ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২০ মিনিট আগে
শিরোনাম

জাসদ: বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল দর্শন

  মোস্তফা কামাল পাশা

প্রকাশ : ১২ জুন ২০২১, ১৪:১২

জাসদ: বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল দর্শন
ছবি- নিজস্ব

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এতদিনে বাংলাদেশ হতো বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ। এদ্দুর পড়ে নিশ্চয়ই আপনার কপালে গভীর ভাঁজ পড়েছে! অবিশ্বাসে পড়া বাতিল করে কোন অশ্লীল শব্দও বেখেয়ালে বমি হয়ে যেতে পারে। সব ঠিক আছে। তবুও অনুরোধ, ধৈর্যে কুলোলে একটু মনোযোগ ধরে রাখুন। খুব অল্পতেই শেষ করার চেষ্টা করবো।

আপনারা জানেন, বঙ্গবন্ধু হানাদার পাকি দস্যুদের আঁচড়ে-কামড়ে ক্ষত বিক্ষত দেশটির মেরামতি নিয়ে ৭২ সালের শুরু থেকে যখন ব্যাস্ত, তখন নিজ দলের কিছু উচ্চাভিলাষী রাতারাতি ভাগ্য গড়ার প্রতিযোগিতায় নামে। ভাঙা কল কারখানা থেকে শুরু করে সামনে যা পায় তাই গিলতে থাকে। এনিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনেক খেদোক্তি আছে। টানলে লম্বা হবে। রাক্ষস সামলাতে এমপিসহ অনেক বড় নেতাকে দল থেকে বিতাড়িত করেন। জেলে ঢুকান। ঘর সামলাতে ব্যাস্ত বঙ্গবন্ধুর সামনে আরেকটি ভয়ঙ্কর দানব উঠে দাঁড়ায়। সেটা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী জাসদ।

শ্রেণি সংগ্রাম ত্বরান্বিত করে শোষিতের বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রোমান্টিক ডাকে অনেক হতাশ ও উচ্চাকাঙ্খি যুদ্ধ ফেরত তরুণ দলটিতে যোগ দেয়। মওকাবুঝে পলাতক পাকি দালাল, যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার আল বদর, জামাত, মুসলিম লীগের পান্ডারাও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নিরাপদ আলখেল্লায় আশ্রয় নেয়। এরাও রাতারাতি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জজবাধারী সৈনিক! এই মতবাদের নেপথ্য আব্বাজান, গুরু, ঋষী, দাদা যে নামেই ডাকুন, সিরাজুল আলম খান। ৬২'র বিপ্লবী বাংলা তথা ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস তত্বের ( তাত্বিকদের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে এখন অনেক নতুন বিতর্ক) অণুগ্রুপের একজন তিনি। ষাট দশকের আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান থাকলেও বিতর্কিত। বিতর্ক এড়িয়ে আমরা তার অবদানটা স্বিকার করি!

দাদা '৭২ এ হয়ে গেলেন কাপালিক বাবা। নতুন তথ্যে উঠে এসেছে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হওয়ার প্রতিযোগিতার দৌড়ে তিনি তদানিন্তন শীর্ষ ছাত্রলীগ নেতা ও তোফায়েল আহমেদের কাছে হেরে যান। হারের শোধ নিতে বিকল্প বঙ্গবন্ধু হওয়ার দুঃস্বপ্নে হাজির করেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের উদ্ভট তত্ব। সমাজতন্ত্রের আগে বৈজ্ঞানিক শব্দ প্রয়োগ হয়না। আকর্ষণ বাড়াতে তিনি যোগ করেন নতুন মশলা। তত্বের বীজ থেকে জনম হয় জাসদ বা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। এভাবে জাসদ ও এর ছাত্রফ্রন্ট ও মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের জন্ম হয় একের পর এক।

সবগুলোর নির্যাসে সশস্ত্র গণবাহিনী ও অন্তর্ঘাতি গ্রুপ গড়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে মার্কস বা ষ্ট্যালিনের চে'ও বড় কেউকেটা হওয়ার উচ্চাভিলাষী অভিযান শুরু করেন। কর্ণেল তাহেরকে দায়িত্ব দেন সেনাবাহিনীতে ষড়যন্ত্রের বিষ ঢুকিয়ে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গড়ার। তাহের সফল তাঁর মিশনে। পাটকল-গুদাম, খাদ্য গুদামে আগুন, ডাকাতি, লুন্ঠন, থানায় আগুন, নেতা, এমপি, পুলিশ হত্যা, ভারতীয় হাই কমিশনে হামলা, আওয়ামী, ছাত্রলীগ নেতা খুণসহ হেন দুস্কর্ম নেই, যা কাপালিক দাদা জাসদকে দিয়ে করাননি। নেপথ্যে তাকে সিআইএ এবং পাকি আইএসআই এর ব্যাপক সমর্থন দেয়ার গুন্জন আছে। স্বাভাবিক, পাকি দালালেরা যেহেতু তার 'বিপ্লবের সৈনিক', তখন ওদের বাপজানেরাতো দেখভালতো করবেই।

একদিকে কাপালিক দাদা, আবার পিকিংপন্থী গলাকাটা সর্বহারার অসংখ্য গ্রুপ, সাথে ঘরের শত্রু বিভীষণ, সর্বভুক কিছু নেতার উপদ্রবে দিশাহারা বঙ্গবন্ধু! তিনি রক্ষি বাহিনী গড়ে পরিস্থিতি সামালের চেষ্টা করেন। রক্ষি বাহিনী অন্যদের পাশাপাশি দলীয় রাক্ষসদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।

একেতো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ! সেটা পুনর্গঠন করবেন, না এত গৃহশত্রু সামলাবেন? এরমধ্যে '৭৪'র ভয়াল খাদ্য সঙ্কট, কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ । সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থা একেবারে দিশাহীন। সাথে মোশতাক, ঠাকুর, চাষীচক্র আছে ছোবল হানার সুযোগের অপেক্ষায়। ভীষণ সমস্যার মাঝেও নেতৃত্বের প্রজ্ঞায় '৭৪'র দুর্ভিক্ষ সামাল দেন বঙ্গবন্ধু। মার্কিনীরা খাদ্যবাহী জাহাজ আটকে দিয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যা বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য কোন নেতার পক্ষে সামাল দেয়া কখনো সম্ভব হতোনা। কঠিন অবস্থার মাঝেও বঙ্গবন্ধু পণ করেন, সব বিপদ মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে বিশ্বসেরা সমৃদ্ধ সুখী দেশ হিসাবে গড়ে তুলবেনই তিনি।

এ লক্ষে ৭৫ এর জানুয়ারিতে বাকশাল দর্শন ঘোষণা করেন। এটা এমন এক দর্শন যা বাস্তাবায়িত হলে জাতি, সম্প্রদায় ও শ্রেণীগত বিভক্তি নির্মুল শুধু নয়, ঘুষ, দুর্নীতি,অপশাসন, শোষণ,বৈষম্য নামে কোন শব্দই আজ থাকতোনা। প্রতিজন মানুষ হতেন স্বয়ম্বর, ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত। নেতা উঠে আসতেন মাঠ পর্যায় থেকে গণ মানুষের সমর্থন নিয়ে যোগ্যতার পরিক্ষায় পাশ দিয়ে। ভোটে টাকার কোন খেলা থাকতোনা। অযোগ্য কারো পক্ষে নেতা বা এমপি হওয়ার সুযোগ থাকতোইনা। প্রতিটি গ্রাম হতো সমবায় ভিত্তিক স্বয়ংসম্পূর্ণ এক একটি সমৃদ্ধ জনপদ বা উপশহর। থাকতো শিক্ষা, বাসস্থান, আধুনিক চিকিৎসা সেবার সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা। টাকার অভাবে উচ্চ শিক্ষা বা চিকিৎসা সেবা থেকে কোন নাগরিক বঞ্চিত হতোনা। সর্বাধুনিক এবং অসাধারণ এক আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক দর্শন বাকশাল ! কিন্তু এই যুগান্তকারী দর্শন বাস্তবায়নের ন্যূনতম সুযোগ বঙ্গবন্ধুকে দেয়া হয়নি! রক্তপায়ী কাপালিক দাদা যে রক্তের খেলা শুরু করেন, তার আড়ালে নিষ্ঠুরতম প্রাসাদ যড়যন্ত্রের প্রথম শিকার হতে হলো সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে।

বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসের বাঁক বদলকারি বাকশাল দর্শনকে '৭৫ এর সর্বকালের নৃশংস হত্যাকান্ডের সুফলভোগী বিএনপি-জামাতচক্র ভয়াল দানব হিসাবে চিহ্নিত করে জনগনকে বিভ্রান্ত করে চলেছে এখনো। অথচ বাকশাল দর্শনের উপর তথ্য ব্যাঙ্ক ও ভাল বই বাজারে আছে। এরপর ভয়াল জেল হত্যাকান্ড,খালেদ মোশাররফ হত্যাকান্ড, জিয়ার উত্থান সবকিছুতেই আড়ালের খেলোয়াড় কাপালিক দাদা সিরাজুল আলম খান। প্রকাশ্যে তার খোলস জাসদ। কিন্তু জিয়া কাপালিক দাদার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে কোরবানী গরুর নাড়িভুঁড়ির মতো চিরতরে মাটিচাপা দিয়ে ঋষী দাদাসহ সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে আপ্যায়িত করেছেন! জিয়া পথের কাঁটা সাফ করতে কাপালিক দাদাকে দিয়ে জেলের ঘানি ঘুরিয়েছেন অর্ধযুগ। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার জনক ও ৭ নভেম্বর তথাকথিত সিপাহি জনতার উত্থানের নায়ক কর্নেল তাহেরসহ অনেকে বিচারের নামে খুন হয় জিয়ার হাতে। অথচ কর্ণেল তাহেরই ইঁদুরের গর্তে লুকানো জিয়াকে উদ্ধার করে সেনাপ্রধান করেন। এরপর সাধের জাসদও কাঁচের চুড়ির মত ভেঙেচুরে ছত্রখান! এখন সাগরেদরাও নানা উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে কোন কোন বড় দলের ন্যাওটা!

দীর্ঘ বেকার ও ঘেরাটোপে থাকা কাপালিক জীবন থেকে আত্মীয় ও প্রিয় সাগরেদ পেয়ারা, ক'বছর আগে প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় এবং আরেক শিষ্য পির হাবিব বসুন্ধরার বাংলাদেশ প্রতিদিনে সাফ সুতরো ও সিল্কি ওয়াস করে দাদাকে তুলে আনার চেষ্টা করেছে। আড়ালের রহস্য মানব বা দানবের পাঁচতারা মানের বিপুল চাহিদা যোগানো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ও কর্পোরেট পুঁজির বোয়ালেরা সহায়তা বন্ধ করে দেয়ায় টান পড়ে তার রসদে! তাই রহস্যের পর্দা ফাঁক করে আলোয় এনে বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডে সাজানো হয় কাপালিক দাদাকে! পাশাপাশি তার ৭২/৭৫ এর ভয়ঙ্কর রক্তাক্ত দানব চেহারায় চুনকামের কসরতও চলছে।

কাপালিক দাদা এখন ঝুরঝুরে স্ক্র্যাপ! তিনি দেশের কতোবড় ক্ষতি করেছেন, ইতিহাস একদিন তার সাক্ষ্য দেবেই। আজ প্রিয় দেশে দুর্নীতি, ঘুষ, মাফিয়া কর্পোরেট ও রাজনৈতিক দানবের বীভৎস উল্লাস! জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরলস চেষ্টায়ও বিষফোঁড়া নির্মূল কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছেনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঘোষিত বাকশাল দর্শন বাস্তবায়িত হলে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ, মাফিয়া কর্পোরেট, দুর্নীতি, ঘুষ, অনাচার, বৈষম্যের মত শব্দগুলো অভিধানে থাকতো কিনা সন্দেহ প্রচুর। জানামতে কাপালিক দাদা সিরাজুল আলম খান অসুস্থ। জীবনের শেষ অধ্যায়ে হলেও দাদা তার ভুল স্বিকার করেন কিনা, জানিনা! করলে হয়তো কিছুটা শাপমোচন হতেও পারে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত