ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

শহরের এক পৌনঃপুনিক দিন

  রাব্বী আহমেদ

প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ২২:৩৬

শহরের এক পৌনঃপুনিক দিন
লেখক রাব্বী আহমেদ

মধ্য আগস্ট-শ্রাবণ শেষের দিনে, শহরজুড়ে সুতীব্র শোকের ছায়ার মাঝে, তৃতীয়বারের মতো উদাসীন-অসাবধানতায় হারিয়ে যায় ফোন। যেহেতু, জীবন নিয়ে আর কোন নীল-নকশা নেই, যা কিছু যায় (ব্যক্তি কিংবা যন্ত্র) তার জন্য কোথাও কোন ক্রন্দন থাকে না। তবুও জিডি করতে যাই হাতিরঝিল থানায়। দেখি, কর্তব্যরত অফিসার রঙ্গ-রসে ব্যস্ত হয়তো শ্যালিকা, বন্ধু, আত্মীয় কিংবা পরিচিতার সঙ্গে। ভাষায় বুঝি একই ডেমোগ্রাফিতে আমাদের বেড়ে ওঠা। আলাপ হয়। খাতির যত্ন করেন (অবশ্য যেটুকু পেলেই তাকে খাতিরের মত মনে হয়)। একটা বল পয়েন্ট এগিয়ে দিতে দিতে কার্বন পেপার খোঁজেন। আর জিডি পেপার কার্বোনেটেড হয়েও কাজ না করায় অদৃশ্যকে দোষারোপ করেন। জিডি পেপার, যার ওপরে ইচ্ছে করে লিখি; “গান আছে পৃথিবীতে জানি, তবু গানের হৃদয় নেই”। কিন্তু লিখতে হয় ফোন হারানোর (চুরির) হিস্ট্রি। এর মাঝে আবার রিংটোন, কী এক বাংলা সিনেমার ফোক সুরে বেজে ওঠে। ডিউটি অফিসার পুনরায় ব্যস্ত হয়ে যান, হয়তো স্ত্রী, শৈশবের বান্ধবী কিংবা দূরের কোন প্রেমিকার সঙ্গে। ভাবি, বঙ্গদেশের বিচিত্র এইসব ক্রিমিনাল-কার্যক্রমের মাঝে, একটা ফোন, যা এক মামুলি ব্যক্তির ব্যক্তিক অবচেতন মনের দোষে খোয়া গেছে। হের লইগ্যা কোথাও কোন তৎপরতা না থাকা, এই তো স্বাভাবিক।

এইসব ভেবে ভেবে, শরত চলে এলো তবু কেন শিউলি ফুটছে না? দাড়ি কি বেশি ছোট করে ফেললাম? এ মৌসুমে আর কি বৃষ্টি হবে না? এমন অনেক বিক্ষিপ্ত ভাবনা, সংসারের চিন্তা-অপচিন্তা, ঘাম-ক্ষুধা-ক্লান্তি-নির্লিপ্তির শরীর নিয়ে, হেঁটে চলি শহরের রাস্তায়। দেখি, লকডাউনের সঙ্গে ‘স্বাস্থ্যবিধিও’ উধাও হয়ে গেছে। বহুদিন পর মুখোশহীন মানুষ, অচেনা অনেক মুখ, নারী-পুরুষ-শিশু, যুবক-যুবতী, টোকাই-ভিক্ষুক-হকার,… দেখতে দেখতে একটা অপরিচিত চায়ের দোকান ঢুকি। মনে হয় ইহাকে পাইলাম যেন… শান্তি-স্বস্তির একটু নির্ভার নিরিবিলি। চারদিকে অনাত্মীয়ের ভীড়ে, এই মর্মস্পর্শী চায়ের দোকানিকে মনে হয় আন্তরিক গেরস্থ। স্নেহের ঘরোয়া লিকারে, হৃদয়ের ‘ঐকান্তিক বিশুদ্ধতায়’, বানিয়ে খাওয়ান ‘শোক দিবসের চা’। মার্কেট ইকোনমির জমজমাট হাটবাজারে এমন কাস্টমার কেয়ার মনে দাগ কাটে।

‘শোক দিবসের চা’ খেয়ে, মধুবাগ-মীরবাগ-খিলগাঁও পেরিয়ে, আবুল হোটেলের নিকটবর্তী ওভার ব্রিজের নিচে এসে দাঁড়াই। দেখি, শোকার্ত ব্যানারের বুকে দোয়া-মিলাদ-তবারক বিতরণের শো কেসিং। ভাবি, স্মৃতি কথা কওয়া আহত আগস্ট এই মাসে, শ্রাবণ ফুরিয়ে যাওয়া ভাদ্র-আশ্বিনে, কোথাও এলিজি নেই, অ্যানথেম নেই , নেই কোন কান্নার কলরব। ভাবি, ক্রমশ কেমন পালটে যাচ্ছে এই ভূখন্ডের শোক প্রকাশের ধরণ।

এসব ভাবতে ভাবতেই খুঁজে পাই কাঙ্ক্ষিত কাস্টমার পয়েন্ট। রিপ্লেস করি সিম, আর দুর্মূল্যের এই বাজারে হারানো ফোনের সমমূল্যের ফোন রিপ্লেসমেন্ট এখনই অসম্ভব অনুভব করি। ফলে, কনফুসিয়াসের দেশ থেকে আসা নীল রঙা মৃদু এক ফোন কিনি। যদিও স্ত্রী, যিনি আমার সমস্তরকম ভার্নাবিলিটির সঙ্গী, দূরের এক শহর থেকে মমতার স্পন্সর হতে চান। কিন্তু কথা বলা, মেইল চেক, WhatsApp আর মিউজিক শোনাই যখন মূল কাজ, তখন কনজিউমার কালচারের এই মিনিমাল স্তরের ভোক্তা হয়েই পরিতৃপ্তি পাই। আরাম লাগে বেশ। এরপর রিকশায় যেতে যেতে, এয়ারফোনের সরু পথ দিয়ে কানে আসে,

“মাইজভান্ডারী রহমাতুল্লাহে আলায় বাবা,

লাখ সালাম তোমার পায়ে,

বাবা লাখ সালাম তোমার পায়…

পাহাড় গ্রাম চাটগাঁয়েতে তোমার আস্তানা

ভান্ডারী তোমার আস্তানা

কত অলী-আউলিয়া জিকির করে

পাগল মস্তানা”। … শিরিন জাওয়াদ পৌনঃপুনিক গেয়ে চলেন।

অলী-আউলিয়া-গাউস-কুতুব কিংবা পীর-মাশায়েখ নই। একুশ শতকের সামান্য এক নাজুক মানুষ। ফলে পাগল-মস্তানা হওয়ার অক্ষমতা স্বীকার করে ফিরে আসি গৃহে। এরপর, ‘গুগল গুরুর’ টাস্ক ম্যানেজমেন্ট স্মরণ করিয়ে দেয় পার্সোনাল পঞ্জিকায় আজ কোন শোক, বর্ষা বিদায় কিংবা হলি ডে নেই। সেখানে আছে শুধুই ধূসর ডেডলাইন। মনে হয়, বেসরকারি এই জীবনে ‘আগুন-হাওয়ার মতো ফূর্তিরও কন্ট্রোল চাই’। ভগবদ্‌ গীতা জানায়, ‘আত্মদুঃখকাতরতা’ থেকে বাঁচাতে হবে কর্মকে। জানায়;

“তোমার কর্মই তোমার দায়,

ফলাফল নয়।

কখনোই তোমার কর্মের ফলকে

তোমার উদ্দেশ্য হতে দিও না।

অকর্মকেও দিও না”।

ফলে ব্যক্তিক অবসাদকে বাইপাস করতে হয়। তখন দেওয়ানগঞ্জের জেলে জলধরকে (৩৮) মনে পড়ে। তিনি যেমন বলতেন, “কাম করলে পেটে ভাত, না করলে মাগুত হাত”। এরপর নিমগ্ন হই, ‘জীবিকার জবাবদিহীতায়, জীবনেরও’। সাবমিশান শেষে নাকের নিকুঞ্জ থেকে বেরোয় ক্লান্তির দীর্ঘ-দীর্ঘ-শ্বাস…

…এরপর দেওয়ানা হয়ে উদ্দেশ্যহীন, এলেমেলো হেঁটে চলি হযরত শাহনূরী (রহঃ)-পাগলার মাজারের দিকে। সমস্ত দিনের শেষে, এই কিছুক্ষণ, শুধু সমর্পণের শান্ত পথ ধরে হেঁটে যাওয়া। একা। নির্ভার লাগে। মনে পড়ে, ক্যালেন্ডারে আজ রবিবার। সারাদিন রবিবার।

“Today is Sunday

Make it a Funday.

Before it turns to Monday

And today becomes done-day”. Great American Taco Company-এর স্পেশাল অফারের কথা মনে পড়ে।

…দিনলিপি শেষ করি। টের পাই, অজান্তেই পৌঁছে গেছি সোমবারে।

ভাবি, তবে কী সান ডে কে ফান-ডে করা হোলো না আর? তবে কী হোলো না জীবনের স্পেশাল অফারকে সেলিব্রেট করা? তবে কী আমাদের স্বপ্ন-সাধ-আকাঙ্ক্ষার অবিরাম বিশ্রামদিন আসবে না কোনদিন? তবে কী প্রতিবারই আমাদের দাঁড়াতে হবে আরো এক সোম-মঙ্গল-বৃহঃস্পতি-শুক্র-শনির মুখোমুখি? তবে কী আমাদেরও ‘ধূসর-ধূলির পথে ভেঙে পরে থাকা রথ’ নিয়ে যেতে হবে বহুদূর…আরও দূর। কতো দূর? যেতে যেতে জীবনানন্দের মতো মনে হবে;

“—তবু কেন এমন একাকী?

তবু আমি এমন একাকী”।

এরপর ‘নিজেকে চিনে, নিজেকে নিয়ে হাজির হতে হবে, জীবনের আরও বড় এক বাজেটের কমিটি মিটিং-এ”।

আর, ‘জীবন, শান্ত এ বিপ্লবী, স্থির আগুনের মত অবিরল আলো দেবে।…কমিটি মিটিং ভেঙ্গে গেলে’ আমরা আকাশে তাকিয়ে দেখবো, বহু আগে মরে গেছে হৃদয়ের রাজহাঁস।

১৫ আগস্ট, ২০২১ ৩১ শ্রাবণ, ১৪২৮

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত