ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

মাটির নিচে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার

  নাজিফা জাহান

প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২১, ১৫:৫৯

মাটির নিচে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার

ভাবছেন এটি রূপকথার কোনো গল্প! না, এটি রূপকথার কোনো গল্প নয়। রূপকথার গল্পকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।

গাইবান্ধা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধা-বালাসী সড়ক ঘেঁষে একটি বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। মাঠটির এক পাশে একটি বিশাল ভবন এবং আরেক পাশ দিয়ে চলে গেছে মেঠোপথ। কিন্তু পুরো ভবনটিই দৃষ্টির আড়ালে। বাইরে থেকে দেখে যে কেউ মনে করবে এটি কোনো কৃষিজমি। কিন্তু এই মাঠের ভেতরেই লুকিয়ে আছে অনন্য এক স্থাপনা; যার নাম 'ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার (Friendship Centre)'

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনেরপাড়া গ্রামে অবস্থিত এই ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটির দিকে সবাই অবাক হয়ে তাকায়। প্রকৃতির মধ্যে মিশে যেন অদৃশ্য হয়ে আছে ভবনটি।

স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী বলেন, 'ভবনের জমি খুবই নিচু ছিলো। পানি আটকাতে চারদিকে বাঁধ দেয়া হয়েছে।ভবনের ছাদের লেভেল রাস্তার প্রায় সমতল। আমার লক্ষ্য ছিলো অল্প খরচে সবার জন্য ভিন্নধর্মী কিছু করা। এটি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয়। সংস্থাটি চরের মানুষের জন্য কাজ করে। এখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশাপাশি চরের মানুষজনের জন্য সেবা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই এখানে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদেশি দাতা সংস্থার লোকজন আসবেন, থাকবেন-সেটিও একটি বিষয়। তাই সবাই যাতে এই ভবনে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারেন সেটিও মাথায় রাখতে হয়েছে।'

ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার স্থাপত্য শিল্পে এক অনবদ্য সৃষ্টি। যা শুধু গাইবান্ধা তথা আমাদের দেশকে নয় বরং অবাক করেছে বিশ্বকে। যার ফলশ্রুতিতে মিলেছে একাধিক বিদেশি অ্যাওয়ার্ড। ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি সম্পূর্ণ মাটির নিচে অবস্থিত। অর্থাৎ ভবনের ছাদ ভূমি সমতলে। ছাদে লাগানো হয়েছে নানা জাতের ঘাস। উপর দিক থেকে দেখলে মহাস্থানগড়ের প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের ছবি ফুটে ওঠে অনেকটা। যা দেখে স্বাভাবিকভাবেই যে কেউ অভিভূত হবেন। এই ভবনে চলে দাপ্তরিক নানা কর্মকাণ্ড। রয়েছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, অভ্যন্তরীণ খেলাধুলা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। ভেতরের সবকিছু দৃষ্টিনন্দন।

২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনেরপাড়া গ্রামে প্রায় আটবিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ভবনের আয়তন ৩২ হাজার বর্গফুট। ‘আরবান কন্সট্রাকশন’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি নির্মাণ করে। এতে ব্যয় হয় আনুমানিক আট কোটি টাকা। সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর।এখানে রয়েছে দুইটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এর মধ্যে একটি শীতাতপ কেন্দ্র।

কেন্দ্র দুইটিতে একসঙ্গে ২০০ জন প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। আবাসিক কক্ষ রয়েছে ২৪টি। আবাসিক কক্ষগুলোর মধ্যে শীতাতপ পাঁচটি। সবগুলো কক্ষে ৫০ জন লোক থাকতে পারবে। সেন্টারে রয়েছে উন্নত খাবার ব্যবস্থা।একসঙ্গে ৭০ জন লোক খেতে পারে।

পানি নিষ্কাশনের জন্য রয়েছে পাঁচটি নর্দমা। যারা আবাসিকে থাকবেন, তাদের জন্য রয়েছে অভ্যন্তরীণ খেলাধুলার ব্যবস্থা ও বই পড়ার লাইব্রেরি। এখানে প্রতিদিন ক্যারাম, দাবা ও ব্যাডমিন্টন খেলা চলে।

লাইব্রেরিতে আছে পাঁচ শতাধিক বই। সেন্টারে রয়েছে আধুনিক ইন্টারনেট সুবিধা এবং উন্নতমানের মিউজিক সিস্টেমের সুযোগ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর। বিদ্যুৎ না থাকলে নিজস্ব জেনারেটরের ব্যবস্থাও রয়েছে।

সুন্দর স্থাপত্য নির্মাণের জন্য ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি ২০১২ সালে ‘এআরপ্লাসডি অ্যাওয়ার্ড’ পায়। লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্কিটেক্স রিভিউ এই পুরস্কার দেয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ‘আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার’ পুরষ্কার পেয়েছেন ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।

সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক (একেডিএন) এই পুরষ্কার দেয়। ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারে প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ২৫ দিনই সেন্টারের নিজস্ব কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলে।

স্থানীয়ভাবে তৈরি ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত ভবনটি দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করে হাজারো দর্শনার্থী।

যেহেতু ভবনের জমি খুবই নিচু ছিলো এবং মাটি ভরাট করে ভবন নির্মাণ করতে গেলে বাজেটের ৬০ শতাংশই শেষ হয়ে যেত। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান গ্রামে হওয়ার কারণে সেখানে দোতলা ভবন করলে গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে মিলত না। তাই সমতল ভূমির সঙ্গে মিল রেখে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এতে গ্রামের প্রকৃতির অংশ হয়ে উঠেছে ভবনটি।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সারা বিশ্বের সম্মানজনক আগা খান স্থাপত্য পুরষ্কারের জন্য আধুনিক ও চৌকস স্থাপত্যশৈলীর ফ্রেন্ডশিপ ভবনটি সংক্ষিপ্ত তালিকায় মনোনয়ন পেয়েছে, সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের (একেডিএন) পুরষ্কারের জন্য বিশ্বের ৩৮৪টি স্থাপনাকে পেছনে ফেলে সেরা ১৯ স্থাপনার তালিকায় রয়েছে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার। যার স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।

তরুণ স্থপতিদের উদ্ভাবনী ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক প্রতি তিন বছর পরপর এই পুরষ্কার দেয়। অনেক বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়। উদ্ভাবনী ধারণার পাশাপাশি স্থাপনাটি কতটা পরিবেশবান্ধব সেটি দেখা হয়। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে এটির যোগসূত্রও বিবেচনা করা হয়।

এলাকাবাসী জানান, ‘ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার ভবনটি হওয়ায় অনেক দূরদূরান্ত থেকে লোকজন দেখতে আসে। এতে আমাদের এলাকার পরিচিতি পাচ্ছে।’

ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের কুক ম্যানেজার জানান, ‘এখানে ম্যানেজারসহ ১৯ জন স্টাফ রয়েছে। মেহমানদের চাহিদা অনুযায়ী দেশি-বিদেশি খাবার পরিবেশন করা হয়।’

গাইবান্ধা ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের সহকারী ব্যবস্থাপক বলেন, ‘মাটির নিচে ভবনের কক্ষ অনেকটা ঠাণ্ডা থাকে। বাইরের আলো-বাতাসও পাওয়া যায়। এটি পরিবেশ বান্ধব কার্যালয়।’

মাটির নিচে তৈরি অদৃশ্য গাইবান্ধার 'ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার' ভবন যা স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নজির।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত