ঢাকা, বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

সকল পতির আলয় পতিতালয়

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২১, ২০:১৯

সকল পতির আলয় পতিতালয়
ছবি: সংগৃহীত

আমার পুলিশ পেশা প্রতিদিনই কিছু না কিছু হাতে কলমে শেখায়। লাশ ঘরের ডোম সাহিত্যে হাত রেখে যৌনপল্লীর অদ্ভুত আঁধার পরিবেশ-পরিবেশন উত্তরণ ঘটিয়ে বৃহল্লনা সমাজ সাহিত্যে হাত পাকিয়ে মনে করেছি- সব চিকিৎসার মহৌষধ নবরত্ন লাল তেলের কবিরাজ।

আরো মনে করেছি, মানুষের সব রঙের চরিত্র আমার চেনা হয়ে গেছে। আমার সবজান্তা সমশের আহাম্মক মুর্খামি প্রতিমুহূর্ত শেখার আগ্রহকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। পুঁথিগত বিদ্যায় পড়েছি রঙধনুর সাত রং। বার্জার অলিম্পিক পেইন্ট কোম্পানির কালার ব্যাংকের কল্যাণে পেয়েছি অগণিত নাম।

সন্তুষ্ট হতে না পেরে হেক্সাডেসিমাল, সিএমওয়াইকে, আরজিবি এবং এইচএসভি এই চার ফরম্যাটে রঙের সব সংকেত, গামা সংশোধনের পরিমাণ পেয়ে রঙের ডিকশনারি শেষ করতে পারিনি; আবার লেখকের নতুন নতুন কল্পনার রঙ নিয়ে রং সাহিত্যের চূড়ান্ত ইতি টেনেছি।

আমার পুলিশ জীবনের ডিউটির প্রথমদিন শুরু হয়েছে যৌনপল্লী দিয়ে। পতিতালয় উচ্ছেদ সংগ্রাম পরিষদের সুযোগসন্ধানী লুটেরা, চাঁদাবাজ, মাস্তানদের হাত হতে যৌনকর্মীদের সুরক্ষার তাগিদে। দলের ইনচার্জ ছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর মিজানুর রহমান। সেক্স ওয়ার্কার বিভিন্ন বয়সী নারীর কামস্তুতি দৃষ্টি, হিন্দি-বাংলা চটুল গানের ঝংকার, যৌনকর্মী মাস্তান মাসী-খালার ভীষণ ব্যবহার দেখে আমি বেশ বিরক্ত ভয়ার্ত। ওদের সবার হাবভাব ব্যবহার দেখে মনে হয়েছে আমি সবারই কিছু একটা হয়ে গেছি। আমার নববধূ ঘরনার লাজুক ব্যবহারে দারোগা সাহেব বেশ বিরক্ত।

যৌনপল্লী পাহারায় আমাদের দলের এক মাস করে ডিউটি। এসআই মিজান সাহেব আমাকে হাতেকলমে মোটিভেশনাল স্পীচ দিয়ে শিষ্য বানিয়ে বৃহৎ পতিতালয় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুঃখ গাঁথা জীবন্তিকা উপন্যাস শোনাতেন। দেখাতেন পতিতাদের কপর্দকহীন বিনা চিকিৎসা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে অমোঘ মৃত্যু।

মাস্তান মাসী-খালাদের আচরণ, সমাজের কথিত সভ্য মুখোশের ভীষণ আচরণ, ভণ্ড রাজনীতি, ধর্ম এমনকি কথিত মানবাধিকার কর্মী সবারই দৃশ্য অদৃশ্য ধান্ধা।

আরো দেখেছি ক্যাটাগরি শিক্ষিত যৌনকর্মী, ওদের মার্জিত-অমার্জিত ব্যবহার উগরানো ক্ষোভ, মানবীয় আচরণ।

প্রতিদিনের গোপনীয় রিপোর্ট আমার হাতে লেখাতেন। আমার সাথে গুরু-শিষ্যের মানবীয় পরম্পরা এখনো আমি ধরে রেখেছি। আমার গুরু সহকারী পুলিশ সুপার হয়ে রিটায়ার্ড করেছেন।

গুরুর দেয়া দু’টি পরামর্শ এখনো মেনে চলি। উনি বলতেন ‘তুমি হবে রাজহংস, রাজহংস যেভাবে পানি হতে দুধটুকু খেয়ে নেয়, কচুপাতা যে প্রকারে পানিকে ঝেড়ে ফেলে দেয়, সে প্রকারে এগিয়ে যাবে। সবার মতো তোষামুদে হয়ে সময় পরিস্থিতি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অমার্জিত লোভের ফাঁদে পা বাড়াবে না, সময়ের নির্মম নিয়তি সুদাসলে একদিন সব কেড়ে নেবে।’ নমস্য গুরুর সে কথা এখনো মেনে চলি।

মেনে চলতে গিয়ে ঘুমের সময় ছাড়া এখনো প্রতিমুহূর্তে সর্বভুক প্রজাতির চিত্র-বিচিত্র কিম্ভুতকিমাকার যাত্রামঞ্চে বারোভাতারি সেজে গাইতে হয় নাচতে হয়।

আগ্রাসী ক্ষুধার কাছে পরাজিত হয়ে কেউ যৌনকর্মী, চোর, চিটার, বাটপার কেউ ধর্মান্তর, এমনকি স্ত্রী-যুবতী কন্যা নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করে দেন। যৌনকর্মী দেহ বিলিয়ে টাকা নেয়, খাবার কেনে।

আবার সর্দারনী খালা সে টাকা খাবার কেড়ে নিয়ে বসে বসে খেয়ে মাস্তান পোষেন। মাস্তানদের খাবার, মদ, বেতন কিন্তু যৌনকর্মী দিয়ে থাকেন। সর্দারনী যৌনকর্মীর ক্ষুধা চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ মোটাভাত সবজি, পচা-বাসি মাছ মাংসে সীমাবদ্ধ রাখেন। সর্দারনী যৌনকর্মীদের যতো নির্মমতা চালাতে পারেন, ততো বেশি খদ্দের মনোরঞ্জন সুখে আসেন।

যৌনরোগ তো পতিতাদের কমন রোগ। নেই কোনো চিকিৎসা পথ্য, নেই খাবার। বেশি অসুস্থ হলে রাতের আঁধারে রাস্তার ধারে রেখে আসেন। পুলিশের সুরতহালে ভাসমান ভিক্ষুক কিংবা পাগলী হয়ে চিরতরে হারিয়ে যান। চিরতরে হারানো এ যৌনকর্মী কিন্তু ইচ্ছে করেই অন্ধকার গলিতে আসেনি। তার সঙ্গে চরম অন্যায় করে যৌন লাইসেন্স দিয়ে যাবজ্জীবন যৌন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। পতিতার শরীর বেচা টাকার সিংহভাগই যে সম্প্রদায় পেয়ে থাকেন! সে সম্প্রদায়ের গতর কটর এ পর্যন্ত পতিতা দূরে থাক! সর্দারনী পর্যন্ত দেখেনি। (চলবে...)

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি এবং পুলিশ পরিদর্শক।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত