ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

তেতো ঝাল বয়ান

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:৩৮

তেতো ঝাল বয়ান
ছবি ইনসেট: মোস্তফা কামাল পাশা

এমনিতেই শব্দগুলো অনেকের গলায় বিঁধে! কারো বা আধাসেদ্ধ বাংলা কচু গেলার মত টাকরা চুলকায়। কারো কারো আবার বুঝতেও সমস্যা। তবুও চালিয়ে যাই। সৌভাগ্য, না দুর্ভাগ্য জানি না। চট্টগ্রাম নগরীর দলের সব কজন মেয়রই আমার প্রিয়জন! বর্তমান মনোনীত মেয়র প্রার্থীও।

চট্টগ্রামের প্রথম নির্বাচিত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে রাজনৈতিক অভিভাবক বললে ভুল হবে না। ছিলাম ভাবশিষ্যও। তিনি বড্ড বেশি ভালবাসতেন। তাইতো সবচে নাজুক কাজগুলো জবরদস্তি করিয়ে নিতেন। হয়তো সবার সেরা ‘কাক পণ্ডিত’ ভাবতেন'! তাই এই শাস্তি। তাঁর শাস্তির পুরানো অ্যালার্জি এখনো চলমান। এই ছায়াবৃক্ষের আকস্মিক মহাপ্রয়াণের পর জানাজা শেষে একবার বাসায় যাই। দ্বিতীয় ও শেষবার যাই, মৃত্যু পরবর্তী জন্মবার্ষিকীর দিন, তাও উঠোনে। ওইদিনের বিস্ময়ের ধাক্কা কখনো ভুলতে পারবো না!

বেঁচে থাকতে তাঁর জন্মবার্ষিকীতে ভোর থেকে অসংখ্য মানুষের ভিড়ে বাড়ির আঙিনা ও পুরো চশমা পাহাড় ডুবে থাকত দিনভর। শুভেচ্ছা ব্যানারের জট লাগত বাড়িসহ এলাকার সব গলি ও সড়ক। ফুল, কেকের ভিড়ে পুরো বাড়ি ছেয়ে যেত। অবাক আমি- এদিন সুনসান নীরবতা। বাড়ির সামনের ছবিসহ একটা পোস্টও দিই।

তো, তাঁর প্রস্থানের পর আমার জন্য বাড়িটার দরজা বন্ধ। মধ্যরাত বা সময়-অসময়ে তিনি ফোন করবেন না আর। জবরদস্তি কোন কাজও চাপাবেন না। টানা ১৭ বছর মেয়র থাকাকালীন কতজনকে রাস্তা থেকে টেনে এনে কোটিপতি করেছেন। কত সাংবাদিক ধনে-মানে আজ গরীয়ান। ওরা চাইতে জানে আর মহিউদ্দিন ভাই দিতে জানেন। আমিতো সে গ্র্যান্ড হোটেল থেকে আটকে ছিলাম, উত্তর জেলার দলীয় সদস্য হয়েও। মোশাররফ ভাইয়ের কড়া বকাও গিলে হজম করে ফেলতাম। এরশাদ আমলে মিষ্টির বাক্সে *বিলিবন্টন থেকে শুরু করে কত নাজুক দায় ও চ্যালেঞ্জ টেনেছি। বার বার মৃত্যুর সাথে কঠিন লড়াই দিয়েছি।

‘৯৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগরের প্রথম মেয়র নির্বাচনে রাত জেগে প্রয়াত পুলিনদার নেতৃত্বে অসংখ্য কর্মী জামাল খান ঘিরে ভোটবাক্স পাহারা দিয়েছি। পরদিন দুপুরে তাঁর বিশাল বিজয়ের ঘোষণা শুনে খুশির তোড়ে দৈনিক আজাদী সম্পাদক [তখন পরিচালনা সম্পাদক] এম এ মালেক সাহেবকে রাজি করিয়ে ঘণ্টার মাঝে আজাদীর বিশেষ বুলেটিন বের করি। সঙ্গে ছিলেন হেলাল সাহেব। চুম্বক আইটেমগুলো সব নিজের লেখা। বিক্রি হয় হাজার হাজার কপি। তিনি আমাকেও ধনী বানাতে চেয়েছেন পারিনি, সম্ভবত যোগ্যতার অভাব। বাগে আনতে না পেরে মানুষের সামনে উল্টাপাল্টা বকতেন। মেজাজ খারাপ করতেন। যারা ওনাকে চিনতেন শুনে যেতেন। কম চেনারা হয়তো বিশ্বাসও করতেন। হায়, কত অম্লমধুর স্মৃতি, ধূসর হচ্ছে সময়ের ধুলো জমে।

তারপর মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। পেশাগত ও রাজনীতি দু’সূত্রেই খুব প্রিয়জন। ভাল লাগে তাঁর বিনয়, সাংগঠনিক দক্ষতা। দলের জন্য তাঁর কঠিন ত্যাগ, মৃত্যুর গুহা থেকে বারবার ফিরে আসা, খুব কাছ থেকে দেখা। তাঁকে রাজনীতির বাইরে বন্দরের কর্পোরেট ব্যবসায়ে যুক্ত করার বিরল সৌভাগ্যবানও আমি। বন্দরের সবচে অভিজাত ব্যবসায়ে যুক্ত হয়ে তিনি এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দারুণ সফল ব্যবসায়ীও। সুযোগ ছিল পরিচালক হিসাবে সাথে থাকার, হয়নি। তাঁদের মাতৃ-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এম এইচ চৌধুরী লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বন্ধু মোহাম্মদ মনিরুল হক চৌধুরী আমার অনুপস্থিতির জন্য তখন ‘আপসেট’ আর এখন খুব আক্ষেপ করে। যদিও ভাঙা ব্যবসা জোড়া দেয়ার পর বহু বছর দু’জনের কেউ মনেও রাখেনি। এটাই আধুনিক রীতি।

তো, আ জ ম নাছির উদ্দীন আগে যেমন প্রিয় ছিলেন এখনো তাই আছেন। তিনি পরে আত্মীয় হয়ে যান, বড় ছেলের বৈবাহিক সূত্রে। কিন্তু দূরত্ব থেকেই যায়। বাস্তবতা হচ্ছে, আমি কারো গায়ে গায়ে লেগে থাকার মত চরিত্র না। আমার সব প্রকল্পেও তিনি ছিলেন, কিন্তু সহযোগিতার হাত বাড়াননি। অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষ প্রকল্পে প্রায় দু’কোটি টাকা গচ্চা দিয়ে গুটিয়ে ফেলি। ২০১৩ থেকে ১৬ প্রায় চার বছর ডজন খানেক কর্মী পুষে সুসজ্জিত বড় অফিস চালিয়ে মিডিয়া দিগন্তে বড় বাঁক বদলের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ক্লান্ত হয়ে থেমে যাই। অথচ আনুষ্ঠানিক নিউজ সম্প্রচার মেয়র হিসাবে তিনিই উদ্বোধন করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তখনকার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। আমাদের শেষ অফিস ছিল নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির বিপরীতে সমাবেশ কনভেনশন সেন্টারের মুখে মুস্তাফিজ ভিলায়। এরকম ছোট বড় বহু স্বপ্নের অকাল মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর ও প্রধান বন্দর নগরী হয়েও মিডিয়া সেক্টরে এখনো জেলা শহরের উপরে মর্যাদা পায়নি। দায় ও দোষ কার, মন্তব্য করবো না। বাংলা ইংরেজি দ্বিভাষিক আমাদের ভিন্ন আঙ্গিক ও মাত্রার উদ্যোগটা সফল হলে মিডিয়ায় নিশ্চিত একটা ঝাঁকি আসতোই। যাঁরা আমাদের ট্রায়াল নিউজ দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পারবেন না।

না, আমার জীবনীশক্তি ঠিক চীনেজোঁকের মতই। নুন ছাড়া মৃত্যু নেই, বারবার ঘুরে দাঁড়াতে জানি। মুখ থুবড়ে পড়েও উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝেড়ে আবার লড়াইতে নামি। তাও ৯৭ সালে দৈনিক আজাদী ছেড়ে আসার পর রাজপথের একক লড়াই। কীভাবে, এটার শানে নযুল শোনালেও কারো লাভ হবে না। কারণ এতো কঠোর সাধনা একদিনে হয় না; টানা চর্চা ও রোখ চাই। এমন কাউকে দেখি না। দুঃখ, আমার সাথে খামাকা যুক্ত হয়ে একজন নিরীহ ভদ্রলোকও ক্ষতির শিকার হয়েছেন। নিজের বিশাল ক্ষতি কিছুই না, কিন্তু ওনার সামান্য ক্ষতির ক্ষত যে অনেক বড়। নিষেধ সত্বেও ওনাকে যুক্ত করেন ওনার তখনকার বান্ধবী, যিনি আমার সহকর্মী ছিলেন! কষ্টটা বিঁধে আছে এখনো।

সর্বশেষ বর্তমান মেয়র প্রার্থী এম, রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনিও বহুদিনের বন্ধু। লেখালেখি ও মননশীল কাজে প্রচণ্ড ঝোঁক তাঁর। রাজনীতির কারণে নিজের পরিচর্যা ঠিকমত করতে পারেন না। তবুও আমার নিউজ এজেন্সি, ছোটদের কাগজ গাঙচিল, সর্বশেষ পোর্টালেও জড়িয়ে থাকেন শেষ পর্যন্ত। ছোটদের জন্য গল্প লিখেছেন, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের ব্যানারে ‘বারুদ’ নামে অনিয়মিত প্রকাশনাও ছিল তাঁর। দেখভাল নিজেই করতাম। এরশাদ, খালেদার বৈরি সময়ে ‘বারুদ’ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিস্ফোরক প্রকাশনা ছিল নিঃসন্দেহে। রেজাউল ভাই সিরাজুদ্দৌলাহ সড়কে হোটেল ইন্টারন্যাশনাল-এ আমাদের অফিসে ‘৯৮ সাল থেকে ২০০৭’ পর্যন্ত প্রায় নিয়মিত অফিস করতেন। দুপুরের আপ্যায়নও তিনি করাতেন। আমার প্রথম ছোট গাড়ি টয়োটা স্টারলেটের নিত্য সওয়ারীও তিনি। সাথেই থাকতেন। হোটেল আগ্রাবাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম করম আলি গাঙচিল’র অভিভাবক ছিলেন।

গাঙচিল’র মাসিক বৈঠকও হতো হোটেলে। আমি দেশের তারকা হোটেল ইন্টারন্যাশনাল হোটেল গ্রুপের মিডিয়া সংক্রান্ত কাজ করতাম। তাই রেজাউল ভাইসহ নিত্য দৌড় ছিল হোটেলে। ওনার গাড়ি ভাবীর কেয়ারেই থাকত।

রেজাউল ভাই মেয়র পদে মনোনয়ন পাবেন, এটা প্রথমে বিশ্বাসও হয়নি। কিন্তু রাজনীতিতে তাঁর ত্যাগ, স্বচ্ছতা ও মননশীল সাধনা বন্ধুকে এই সাফল্য এনে দিয়েছে। প্রিয় নেত্রী অনেক বাঘা বাঘা নেতাকে এড়িয়ে তাঁকেই নৌকার টিকিট দিয়েছেন। বিশ্বাস, ইন শা আল্লাহ জয়ের মালাও তাঁর গলায় উঠবে। মনোনয়ন লাভের পরও ভুলেননি। ছুটে এসেছেন অ্যাপার্টমেন্টে, তাও কোন বহর ছাড়া একলাই। কৌশলগত কিছু দায়ও তুলে দিয়েছেন কাঁধে। যদ্দুর পারি, সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি।

আমার মত প্রায় অচ্ছুৎ জনটির এতসব ‘সৌভাগ্য’ কী কাকতাল, নাকি নিয়তির লীলা বুঝতেও কষ্ট!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত