ঢাকা, রোববার, ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

পাহাড়ে প্রাণহানির পর বড় অভিযান, ১৫ বছরে তিন শতাধিক মৃত্যু

  চট্টগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২২, ১১:৩০

পাহাড়ে প্রাণহানির পর বড় অভিযান, ১৫ বছরে তিন শতাধিক মৃত্যু
ছবি: বাংলাদেশ জার্নাল

বর্ষা শুরু হতেই পাহাড়ে কান্না। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। পাহাড় ধসে গত শুক্রবার রাতে তাদের মৃত্যু হয়। এ অবস্থায় নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বড় অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। উচ্ছেদ করা হবে চিহ্নিত ১২০টিসহ অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা ও বসতি। বিশেষ করে চান্দগাঁও, আকবরশাহ ও বাকলিয়া সার্কেলে আজ রোববার এ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জেলা প্রশাসন সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (এনডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, গত শুক্রবার থেকেই ভারী বর্ষণ। এ অবস্থায় পাহাড়ে বসবাসকারীদের সুরক্ষায় আমরা কাজ করে চলেছি। মাইকিং করে সতর্ক করার কাজ চলমান রয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অবৈধ বসবাসকারীদের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। ইউটিলিটি সেবা (গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য) বিচ্ছিন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে অতি ঝুঁকিতে থাকা আড়াইশ পরিবারকে আমরা নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছি। এর মধ্যে বাটালি হিল থেকে ৩২টি, আকবরশাহ’র ১ নম্বর ঝিল, ২ নম্বর ঝিল ও ৩ নম্বর ঝিল এলাকা থেকে ১৫০টি, টাংকির পাড় ও ভেড়া মার্কেট এলাকা থেকে ৩০টি, মতিঝর্ণা সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে ৩২টি ও আগ্রাবাদ এলাকা থেকে ২০টি পরিবারকে সরিয়ে নেয়া হয়।

১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরিয়ে নেয়া পরিবারগুলোর মধ্য থেকে কিছু কিছু পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছে।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্যমতে, বর্তমানে নগরীতে ৬৫টির মতো পাহাড় রয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ। ২৮টির মধ্যে ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করে ৮৩৫ পরিবার। এই ১৭ পাহাড়ের মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে অবৈধভাবে বাস করছে ৫৩১ পরিবার। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন ৭ পাহাড়ে বাস করছে ৩০৪ পরিবার। এর বাইরে বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে এবং ঢালুতে ঘর তৈরি করে অবৈধভাবে বসবাস করে নিম্নআয়ের মানুষ। নগরীতে সব মিলিয়ে ২০ হাজার মানুষ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করে।

পাহাড় ধসে গত ১৫ বছরে তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের প্রায় সবাই ছিলেন পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারী হতদরিদ্র লোকজন।

সূত্রে জানা গেছে, নগরীর বাটালী হিল, মতিঝর্ণা, আকবরশাহ, হিল-১, হিল-২ ও বায়েজিদ লিংক রোড সংলগ্ন পাহাড়, ফয়’স লেক সংলগ্ন ১ নম্বর ঝিল, ২ নম্বর ঝিল, ৩ নম্বর ঝিল, আমিন জুট মিলসহ সন্নিহিত এলাকার পাহাড়গুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করে মানুষ। ঘর তৈরির জন্য এমনভাবে পাহাড় কাটা হয়, তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারী বর্ষণ হলেই পাহাড়গুলো ধসে পড়ে।

ক্ষতিগ্রস্ত হয় যারা: দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভাবের তাড়নায় ছুটে আসা উদ্বাস্তু ও নিম্ন আয়ের লোকেরা সাধারণত এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাস করার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বল্প আয়ের এসব লোক না পারে ভালো কিছু খেতে, না পারে কিছু করতে। মাথা গোজার ঠাঁইটুকুও করতে পারে না। অভাবের কারণে তাদের অনেক স্বাদ-আহ্লাদ থেকে যায়। যার ফলে তাদেরকে বসবাস করতে হয় পাহাড়ের চূড়ায় নয়তো রেল লাইনের পাশে।

পাহাড় ধস কেন হয়: প্রতি বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি এবং ভারী বর্ষণের কারণে পাহাড় ধস হয়। যত্রতত্রভাবে পাহাড়ে বসবাস এবং অতিরিক্ত পাহাড় কাটার কারণে পাহাড় ধস হয়। পাহাড়ি বনাঞ্চল ধ্বংস করার কারণেও পাহাড় ধস হয়ে থাকে।

পাহাড় ধসের কারণে জলাবদ্ধতা: অতিরিক্ত পাহাড় কাটার কারণে বৃষ্টির সময় পাহাড়ের বালিগুলো ড্রেনে নেমে আসে এবং পলি জমাতে ড্রেনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। যার ফলে নগরীতে জলাবদ্ধতা চরম আকারে দেখা দেয়। পাহাড় কাটার ফলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।

নগরীর মতিঝর্ণা পাহাড় ও বাটালি হিলে দেখা যায়, দুটি পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে কাঁচা-পাকা বসতঘর। এ পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে চারতলা পাকা ভবনও। এসব ঘরে রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। একটি মিটার থেকে ১০-১২ ঘরে দেয়া হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থাগুলোর অসাধু কর্মচারীদের সহযোগিতায় এ কাজটি চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় পাহাড়ের পাদদেশে খুপরি ঘর ভাড়া দেয় এলাকার কিছু চিহ্নিত লোক। তাদের কারণেই মূলত লোকজনের ঝুঁকি বাড়ছে। ঝুঁকিতে বসবাসকারী লোকজনদের সরিয়ে নিতে নির্দেশ কোনোভাবে মানা হচ্ছে না। পাহাড়ের পাদদশে খুপরি ঘর বানিয়ে ভাড়া প্রদানকারী প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের নিয়ে নানা তথ্য মিলছে। পাহাড় বিক্রি করে এদের অনেকে বিপুল অর্থের মালিক।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, বর্ষা এলেই পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরানোর তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কার্যকর নয়। বর্ষায় কেন সরাতে হবে? দরকার স্থায়ীভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। নয়তো পাহাড় রক্ষা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, সেবা সংস্থাগুলো তালিকা দেয়নি। তাই এতদিন অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। সামনে মিটিং রয়েছে। সেখানে তাদের বক্তব্য জানতে চাওয়া হবে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান বলেন, শুক্রবার থেকে আমরা মাইকিং করে সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসার নির্দেশনা দিই। আমরা ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করি। কিন্তু জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সাড়া না দিয়ে কিছু মানুষ গোপনে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে থেকে যায়। রাতে পাহাড় ধসের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত