ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

মুসলমান বিদ্রোহীর জীবন নিয়ে সিনেমা, হিন্দুদের আপত্তি

মুসলমান বিদ্রোহীর জীবন নিয়ে সিনেমা, হিন্দুদের আপত্তি
ছবির পোস্টার

প্রায় একশো বছর আগে ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে নিহত এক মুসলিম নেতার জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে ভারতের কেরালা রাজ্য। কিন্তু এ নিয়ে আপত্তি তুলেছে দেশটির কট্টর হিন্দুরা। তারা ওই মুসলিম নেতাকে লুটেরা ও ঘাতক বলে প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী নামের ওই নেতা মালাবার বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আর ব্রিটিশ শাসন উপেক্ষা করে প্রায় ছ'মাস নিজের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ঐতিহাসিকরা তাকে এতদিন ধরে বিদ্রোহী নেতা হিসাবেই বিবেচনা করে আসছিলেন। কিন্তু তাকে নিয়ে নতুন একটি সিনেমা তৈরির ঘোষণা দেয়া মাত্রই দক্ষিণপন্থী ঐতিহাসিকদের একাংশ বলতে শুরু করেছেন, কুঞ্জাহামেদ বিদ্রোহী নন। তিনি একজন লুটেরা এবং হিন্দু হত্যাকারী।

ভারতে এবারই প্রথম ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে ছবি হচ্ছে, এমন নয়। এর আগে ১৯৮৮ সালে তার ওপর এক কোটিরও বেশি অর্থ ব্যয়ে নির্মিত ছবি ব্যবসা সফল হয়েছিল। ছবিটির নাম ছিল নাইন্টিন টুয়েন্টি ওয়ান।

প্রচলিত ইতিহাস অনুযায়ী, উত্তর কেরালার নানা অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চালাতেন মালায়ালাম, আরবী আর কিছুটা ইংরেজি শিক্ষিত কুঞ্জাহামেদ হাজী।

প্রচারের সময়ে তিনি ব্যবহার করতেন কেরালার নিজস্ব মার্শাল আর্টসের নানা কায়দা, পল্লীগান প্রভৃতি। সেভাবেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের এক বাহিনী।

১৯২০ সালের আগস্ট মাসে একটি মসজিদে হামলা চালায় ব্রিটিশ সেনারা। এর পরেই নানা দিকে ব্রিটিশ থানা ও সরকারি দপ্তরে হামলা চালায় কুঞ্জাহামেদের সেই বাহিনী ।

প্রায় একবছর ধরে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল ওই বাহিনী। সেই লড়াইয়ের পরে ১৯২১ সালের আগস্টে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দিয়ে গড়ে তোলেন তার নিজস্ব প্রশাসন।

কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত সেই সরকার মাত্র ৬ মাস স্থায়ী হয়েছিল। এরপর তাকে গ্রেপ্তারের পর গুলি করে হত্যা করে ব্রিটিশ সেনারা।

এই ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়েই ফের একটি সিনেমা বানানোর কথা ঘোষণা দিয়েছেন মালায়লাম সিনেমার খ্যাতনামা পরিচালক আশিক আবু। এরপরেই শুরু হয়েছে ওই ঐতিহাসিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে বিতর্ক।

এ প্রসঙ্গে আশিক আবু বলেন, ‘বিতর্ক হচ্ছে কারণ ছবির মূল চরিত্রটাই যথেষ্ট বিতর্কিত ও আলোচিত। ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে ব্রিটিশদের তৈরি করে দেওয়া একটা ভাষ্য আছে, সেটা অনেক মানুষ বিশ্বাসও করেন। ঐতিহাসিকরা অবশ্য প্রমাণ করে দিয়েছেন যে সেই ভাষ্যটা মিথ্যা।’

তিনি আরও বলছিলেন, একদিকে ছবিটার বিষয়বস্তু নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে ভালোই হয়েছে। মানুষ এখন ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে পড়াশোনা করছে, জানার চেষ্টা করছে।

কিন্তু দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো আর ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন, ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ আসলে একজন দস্যু ও লুটেরা ছিলেন। তাদের দাবি, তিনি হাজার হাজার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। একই সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন বহু মানুষকে।

ভারতের ইতিহাস গবেষণার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিকাল রিসার্চ (আইসিএইচআর)য়ের সদস্য অধ্যাপক সি আই আইজ্যাক দাবি করেন, ‘ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ একদিকে ছিলেন একজন ধর্মান্ধ, আর অন্যদিকে দস্যুদলের নেতা। ইসলাম ধর্মের অন্ধ অনুসারী ছিলেন তিনি। ১৯২১ সালের যে ঘটনার কথা বলা হয়, সেটা আদতে ছিল একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।’

‘তিনি ওই দাঙ্গা লাগিয়ে হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা করেছিলেন, ধর্মান্তরিত করেছিলেন। তার উদ্দেশ্যই ছিল নিজে এই অঞ্চলে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন আর নিজে খলিফা হবেন। যাদের তিনি আর তার দল হত্যা করেছিল, তারা বেশিরভাগই ছিল নিম্নবর্নীয় হিন্দু - তাদের জমিজমা কিছুই ছিল না। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা তো পালিয়ে যেতে পেরেছিল।’

কেরালার কমিউনিস্ট আর কংগ্রেস সরকার এইরকম এক ব্যক্তিকে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহী বানিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক সি আই আইজ্যাকের।

তবে অধ্যাপক সি আই আইজ্যাকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বহু ইতিহাসবিদ। ইতিহাসের অধ্যাপক আব্দুর রেজ্জাক বলছেন, কে এন পানিক্কর থেকে শুরু করে বহু ইতিহাসবিদ মালাবার বিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা করেছেন।

অধ্যাপক আব্দুর রেজ্জাক বলেন, ‘কোনও বইতেই ওই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা হয় নি। ইতিহাস বলছে ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ বরঞ্চ তার দলের সেই সব সদস্যদের কঠোর শাস্তি দিতেন, যারা লুটপাট চালাতো বা জোর করে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করতো।’

তার ব্যাখ্যা, ‘আসলে ব্রিটিশ ও তাদের অনুগত জমিদার শ্রেণি তার বাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছিল। সেজন্যই তারা ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে বিদ্রোহ হিসাবে না দেখিয়ে ১৯২১ এর ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলার চেষ্টা করেছে। আর এই প্রচেষ্টা এখন নয়, ওই সময় থেকেই চলে আসছে।’

ধ্যাপক আব্দুর রেজ্জাক আরও বলেন, ‘আগামী বছর তো বিদ্রোহের শতবর্ষ, তাই এই চলচ্চিত্র যদি নাও হত, তাহলেও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো রাজনীতি করার জন্য এই বিতর্ক তুলতই। এর আগে তারা টিপু সুলতানকে নিয়েও বিতর্ক করেছে। একই কায়দায় এবার ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ নিয়ে বিতর্ক তুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করার চেষ্টা করছে হিন্দুবাদী গোষ্ঠীগুলো।’

ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে এই বিতর্ককে পরিচালক আশিক আবু অবশ্য খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাইছেন না।

তিনি বলেন, ‘এরকম বিতর্ক আর হুমকির মুখোমুখি আমাকে আগেও পড়তে হয়েছে। আর শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে যে কেউই নিজের মতামত স্পষ্ট করে বলতে গেলেই তাকে একই রকম হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে।’

ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ নিয়ে ছবির কাজ এখনও শুরু হয় নি, তাই ছবিটাতে ঠিক কী দেখানো হচ্ছে, কোন ভাষ্য উঠে আসছে, তার জন্য অপেক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন কোচির সেক্রেড হার্ট কলেজ অফ কমিউনিকেশনসের ডিন এবং নারী চলচ্চিত্রকার আশা আচি যোশেফ।

পরিচালক আশিক আবুর পক্ষ নিয়ে আশা আচি যোসেফ বলেন, ‘বিতর্ক হচ্ছে ঠিক আছে, সেটা প্রয়োজনও। কিন্তু ছবিটা তো আগে তৈরি হোক - লোকে দেখুক আশিক আবু তার ছবিতে ঠিক কী দেখাচ্ছেন, কী বলছেন ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদকে নিয়ে! তার কাজের ধরণের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারাই জানেন তিনি এমন একজন পরিচালক, যিনি ইতিহাস বিকৃত করেন নি কখনও। আর তার গবেষণার টিমটিও খুবই পারদর্শী। তাই এবারেও সঠিক ইতিহাসই তিনি তুলে ধরবেন, এমনটা আশা করাই যায়।’

আগামী বছর মালাবার বিদ্রোহের শতবর্ষ। এ উপলক্ষে কেবল আশিক আবু নয়, আরও তিনজন পরিচালক ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ আর মালাবার বিদ্রোহ নিয়ে ছবি করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই মুসলিম বিদ্রোহীর ওপর ছবি নির্মিত হলে তা মুক্তি পাবে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। কেননা এর আগে ‘যোধা আকবর’সহ মুসলিম চরিত্র অবলম্বনে তৈরি ছবিগুলো মোদির দল বিজেপিসহ কট্ট্ররপন্থী হিন্দুদের বাধার মুখে পড়েছিল। এমনকি অনেক ছবির নাম বদেলে ও অনেক দৃশ্য কাটছাট করে অবশেষে সেগুলো মুক্তি পেয়েছে। এবার ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদের ভাগ্যে কি ঘটে সেটাই দেখার বিষয়।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত