে

সময়ের কড়াল ঝাপ্টায় অবসন্ন

আমার কী উচিৎ তার পাশে খানিকক্ষণ বসা

আলতো করে তার হাতে হাত রাখা

আমি ভাবতে থাকি,

আটপৌঢ়ে শাড়ির মতো দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভাবনা

অথচ আমার ভাবা উচিৎ,

স্বচ্ছ জলের মতো টলটলে ভাবনা

জঞ্জালহীন নিরেট কোনো ভাবনা

আমি এগুতে থাকি গুটি গুটি পায়ে

পথের ওপর শুয়ে থাকা মৃত পাতার শরীর

দুঃখ দুঃখ চোখ

ধানক্ষেতের হুল্লোড়ে সবুজ

আমার কী কোথাও যাওয়া উচিৎ

চেনা চারপাশ আর একঘেয়ে দিন ছেড়ে।

ভাবনার এলোমেলো শরীরে তোমাকে মনে পড়ে

এই এতোসব কোলাহলে প্রিয় নির্জনতা তুমি

গায়ের মেঠো পথের মতো মায়া

গভীর কূপের জলের মত তৃপ্ত

হাঁসের ডানায় জমা বিন্দু বিন্দু রাতের মতো শীতল

অথচ তুমিও বিব্রত পাঠ

কেবল একটা শরীর, অবয়ব,

যাকে বয়ে বেড়াই

দুর্যোগ প্রবল মহামারীতে

পরিপাটি সারল্যে ঘুমিয়ে থাকো আমার ডাহুক বুকে

অথর্ব অস্থিরতা ছুঁড়ে দিয়ে বলো

এইতো প্রেম,

স্পর্শের মাদকে ভ্রষ্ট সন্ন্যাসকে বলো

এইতো ইবাদত,

আমরা আবৃত্তি করতে থাকি আমাদের

আমরা খুলতে থাকি আমাদের

আমরা ক্লান্ত হতে থাকি

আমাদের সহজ বুকে ঢুকে যায় বহুগামী ট্রেন

আমাদের ভেতর ঢুকে যায় রাষ্ট্র

আমাদের ঠোঁটে স্পষ্ট হতে থাকে অবক্ষয়

আমাদের হাতে চোখ রেখে কাঁদে মানুষ

আমাদের চোখে আঙুল রাখে ক্ষুধা

আমি আবার তোমাকে হারাই

রোয়াকে পড়ে থাকে মৃত ডাহুক,

নীরব নিথর দুপুর

তোমার ভেতর ঢুকে যায় অরণ্য

তোমার ভেতর থইথই বর্ষার মেঘ

তোমার ভেতর গনগনে শহর

তোমার ভেতর জন্মঘোর

তোমার ভেতর ওড়ে যৌবন

তোমার ভেতর সাজানো নৃশংসতা

দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে খুন করে আমাকে।

তুমি এক বিস্ময়

তোমার ভেতর কয়েক প্রস্থ মুখোশ।

আমি এক দলা মোচড়ানো কাগজ, বিস্ময়হীন সংখ্যা

কিছুটা নিবিষ্ট, উপগত

কাঁচের গেলাসে জমা জল

কৃষকের হাসির মতো মলিন

আঙুল ছেড়ে উড়া কিছু বেওয়ারিশ ধোঁয়া

যারা সিলিং ছুঁবার আগেই মিলিয়ে যায়।

ভাবনায় আসে

শকুনের থুতনির কাছে জড়ো হওয়া আলো

শ্রমিকের মশাল, কামারের গনগনে মুখ

এসব পুরনো পেপারের স্তুপ

ছন্নছাড়া মেঘেদের বাড়ি

পাখিরা কেনো উড়তে পারে

এসব হাহাকার বয়ে বেড়ায় মানবজন্ম!

স্বাধীনতা চিরদিন নীল, শার্ট গায়ে দূরে সরে যায় বাধাবিঘ্নহীন

পাখিদের পাড়ায় হাসাহাসি খুব

কেবলমাত্র একটা শরীর যার বাইরে যেতে পারো না তুমি

তোমাকে অবনত হতে হয় তার কাছে

তার কারাগারে আজীবন বন্দি তুমি

পায়ের কাছে জড়ো শোকার্ত একজোড়া স্থবির চোখ

অপলক আমাকে দেখে,

আমার কালো হয়ে যাওয়া ব্যথায় তার যন্ত্রণা বাড়ে

অস্থির শব্দে আমি আসলে কী বলতে চাই?

প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরে বাতাসে

শূন্যের দিকে যেতে যেতে

অস্থিরতার দিকে যেতে যেতে

পা টেনে ধরে খসে যাওয়া স্কেলিটিন

জটিল আর দুর্বোধ্য মনে হয় নিজস্ব সকল ভাবনাকে

গভীরতলা থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকে ডাল

ছেয়ে যেতে থাকে অশান্ত ছায়া

আলাপের রঙ মাখানো কথার ঝুড়ি

নীরব পেন্ডুলামে প্লাবিত আমি

ঝড়ে কামার্ত পাটাতন

ফেলে আসা লোডশেডিং

ম্যাপলের ছায়া ভাঙা দূরত্ব

ঊরুর ফাঁদে বুনো বিষাদ নামে

জমাট আকাশ নিস্পৃহতা ভেঙে

আছড়ে আছড়ে

পড়তে চায় তটে

মরা নদী প্রমত্তা হয়ে উঠে আবার

ঢেউয়ের পর ঢেউ কোথায় নিয়ে যায়?

আমি বাড়ি ফিরতে চাই

পথ হাঁটতে থাকি অবিরল, ক্লান্ত হই

বাড়ি দূর থেকে আরও দূরে সরে যায়

অধঃপতনের নানাবিধ মুদ্রায়

আমি পথেই ঘুমিয়ে পড়ি

ওরা মাতাল বলে গালি দেয়

সভ্যতার তাম্রলিপি ঘষে ওরা সাঁতার কাটে সামাজিকতায়

সুতানালী সাপের মতো পেঁচাতে থাকে ধীরে

যাচিত চৌকাঠে নিজস্ব সম্রাজ্য

আমার দিনেরা ক্লীবছায়ায় নুড়ি কুড়োয়

অর্বাচীন সব ভাবনায় ব্যারিকেড ভেঙে দিতে চায়

আগুনের বীপরিতে আগুন জ্বালাতে

আমাকেই পোড়াই

ব্যথার কপাট চিবোতে থাকে আমাকে

উপশমহীন গোধূলিপথ ছেয়ে থাকে শরীরে

অন্তহীন বৃষ্টি নামে

কাদা জমা পথ ক্লেদের ডানা

হাপিয়ে বেড়ায় নিঃশ্বাস

পৃথিবীর ডানায় ঝুলে থাকা বাঁদুরের দিকে চেয়ে

মাকে মনে পড়ে

আমার কচুরিপানার মতো ভেসে থাকা মা,

নরম নীরব মা

ডুবে যেতে থাকি অতল থেকে অতল

সাইরেনের মিহি সুর ফেরি করে বাতাস

দেহহীন ঘুমন্ত বাসনা সন্ধান করতে করতে দেখি

এ্যাকুরিয়ামে ভেসে আছে রৌদ্রমাখা প্রজাপতি

শরীরের পাটাতনে ফসলের সোহাগ

কচ্ছপ অন্ধকারে মুখচুন বসে থাকা সিথান,

পারাপারহীন কৌশল,

দেহজ সকল ভাষা

অতল জল

সাঁতারু নই, স্বপ্নভুক চারা

ফুরিয়ে যেতে যেতে রেখে যাই পিপাসা

প্রতিদিনকার অনিশ্চয়তার পথে

ডুবু ডুবু আলো পশ্চিমে হেলে পড়ে

লাইটহাউসে ঝুলে থাকা সচেতনতা ভেদ করে

মাথা ঝিমঝিম করে

সন্ধ্যার নির্জন জেটিতে

কিছুতেই পৌঁছাতে পারছিনা

পেরোতে পারছিনা এই বিকেল

সন্ধ্যাটা বারবার সরে যাচ্ছে সামনে থেকে আরও দূর।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত