ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

পুনর্গঠনেও ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে বিএনপি

  মজুমদার ইমরান

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২২, ১৮:৪৮  
আপডেট :
 ১৪ জুন ২০২২, ১৯:০৯

পুনর্গঠনেও ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে বিএনপি

দলের পুর্নগঠনেও ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে বিএনপি। ক্ষোভের আগুন তৃণমূলেই বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সরকারকে বাধ্য করতে সামনের দিনগুলোতে একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে দলকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে দলটি।

উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলায় মেয়াদউর্ত্তীণ কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে। এসব কমিটি করতে গিয়ে যত বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। আহবায়ক বা আংশিক ঘোষিত কমিটি নিয়ে বিভিন্ন জেলায় দেখা দিয়েছে কোন্দল। মান অভিমানে পদত্যাগের ঘটনাও ঘটছে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনের সময় ত্যাগী ও যোগ্যদের বাদ দেয়া হচ্ছে।

কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনেও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে তৃণমূলের মতামত। ফলে অনেক ত্যাগী নেতা স্বেচ্ছায় নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত বিএনপির মোট ছয়টি জেলা কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। যার প্রত্যেকটিতেই কেন্দ্র থেকে কোনো না কোনোভাবে হস্তক্ষেপের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি কুমিল্লা উত্তর ও দক্ষিণ জেলা এবং কুমিল্লা মহানগর কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটি ঘোষণার পরপর কুমিল্লা মহানগর বিএনপির ঘোষিত কমিটি পছন্দ হয়নি জানিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন নবগঠিত কমিটির আহবায়ক আমিরুজ্জামান। একই সঙ্গে কমিটিতে তার অনুসারীরা প্রত্যাশিত পদ না পাওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে দলীয় নেতা-কর্মীদের। প্রত্যাশিত পদ না পাওয়ায় দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা গণপদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন। তারা কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব জসিম উদ্দিন ও নবগঠিত মহানগর কমিটির সদস্যসচিব ইউসুফ মোল্লা ওরফে টিপুর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা ব্যক্তিরা সবাই কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের অনুসারী।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি আমিরুজ্জামানকে আহবায়ক ও কুমিল্লা মহানগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা টিপুকে সদস্যসচিব করা হয়। এই কমিটিতে মহানগর যুবদলের সভাপতি উত্বাতুল বারীকে ১৪ নম্বর যুগ্ম আহবায়ক করা হয়। মূলত এতেই ক্ষুব্ধ হন মহানগর বিএনপির নবগঠিত কমিটির আহবায়ক আমিরুজ্জামান। এর পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই গেরের বাদুড়তলা এলাকায় দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়কের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে আমিরুজ্জামান বলেন, এ কমিটি আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করেছে। যারা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের কাছে গিয়ে মামলা প্রত্যাহার করে নেন, তাদের দলের সদস্যসচিব করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে জীবনে একটি জিডি হয়নি, তাঁরা দলের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। আমি যাদের নিয়ে রাজনীতি করব, তারা যদি দলে ভালো পদ না পান, তাহলে কাদের নিয়ে রাজনীতি করব? উত্বাতুল বারী মহানগর যুবদলের সভাপতি ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি। তাকে করা হয়েছে মহানগর বিএনপির ১৪ নম্বর যুগ্ম আহবায়ক। এ অবস্থায় আমি মহানগর বিএনপির আহবায়ক পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিচ্ছি।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির ৪১ সদস্যবিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। কমিটিতে সাবেক সংসদ সদস্য আমিন উর রশিদ ইয়াছিনকে আহবায়ক এবং ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি জসিম উদ্দিনকে সদস্যসচিব করা হয়।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক রেজাউল কাইয়ুম বলেন, যাকে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব করা হয়েছে, তাঁর নামের আগে ‘পাগলা’ শব্দ আছে। তাঁকে মানুষ পাগলা জসিম বলে। তাঁর বাড়ি ভারতীয় সীমান্ত এলাকায়। তিনি মাদক ও সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। টাকার বিনিময়ে এ কমিটি আনা হয়েছে।

কুমিল্লা মহানগর ও দক্ষিণ জেলা কমিটি নিয়ে ক্ষোভ দেখা দিলেও কুমিল্লা উত্তর জেলার ৪১ সদস্যবিশিষ্ট আহবায়ক কমিটি নিয়ে কোনো ধরনের ক্ষোভের কথা জানা যায়নি। এতে আক্তারুজ্জামান সরকারকে সভাপতি এবং এ এফ এম তারেক মুন্সীকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

এদিকে কমিটি ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে কুমিল্লা মহানগর বিএনপির আহবায়কের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় আমিরুজ্জামানকে। দলীয় শৃঙ্খলাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে কুমিল্লা মহানগর বিএনপির আহবায়ক আমিরুজ্জামানকে সংগঠনের প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর স্থলে কমিটির প্রথম যুগ্ম আহবায়ক শওকত আলীকে আহবায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়।

গত ৭ জুন রাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আমিরুজ্জামানকে অব্যাহতি দিয়ে চিঠি দেয়া হয়।

জানা গেছে, তিন দফা তারিখ পরিবর্তনের পর গত ২ এপ্রিল চাঁদপুর জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু জেলার বিবদমান দুই অংশকে সমন্বয় না করে একতরফাভাবে একটি অংশকে সমর্থন জানিয়ে কেন্দ্রের একটি পক্ষের যোগসাজশে কাউন্সিলের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয় নতুন কমিটি। বর্তমানে চাঁদপুর জেলায় দুটি কমিটি বিদ্যমান। সম্মেলন ঘিরে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বাচন হলেও তা হয়েছে দ্বিধাবিভক্তির। একক নির্বাচন কমিশনের অধীনে এক জায়গায় ভোট হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে চার জায়গায়। ভোটের হিসাবেও ছিল গড়মিল।

নেতাকর্মীরা জানান, জেলা সম্মেলনে মোট সাতজন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনই একটি অংশের নেতৃত্বে ছিলেন। জেলার চার এমপি প্রার্থীও এই অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সম্মেলনে মোট ভোটার (কাউন্সিলর) এক হাজার ৫১৫ জন। এর মধ্যে মৃত ও প্রবাসী ৫১ জন। আট উপজেলা ও সাত পৌর কমিটিসহ সব ইউনিটের কাউন্সিলরদের ভোট হয় চাঁদপুর শহর, হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তিতে। এখানে পড়ে ৮০৪ ভোট। এতে সাতজন প্রার্থীর মধ্যে সভাপতি পদে প্রকৌশলী মমিনুল হক ৭১১ ভোট ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা খান সফরী ৬৫৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কাউন্সিলরদের এই ভোট দেওয়ার উপস্থিতির স্বাক্ষর, গোপন ব্যালট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কাগজপত্র তাঁদের কাছে রয়েছে বলে নেতারা জানান।

অন্যদিকে জেলা সদরে ভোট দেখানো হয় ৯৯২। প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে সভাপতি প্রার্থী শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক পেয়েছেন ৯২৭ ভোট ও সাধারণ সম্পাদক পদে অ্যাডভোকেট সলিম উল্লাহ সেলিম ৮৯২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কাউন্সিলে উপস্থিত বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া এই কমিটিকে বৈধ ঘোষণা করেন।

বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা জানান, জেলা সদরে সঠিক ভোট গ্রহণ হলে সেখানে সর্বোচ্চ ৬৬০ ভোট পড়ার কথা। কিন্তু ভোটের হিসাবে সেখানে ৩৩২ ভুয়া ভোট দেখানো হয়েছে। তাঁদের চ্যালেঞ্জ করলে ওই ভুয়া ভোটের হিসাব মেলাতে পারবেন না। তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া একটি পক্ষকে সমর্থন করেই সম্মেলন প্রস্তুত করেন। কেন্দ্রীয় নেতারা বিবদমান কিংবা সব এমপি প্রার্থী কিংবা সম্মেলনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীদের নিয়ে বসেননি। শুধু একতরফাভাবে ভুয়া, জাল ভোট আর গোজামিলের সম্মেলন করে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। সম্মেলনের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশনও বিএনপির গঠনতন্ত্র ভঙ্গ করেছে। গঠনতন্ত্রের ১৫ (খ) ধারা অনুযায়ী 'এক নেতার এক পদ' নিয়মে এই সম্মেলনে শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক অংশ নিতেই পারেন না। তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রবাসী কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তা আমলে নেওয়া হয়নি।

চাঁদপুর জেলার মতো সিলেট জেলা কমিটিতেও কেন্দ্রের প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ ছিল। যে কারণে ওই কাউন্সিলে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নিজের নাম প্রত্যাহারের পর কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।

কমিটি গঠনে ক্ষোভের বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, বিএনপি একটি বড় দল । এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকে। অনেকেই নেতৃত্ব আসার যোগ্য থাকেন। কিন্তু সবসময় সবাইকে হয়ত সেভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় না। ফলে কোথাও কোথাও নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তবে দিন শেষে সবাই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মেনেই রাজনীতি করেন। তবে গুরুতর অভিযোগ কারো বিরুদ্ধে থাকলে দলের হাইকমান্ড তা বিবেচনায় নিয়েরে ব্যবস্থা নেবেন।

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত