ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২১ মিনিট আগে
শিরোনাম

যে গ্রামে কিশোরীরা বাড়ি ফেরে না

যে গ্রামে কিশোরীরা বাড়ি ফেরে না
ফাইল ছবি

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তী ব্লকের রামচন্দ্রখালি গ্রাম। এ গ্রামেই কিশোরীরা মেয়েরা একের পর এক হঠাৎ হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ উধাও হচ্ছেন আবার কাউকে উদ্ধার হয় ডোবা-নর্দমায়। আবার কেউ কেউ হারিয়ে যায় পাচার পথে।

রামচন্দ্রখালি গ্রামের শিক্ষক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন, ‘চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। বিয়ে, চাকরি, নতুন মোবাইল বা গয়নার লোভ দেখিয়ে কেউ কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে ভুলেও রাজি হবে না।’ শুনতে শুনতে ক্লাসে উঠে দাঁড়ায় একটি মেয়ে। ‘স্যর, আমার বোনও তো এ ভাবেই...’ কথা শেষ করতে পারে না সে। জানা যায়, তার বোন সপ্তাহ তিনেক ধরে নিখোঁজ। উঠে দাঁড়ায় আরেকজন। তার পাশের বাড়ির এক বোনেরও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

এ ভাবেই চলছে। এমন ভাবেই ক্রমশ কিশোরী-শূন্য হয়ে পড়ছে রামচন্দ্রখালি গ্রাম। স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানায়, পুলিশের কাছে জানিয়েও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। বরং বহু ক্ষেত্রেই পাচারের সঙ্গে যুক্ত লোকজন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামেই।

প্রতি মাসে ছাত্রীদের নিয়ে বসছেন স্কুলের শিক্ষকেরা। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রচার চালাচ্ছে। কন্যাশ্রী ক্লাবের তরফেও কর্মসূচি থাকছে। তবু এখনও রামচন্দ্রখালি গ্রামে কৈশোরে পা রাখতে না রাখতেই মেয়েদের বিয়ের চেষ্টা শুরু হয়। দু’চার জন মেয়ে নিজের চেষ্টায় বিয়ে আটকায় বটে, কিন্তু সে সংখ্যা খুবই কম।

সাবিনা (আসল নাম না, নকল নাম) মারা গিয়েছে দু’বছর আগে। তাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রামচন্দ্রখালির অন্য মেয়েদের মতো সে-ও এক দিন নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল গ্রাম থেকে। দিন কয়েক পরে তার দেহ উদ্ধার হয়। সাবিনার বাবা এখন পাচারবিরোধী প্রচারের কাজ করেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নিজের মেয়েটাকে তো বাঁচাতে পারলাম না। অন্য মেয়েগুলোকে যদি পারি।’ তার মেয়ের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলছে। তিনি বলেন, ‘একটা নৌকা ছিল। মামলার খরচ চালানোর জন্য সেটা বেচে দিয়েছি। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।’

গ্রামেরই আর এক বাসিন্দা সইফুল মোল্লা (আসল নাম না, নকল নাম) জানান, তার নিজের মেয়ে তো হারিয়েছে বটেই, পাশাপাশি তার এলাকাতেই শেষ কয়েক সপ্তাহে চার জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। তার কথায়, ‘আমার মেয়ে আমার শালীর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিল। বিয়ের নাম করে ওকে ফুসলানোর চেষ্টা চলছিল। যে এটা করেছে, তাকে চিহ্নিত করেছিল আমার শালীর পরিবার। লাভ হয়নি। সে বহাল তবিয়তে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ তার অভিযোগ, থানায় ঘুরে ঘুরে জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে গিয়েছে। গ্রামের লোকজন থানা ঘেরাও করেছেন। পুলিশের কাছ থেকে আশ্বাস মিলেছে শুধু। হারানো মেয়েরা বাড়ি ফেরেনি।

পাচার যে কত বড় সমস্যা তা বারুইপুর পুলিশ জেলার ওয়েবসাইট খুললেই বোঝা যাবে। পাচারবিরোধী প্রচারের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে সচেতনতামূলক নানা তথ্য। প্রশ্ন উঠেছে, তার পরেও পুলিশের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ কেন? বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার রশিদ মুনির খান বলেন, ‘বাসন্তী থানা এলাকা থেকে পাচার হওয়া বেশ কিছু মেয়েকে আমরা দিল্লি, তামিলনাড়ু, পঞ্জাব, রাজস্থান থেকে উদ্ধার করেছি। সেখানকার যৌনপল্লিতে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল তাদের। তাই, পুলিশ কিছু করছে না, সেই অভিযোগ ঠিক নয়।’

রামচন্দ্রখালি গ্রামের স্কুল শিক্ষক জাফর ইকবাল ও তার সহকর্মীদের চেষ্টায় পাঁচ বছর আগে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল পাচার হয়ে যাওয়া ওই গ্রামেরই আবিদা লস্কর (আসল নাম না, নকল নাম)। তবে মেয়েটি তার মাস কয়েকের মধ্যেই রোগে ভুগে মারা যায়। হেপাটাইটিস বি ধরা পড়েছিল যৌনপল্লিতে পাচার হওয়া আবিদার। তাকে বাঁচাতে না পারার কষ্ট এখনও কুরে কুরে খায় জাফরকে।

তিনি বলেন, ‘বার বার হেরে যাচ্ছি আমরা। নতুন নতুন ছক করছে পাচারকারীরা। স্কুলের সামনে ফুচকাওয়ালা, আচারওয়ালাদেরও চর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে অনেক জায়গায়। বাইরে থেকে আসা মোটরসাইকেল চড়া ছেলেরা তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে।’

বাংলাদেশ জার্নাল/এমএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত