ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১০ মিনিট আগে
শিরোনাম

করোনা ঠেকাতে যেভাবে সফল ভুটান

করোনা ঠেকাতে যেভাবে সফল ভুটান
বিনামূল্যে স্যানিটাইজার দিচ্ছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী

গত ৬ মার্চ সকালে ভুটান জেগে উঠেছিল দেশে প্রথমবারের মতো করোনভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ নিয়ে। কিন্তু কুয়েন্সেলে আমরা দুটি সংবাদপত্র বিছানায় ফেলে রেখে অফিসে চলে গিয়েছিলাম। ওই সংবাদপত্র দুটিতে কোভিড -১৯-তে আক্রান্ত হওয়ার খবরটি গুরুত্বে সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছিল।

প্রথমে সবাই অনুমান করেছিল, এর আগে যেই জার্মান দম্পতিকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে হয়তো তাদের দেহেই মিলেছে করোনার জীবাণু। কিন্তু পরে জানা গেল, ৭৯ বছর বয়সী এক আমেরিকান পর্যটকের দেহে মিলেছে করোনাভাইরাস। কার দেহে করোনা সনাক্ত হয়েছে সেটা কোনও ব্যাপার নয়; গুরুত্বপূর্ণ হলো ভুটানে করোনা হানা দিয়েছে। চীনের মাটিতে করোনা সনাক্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রায় দু মাস পর ভুটানের মাটিতেও দেখা দিল এই ভাইরাস।

তবে ভুটানের জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল এর প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে এটি ছড়িয়ে পড়লে করোনা ছড়িয়ে পড়া। এমনটি হলে ভুটানে এই ভাইরাস ঠেকানোটা কিছুটা কঠিন হবে বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য আসাম, পশ্চিমবঙ্গ (পরে এই রাজ্যে দুইজন আক্রান্ত হয়েছে) ও অরুনাচল প্রদেশে করোনা আঘাত হানেনি।

এছাড়া কোয়ারান্টাইনে থাকা ভুটানিরা ফুয়েনশোলিং (দক্ষিণ ভুটানের একটি সীমান্তবর্তী শহর) হয়ে তাদের বাড়িতে ফিরে যাওয়ায় সেখানকার লোকজন আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিও একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এই শহরটিতে ৩ হাজারের বেশি ভুটানিজদের পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যক শিক্ষার্থী, সন্ন্যাসী এবং বাইরে কর্মরত লোকজন রয়েছে।

ভুটানে প্রথম করোনা সংক্রামণের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ১ লাখ ভুটানির স্বার্থ বিবেচনা করে দেশটিতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কেননা দেশটির অর্থনীতির একটি বিরাট অংশই পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল। এটি সরকারের একটি বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত ছিল।

ভুটানে করোনা সংক্রামিত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সরকার নানা উদ্যোগ নেন যা ঠেকাতে অনেক কাজে দিয়েছে। দেশজুড়ে সর্বত্র জীবাণুনাশক বিলি, মোবাইল করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র চালু হয়েছে। সেই সঙ্গে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা। যার ফলে শনিবার (২১ মার্চ) শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ভূটানে কোনো করোনা রোগী নেই। ভুটান সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনা সন্দেহে কোয়ারেন্টাইন থাকা সর্বশেষ ১৪ জনকে বৃহস্পতিবার (১৯ মার্চ) ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এক্ষেত্রে দেশের নিবেদিতপ্রাণ চিকিত্সক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদান অতুলনীয়। একই সঙ্গে দেশের নাগরিকদেরও প্রশংসা করতে হয়। একজন ভুটানি নাগরিক দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও ঐক্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। আমরা দেশের সঙ্কট মোকাবেলায় কখনও পার্লামেন্টর ফরমানের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকি না, যখন যেটা করার প্রয়োজন তা নিজেরাই করতে শুরু করি। আমরা করোনা ঠেকানোর ক্ষেত্রেও নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছি।

যে কারণে ভুটানকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আমরা যে কোনও উৎসব একসঙ্গে উদযাপন করি। তেমনিভাবে যেকোনও বিপদও সবাই একসঙ্গে মোকাবেলা করি। যেন আমরা সবাই একটা পরিবারের সদস্য। যদি কাজগুলি সম্পন্ন করতে হয়, আমরা কাজটি সম্পাদনের ক্ষেত্রে সমান দায়িত্ব ভাগ করি এবং যখন আমরা কোনও সমস্যার মুখোমুখি হই তখন একসাথে আমরা সমস্যাটির সমাধান করি। এর সর্বোত্তম উদাহরণ হচ্ছে সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় (করোনাভাইরাস)। এই দুর্যোগের কথা শুনে প্রত্যেকে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যেন তারা নিজেরাই দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আমি বলি এটি অনুকরণীয় এবং এমন একটি বিষয় যা আমাদের লালন করা উচিত।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও) গত ১১ মার্চ কোভিড -১৯ কে মহামারি হিসাবে ঘোষণা করেছ। চীনের বাইরে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এর বিস্তার রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আজ অবধি চীনের বাইরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দেশ ইতালি, স্পেন, ইরান, ফ্রান্স ও জার্মানি । ইতালি লকডাউনে রয়েছে এবং মৃতের সংখ্যা এখানেই সবচেয়ে বেশি, ৪০৩২ জন।

ইরানে ভাইরাসটি সংখ্যক উচ্চ আধিকারিককে সংক্রামিত করেছে যার মধ্যে ১১ জন সহ-রাষ্ট্রপতি, একজন উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং সংসদের কমপক্ষে ২৪ সদস্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এখানে মোট মারা গেছেন ১৪৩৩ জন।

শুক্রবার পর্যন্ত এই ভাইরাসে ১৮৫টি দেশ বা অঞ্চলের মোট ২ কোটি ৭৫ হাজার ৯৯৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৪০২ জন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া করোনা মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছে।

আরও একটা বিষয়ে আমরা আশার আলো দেখছি, সেটি হচ্ছে সুস্থ হয়ে উঠার সংখ্যা। করোনায় আক্রান্ত শতকরা ৫৩ ভাগেরও কোনও ঝুঁকি নেই এবং ৯১ ভাগই সুস্থ হয়ে উঠছেন। শুক্রবার পর্যন্ত এই ভাইরাস থেকে সুস্থ হয়েছেন ৯১ হাজার ৯৫২ জন।

ভুটানের মোট ১৪২ জনের করোনা টেস্ট করা হয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র একজনের দেহে করোনা জীবাণু মিলেছিল। আগেই বলেছি, দেশটিতে বর্তমানে কোনও করোনা রোগী নেই। করোনা প্রাথমিকভাবে দেশের দৈনন্দিন জীবন ও ব্যবসায় কিছুটা প্রভাব ফেললেও বর্তমানে পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। করোনা ঠেকাতে আমাদের ধর্মও অনেকখানি প্রভাব ফেলেছে।

কোভিড -১৯ ভীতি আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়েছে। যেহেতু নজরদারি ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার প্রথম লাইন, তাই ভুটানের সততা এবং অখণ্ডতার সর্বোচ্চ গুরুত্ব রয়েছে। আর নিরাপত্তার স্বার্থে ভুটানে বহিরাগতের প্রবেশও অনেক কড়াকড়ি আরেপ করা হয়েছে। জনগণের সুরক্ষার জন্য ভুটানে প্রবেশ করা কোনও ব্যক্তির ভ্রমণ ইতিহাস জানা গুরুত্বপূর্ণ।

আর একটা হচ্ছে ভুয়া সংবাদ, যেগুলো জনজীবনে কেবল আতঙ্কই ছড়ায়। করোনার বিস্তার রোধে আমাদের এসব ভুয়া সংবাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হবে। কোন মতেই সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ছাড়ানো যাবে না। কেননা এটা আতঙ্কিত হওয়ার বা আতঙ্ক ছড়ানোর সময় নয়।

‘আমি বিশ্বাস করি আমরা পারব। আসলে, আমি জানি যে আমরা পারি। আমি সবসময় বিশ্বাস করি যে প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে একটি সুযোগে পরিবর্তন করা যেতে পারে। আজ আমি জানি যে আমাদের দেশ অনেকগুলি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে এবং আমরা সামনের বছরগুলিতে আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হব তবে আমি বিশ্বাস করি যে আমরা যদি সর্বদা এগিয়ে থেকে পরিকল্পনা করি, যদি আমরা আমাদের চ্যালেঞ্জগুলি বুদ্ধিমানের সাথে এগিয়ে যাই, যদি আমরা কঠোর পরিশ্রম করি, তবে আমরা কেবলমাত্র এই চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে পারি না তবে এছাড়াও আমাদের যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে সেগুলি একটি সুযোগে পরিবর্তিত হতে পারে।’

মূল লেখক: বাচ্চু ফুব দোরজি

অনুবাদ: মাহমুদা আকতার

দ্য স্ট্রেইটস টাইমসের সৌজন্যে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত