ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

সামাজিক বিজ্ঞান-কলা অনুষদভুক্ত শিক্ষার্থীদের জন্য

উচ্চশিক্ষায় একাডেমিক মূল্যায়ন কেমন হওয়া উচিত: একটি রূপরেখা

  মো. আনারুল ইসলাম

প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২১, ২১:১৭

উচ্চশিক্ষায় একাডেমিক মূল্যায়ন কেমন হওয়া উচিত: একটি রূপরেখা
ছবি: সংগৃহীত

ভূমিকা:

শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। আর মূল্যায়ন হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রধান বিচারিক মাপকাঠি; যে মাপকাঠিতে শিক্ষার্থীদের অর্জিত শিখনফল একটা সনদের মাধ্যমে গ্রেড বা ফলাফল আকারে প্রকাশিত হলে শিক্ষার্থী সে ফলাফলের আয়নায় নিজের অবস্থান সম্পর্কে জেনে নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে চায় যে এরপর তার কী করা উচিত। মূল্যায়নের মাপকাঠিতে সকলকে খুশি করা না গেলেও শিক্ষার্থীরা একটা কথা স্বীকার করার সময় পেলে যদি এমন মন্তব্য করে যে, ‘হয়তো আমার প্রতি মূল্যায়নে আমি সর্বোচ্চ সন্তুষ্ট হতে পারছি না কিন্তু আমার প্রতি অবিচার করা হয়নি’; তাহলেই ধরে নেয়া যাবে যে তার মূল্যায়ন যথাযথ হয়েছে। আলোচিত প্রবন্ধে সামাজিক বিজ্ঞান ও কলা অনুষদভুক্ত শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতির স্থলে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি কেন দরকার এবং তার রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত এই সম্পর্কে একটি ধারণা ও বাস্তবায়ন কৌশল উপস্থাপন করা হয়েছে।

পটভূমি:

ড. আর্নল্ড ছাত্রদের বেত মারার প্রথা হ্রাস করেছিলেন। কিন্তু অল্পবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে বিদ্যালয়ে বেত ব্যবস্থা তিনি চালু রেখেছিলেন। তবে কবে, কখন এই বেত মেরে শেখানোর পদ্ধতি শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রচলিত হয়েছিল তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না। অল্প বয়স্ক ছেলেদের মিথ্যে কথা বলা, কুড়েমি স্বভাব এবং পানদোষ ইত্যাদি বদভ্যাস দূর করতে তিনি তা বহাল রেখেছিলেন। শেখার মূল উদ্দেশ্য হলো ‘মানসিক নম্রতা’ এবং তার জন্য বেত মেরে শেখানো কারো কারো জন্য উপযুক্ত বলে তিনি মনে করেন। ইংল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষ মানোন্নয়নে তিনি এই বেত ব্যবস্থা দ্বারা সফল হয়েছিলেন বলে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন। একই সাথে রাসেল এটাও মনে করেন যে আদর, আনন্দ ও ভালোবাসা দিয়ে শেখাতে যাওয়া মন্টেসরিও নিজ পদ্ধতিতে সফল হয়েছিলেন। এখন দুই পদ্ধতির তুলনা করলে আমরা বুঝতে পারবো কেন আমাদের দেশে কোথাও কোথাও বেত হাতে শেখানো সফল আবার কোথাও বা আনন্দের সাথে আদর করে শেখানো সফল। তুলনাটা সংক্ষিপ্ত করে বললে দাঁড়ায়-শুরুতে বেত দিয়ে শুরু করে শেষে আদর দিয়ে যদি শেখানো শেষ করা হয় তাহলে শেখানোর বিষয়টা হয় কড়া ওষুধের ডোজ চিকিৎসায় প্রথমে বেশি মাত্রায় সেবন করতে দিয়ে পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে মাত্রা কমিয়ে আনা এবং এক সময় এর ব্যবহার আর না করা। তবে আর্নল্ড এটা স্বীকার করেছিলেন শিভালরির যুগের অভিশাপ হিসেবে এটা ইউরোপে সংক্রমিত হয়েছিলো এবং জ্যাকোবিয়ান অভিসম্পাত হিসেবে ইংল্যান্ডে বেত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর্নল্ড এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছিলেন একজন শিশুকে যে বয়সে বেত লাগালে শেখে সে বয়সে বেত দিয়ে শেখানোর জন্য আর যে বয়সে বেত দেয়া থামিয়ে দিলেও শেখে সে বয়সে তা না দেয়ার জন্য। ফলে বেত সেখানে শেখানোর কাজে একটা প্রতীকী অংশ ছিলো।

অপরদিকে, মন্টেসরির বিদ্যালয়ে আনন্দ ও হাসিখুশির মাধ্যমে শেখানোটা ছিলো ডাক্তারের অভয় ও আশাব্যঞ্জক কথাবার্তার মত। যেখানে তা কাজ না করলে তিনি পরবর্তী পরিস্থিতিতে সহনীয় ও মৃদু মাত্রার ওষুধ দেন। তাও যদি কাজ না করে তাহলে ইনজেকশন আর এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেন। বিষয়টা ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ আর্নল্ড এর পদ্ধতির বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া।

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় আনন্দের সঙ্গে শেখানোর বিষয়টিকে অনেক বেশি সাদরে গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ অভিভাবক, শিক্ষাবিদ ও সরকার মনে করে যে লাঠিতে ছেলে ভয় পায়। এখন প্রশ্ন হলো, শাসনের জায়গায় যখন সোহাগ এসেছে পরীক্ষার জায়গায় তখন কী পরিবর্তন এসেছে? যদি তার পরিবর্তন না হয়ে থাকে তাহলে মূল্যায়নে পরিবর্তন আনা হয়েছে কি? আনা হয়ে থাকলে বাস্তবায়ন হয়েছে কী? বাস্তবায়ন হয়ে থাকলে তার ফিডব্যাক পর্যালোচনা করে নতুন কোনো ব্যবস্থা আনা হয়েছে কি? যদি তা না করা হয়ে থাকে তাহলে কীভাবে বেতের দ্বারা শেখানো পরীক্ষা পদ্ধতির সাথে সোহাগের দ্বারা শেখানো শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হয়? আর যদি তা করা হয়ে থাকে তাহলে শিক্ষা অর্জনের ফলে যে মূল্যবোধ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হবার কথা তা লক্ষণীয়ভাবে হচ্ছে না কেন? আসুন চিন্তা করি।

মূল্যায়নের উপযোগিতা ও প্রকারভেদ:

পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, বেত দিয়ে শেখানো কৌশলে মুখস্থ বিদ্যার ভার বেশি। আর আদর দিয়ে শেখানোর কৌশলে বুঝার এবং উপলব্ধি করার ভার বেশি। আবার এ কথাও অনস্বীকার্য যে একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক বেত দেখিয়ে পড়ালেও আরেকজন পড়ান আদর দিয়ে। বেতের কথা আগেই বলেছি। এখন আমাদের এই বিষয়টিও জানা দরকার যে অতি আদরেও ছেলে নষ্ট হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন একটি কথা সমর্থন করে প্রায়ই প্রচার করা হয় যে ‘আমার ছেলেকে শাসন করার তুমি কে?’ এই কথাটি যখন থেকে শিক্ষকের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে তখন থেকেই শিক্ষার গুণগত মান তলানিতে নেমেছে। সমালোচকগণ আপত্তি করে প্রশ্ন করতে পারেন যে, ‘শিক্ষার গুণগত মান বুঝাতে আপনি কোন কোন মানদণ্ড বুঝাতে চেয়েছেন?’ জবাবে বলতে পারি- শিক্ষা অর্জনের পর একজন শিক্ষার্থীর ইতিবাচক আচরণের অভ্যাস (সদাচরণ, বিনয়, সদালাপী ও আত্মসংযম), অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী সাড়া প্রদানের সক্ষমতা (কর্মলাভের পরীক্ষায় কিংবা আলোচনায়), কর্মক্ষেত্রে জ্ঞানের বাহ্যিক প্রয়োগ সক্ষমতা, সমাজে বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞাননির্ভর কৌশলের বহিঃপ্রকাশ, বস্তু ও বিষয় সম্পর্কে বহুমুখী চিন্তা করার সক্ষমতা (বিশ্লেষণ দক্ষতা) এবং সামাজিক, আর্থিক ও আত্মিক সুসম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা ইত্যাদি কতটা কাঙ্ক্ষিত হারে অর্জন করলো তার উপর ভিত্তি করে শিক্ষার গুণগত মান নির্ণয় করা যেতে পারে।

আলোচনার মূল বিষয়ে আসি। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান মূল্যায়নে বর্তমানে দু’ধরনের মূল্যায়ন করা হয়- সেমিস্টার/বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে সমাপনী মূল্যায়ন এবং ইনকোর্স, টিউটোরিয়াল বা এসাইনমেন্ট এর মাধ্যমে চলমান মূল্যায়ন। এদেশে সমাপনী মূল্যায়ন এতটা প্রকট ও গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে যে তা থেকে বের হয়ে আসা অসম্ভব। আবার চলমান মূল্যায়নকে এতটা হালকাভাবে নেয়া হয়েছে যে- তার শক্ত ভিত্তি স্থাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমান অবদান প্রয়োজন; সঙ্গে প্রয়োজন রাষ্ট্রের দৃঢ় সিদ্ধান্ত। সমাপনী লিখিত পরীক্ষা মাস ব্যাপী ঘণ্টার পর ঘণ্টা না নিয়ে সেটাকে মোট নম্বরের অর্ধেকে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। আবার চলমান মূল্যায়নে শিক্ষকদের নৈতিক অবস্থান শক্ত হওয়া আবশ্যক সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শতভাগ অংশগ্রহণ ও আন্তরিকতা দরকার। তবে এমন মূল্যায়নে শিক্ষকের নৈতিক দৃঢ় সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষার্থীর উপর তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ আপনা আপনিই নিশ্চিত হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে কাজটি প্রতিষ্ঠানে জোর দিয়ে করতে হবে তা হলো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাস চালু হলে অন্তত ১৫ কর্মদিবস সকল শিক্ষার্থীকে ক্লাসে নিয়ে আসার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা এবং এই সময়ে তাদেরকে শিখন, শেখানো, পাঠ্যক্রম এবং মূল্যায়ন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানদান করা এবং আসলেই তারা অবগত হতে পারলো কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করা। জ্ঞানী মানুষদেরকে বলতে শুনেছি যে, ‘কাজটা ভাল করে শুরু করতে পারলে অর্ধেক কাজ সুসম্পন্ন হয়ে যায়’।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জনের দ্বার উন্মুক্ত থাকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে সে কোন পদ্ধতিতে জ্ঞান অর্জন করবে সে সম্পর্কে শুরুতেই যদি ধারণা না পায় তাহলে তার কাছে অন্ধ লোকের হাতি দেখার মতই কখন ক্লাস, কখন পরীক্ষা, কী রকম ক্লাস, কী রকম পরীক্ষা, কী রকম মূল্যায়ন এসব নিয়ে সে যতটা চিন্তা করবে তাতে তার সমগ্র সময়ের অনেকটা ব্যয় হয়ে যাবে। ফলে শেখানোটা শিক্ষার্থীবান্ধব হবে না। কলেজ ভিত্তিক উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা কি শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পেরেছি? না পারলে আমাদের মূল্যায়ন কি কোনো গুণগত মানে পৌঁছেছে? আর পারলে আমাদের শিক্ষার্থীদের চিন্তার দক্ষতা এবং বুদ্ধিভিত্তিক দক্ষতা প্রদর্শনে এত দীনতা কেন? আসুন চিন্তা করি।

মূল্যায়ন’র বর্তমান হালচাল ও পরিমার্জিত মূল্যায়নের রূপরেখা এবং বাস্তবায়ন কৌশল:

এখন আসুন চলমান বা ধারাবাহিক মূল্যায়নের গুরুত্ব আলোচনা করি। ধারাবাহিক মূল্যায়ন শিক্ষার্থীর ধারাবাহিক শিখনফলের রেকর্ড। শিক্ষার্থী আজ যা শিখে কাল বা পরশু তার সবটুকু মনে রাখতে পারে না, সবটুকু মনে রাখার দরকারও নেই। তাই চলমান শিখনে শিক্ষার্থীর অগ্রগতির উপাত্ত সংরক্ষণের জন্য ধারাবাহিক মূল্যায়ন আবশ্যক। সবল ও দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে নিরাময়মূলক ব্যবস্থা নিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রয়োজন। সামষ্টিক মূল্যায়নের পর শিক্ষার্থীর উপর তার অর্জিত জ্ঞান এর উপর মন্তব্য করা জরুরি হয়ে পড়ে। তখন সবল আর দুর্বল সনদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোবল দুর্বল করে দেয়ার চেয়ে আগেই যত্ন ও চেষ্টা করে গেলে দুর্বলদের অনেকেই অগ্রগতি লাভ করার সম্ভাবনা থাকে। আর একজন দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীকে তুলে আনার মধ্যেই একজন শিক্ষকের সত্যিকারের সফলতা নির্ভর করে। না শিখিয়ে জ্ঞান যাচাই করতে যাওয়া এক ধরনের অনৈতিক কাজ। ধারাবাহিক মূল্যায়ন এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর চূড়ান্ত মূল্যায়নের পথে প্রতিনিয়ত মেধায় ও প্রচেষ্টায় শান দিয়ে অগ্রগতিমূলক জ্ঞান অর্জনের রাস্তা করে দেয়। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ক্লাস টেস্ট, ইনকোর্স, এসাইনমেন্ট, মিডটার্মসহ যতগুলো একটিভ পাঠদান শ্রেণিকক্ষে অনুষ্ঠিত হবে তার উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে ধারাবাহিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করা গেলে ক্লাসবিমুখী মনোভাব যেমন হ্রাস পাবে তেমনই সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য তার প্রস্তুতিও হবে আশাব্যঞ্জক।

বাস্তবায়ন কৌশল:

বর্তমান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইনকোর্স নম্বর আছে ১৫%, উপস্থিতির নম্বর আছে ৫%। কিন্তু এটাকে নিম্নোক্তভাবে পুনর্বণ্টন করা গেলে আরও যুগোপযোগী ও মানানসই হতে পারে- ইনকোর্সে ১০%; মিডটার্ম ২০% ; উপস্থিতির উপর ১০%; এসাইনমেন্ট এর উপর ১০%। ইনকোর্স, মিডটার্ম, এসাইনমেন্ট পরীক্ষাসমূহ মূল্যায়ন কোর্স-পাঠদানকারী শিক্ষক নিশ্চিত করবেন। সংশ্লিষ্ট কোর্সের চলমান মূল্যায়নে তিনি নীতি, আদর্শ ও রেগুলেশন অনুসরণ করবেন। দেশে যেহেতু শিক্ষক সংখ্যার তুলনায় শিক্ষার্থী বেশি তাই তিনি উপযুক্ত সময়ের মধ্যেই তার কোর্সের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করবেন। এক্ষেত্রে এমন হতে পারে যে প্রথমে তিনি তার কোর্সের ১০ টি ক্লাস শেষ করে ইনকোর্স নিবেন; পরবর্তী ১০ টি ক্লাস শেষ করে মিডটার্ম নিবেন; শিক্ষক যখন মিডটার্মের মূল্যায়ন করছেন শিক্ষার্থীরা তখন ৮ দিনের সময় নিয়ে ১০ নম্বরের টার্ম পেপার রেডি করবেন এবং স্বহস্তে লেখা এসাইনমেন্ট জমা দেবেন। যে সকল শিক্ষার্থী ধারাবাহিক মূল্যায়নে অংশ নিতে পারেনি তাদের জন্য ১২ দিন সময় দিয়ে মেকআপ পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। মেকআপ পরীক্ষায় ইনকোর্স ও মিডটার্মে যারা অগ্রগতি দেখাতে পারেনি তারাও তাদের ঘাটতি পূরণ এর জন্য মেকআপ পরীক্ষায় অংশ নেবে। এভাবে ৫০ নম্বরের একটি চলমান মূল্যায়ন পরীক্ষার অগ্রগতি বা শিখনফলকে আলাদা গ্রেড করে প্রকাশ করা হবে এবং অবশিষ্ট ৫০ নম্বরের সামষ্টিক পরীক্ষা নেয়া হবে। মেকআপ পরীক্ষায় ঘাটতি পূরণ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থীকে সামষ্টিক মূল্যায়ন পরীক্ষায় অংশ নিতে সুপারিশ করা হবে না।

সতর্কতা:

শিক্ষকের হাতে নম্বর আছে এবং তিনি চাইলেই তা দিয়ে দিতে পারেন এমন অপরাধমূলক, অনৈতিক ও প্রবঞ্চনার ধারণা থেকে শিক্ষকদের বের হয়ে আসতে হবে এবং শিক্ষার্থীকে তার জন্য সুযোগ করে দেয়া যাবে না। এমনটা হয়ে গেলে আরও অবনতি ও জ্ঞান অর্জনের অবনমনকে স্বীকার করে নিতে হবে।

সমাপনী মূল্যায়ন বা সামষ্টিক মূল্যায়ন পদ্ধতির গুরুত্ব:

শিক্ষার্থীর স্মৃতি পরীক্ষা, বিশ্লেষণ করার দক্ষতা, কেন ও কীভাবে ঘটনা ঘটে তার আলোচনা, সমালোচনা ও বর্ণনা করার দক্ষতা যাচাই’র জন্য সামষ্টিক মূল্যায়ন অপরিহার্য। সামষ্টিক মূল্যায়ন শিক্ষার্থীর চিন্তন দক্ষতা, ব্যাখ্যা করার দক্ষতা এবং সমালোচনা করার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। ফলে স্বাধীনভাবে একটি ঘটনা বা বিষয়কে যেকোনো সময় বিশদভাবে জানার, বুঝার ও বর্ণনার চিন্তাশক্তি উর্বর হয় সামষ্টিক মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে। এক্ষেত্রে তথ্য উপস্থাপন করতে গিয়ে শিক্ষার্থী স্মৃতি ও মস্তিষ্কের অতীত ঘটনার দারস্থ হবে, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদানের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করবে এবং নিজের যুক্তি ও জ্ঞানমূলক চিন্তার পসরা সাজিয়ে বসবে।

প্রয়োগ কৌশল:

সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ নম্বরের হবে। এক্ষেত্রে অনুধাবন, প্রয়োগ ও বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন করা কর্তব্য। বর্তমানে অতি সংক্ষিপ্ত নামে জ্ঞানমূলক, সংক্ষিপ্ত নামে অনুধাবনমূলক এবং প্রয়োগ ও দক্ষতা যাচাই’র জন্য রচনামূলক প্রশ্ন করা হয়। সামষ্টিক মূল্যায়ন থেকে জ্ঞানমূলক প্রশ্ন বাদ দেয়া উচিত। প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে জোড় বিজোড় সালের প্রশ্ন হুবহু কমন পড়ার যে লক্ষণীয় দৃষ্টান্ত তা থেকে সরে এসে প্রশ্নে নতুনত্ব নিয়ে আসতে হবে। পাঠদান করা টপিকস’র উপর প্রশ্ন করার হার ৮০% রেখে পাঠদান হয়নি কিন্তু শিক্ষার্থীদের জানা উচিত এমন প্রশ্ন ২০% রাখা উচিত। বর্তমান পাবলিক পরীক্ষার মতই তার কার্যক্রম চলতে পারে। পরীক্ষার সময় ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট নির্ধারণ করা যেতে পারে। পরীক্ষার কার্যদিবসে ১ দিনের বেশি বিরতি রাখা অনুচিত হবে।

ফলাফল ও নিরীক্ষণ:

৫০ কর্মদিবসের মধ্যেই দুটি মূল্যায়নের চূড়ান্ত গ্রেড প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। সামষ্টিক মূল্যায়ন’র ফলে অনুত্তীর্ণ কিন্তু চ্যালেঞ্জ করেছে এমন শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র পুনরায় মূল্যায়ন করা উচিত যা বর্তমানে নিরীক্ষা করেই সমাপ্ত করা হয়। অনুত্তীর্ণ হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের অধীনে ১৫ কর্মদিবসের নিবিড় পাঠদানে কোর্স সংশ্লিষ্ট সকলকে দেয়া যেতে পারে। শিক্ষক তাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন। উপযুক্ত মূল্যায়ন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ কর্মদিবস’র মধ্যে পাঠাবে যেন পরবর্তী ১৫ কর্মদিসের মধ্যে গ্রেড সমন্বয় করা যায়।

সতর্কতা:

চূড়ান্ত পরীক্ষার উত্তরপত্র বিতরণে সময়ের ব্যয় আরও কমাতে হবে, আরও স্বচ্ছ হতে হবে। শিক্ষকের মূল্যায়নকালীন অবস্থান ও নিবিড় পাঠদানকালীন অবস্থান আরও স্বচ্ছ, মানসম্পন্ন ও নৈতিক-মূল্যবোধসম্পন্ন হতে হবে। অন্যথায় শিক্ষকের গুণ ও মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষার্থীর শিখনে আরও অবনমন হতে পারে।

বিশেষ সতর্কতা:

এই মূল্যায়ন পদ্ধতি কেবলমাত্র কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ব্যবহারিকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সুতরাং চলমান মূল্যায়নের কৌশলে মিডটার্মের ২০ নম্বরের জায়গায় ব্যবহারিক এর ২০ এবং এসাইনমেন্ট’র ১০ নিয়ে আসা যেতে পারে।

উপসংহার:

শিক্ষার্থীদের শিখন নির্ভর করে শিক্ষকের কার্যকর পাঠদান, শিক্ষার্থীর নিজের শিখন প্রচেষ্টা ও তৎপরতা এবং এই দুটো শিখনের মূল্যায়ন কীভাবে হবে তার উপর। একজন শিক্ষার্থীর সব সময় লক্ষ থাকে ভাল গ্রেড অর্জন। কিন্তু এর জন্য যে ভাল শিখন ও জ্ঞান অর্জন দরকার তা সকলে ভাবে না ও সে অনুযায়ী কাজ করে না। অপরদিকে, একজন শিক্ষকের লক্ষ থাকে শিক্ষার্থীকে কার্যকরভাবে শিখিয়ে, জ্ঞান অর্জন করিয়ে তার শিখনফল সর্বোচ্চ করা যাতে করে সে সমাজের জন্য ও দেশের জন্য সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, একজন শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও আত্মিক উন্নতির দ্বারাই সমাজ, দেশ ও বিশ্ব উপকৃত হতে পারে। আর এর জন্য পাঠ্যক্রম, পাঠদান, শিখন-শেখানো এবং মূল্যায়ন হওয়া উচিত ভারসাম্যপূর্ণ ও নৈতিক। নীতিবিহীন শিক্ষা আর উপযুক্ত মূল্যায়নবিহীন গ্রেড দুটোই জাতি ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। অতএব, মূল্যায়নে আমাদের আরও মূল্য দেয়া উচিত।

লেখক: প্রভাষক (রাষ্ট্র্রবিজ্ঞান), ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত