বাংলাদেশি বিতাড়নের বক্তব্যে আসামজুড়ে শঙ্কা
ভারতে ‘নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষদের বিতাড়ন করা হবে’ বিজেপি নেতাদের এমন বক্তব্যে আসামজুড়ে ডালপাল মেলছে এক বিভ্রান্তি আর শঙ্কা। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কোথায় তাড়ানো হবে তাদের? কোন দেশই বা তাদের গ্রহণ করবে? আর কোনও দেশ যদি গ্রহণ না করে, নাগরিক তালিকার বাইরে থাকা মানুষরা যাবেন কোথায়?
নাগরিক তালিকার চূড়ান্ত খসড়া তালিকা থেকে যে ৪০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গেছে, তারা এই ঘোষণার পরে একদিকে যেমন বিতাড়িত হওয়ার ভয় পাচ্ছেন, অন্যদিকে মনে করছেন নতুন করে তাদের ওপরে অত্যাচার না শুরু হয়!
বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতা রাম মাধব তার বক্তৃতায় তিনটি ডি-র ভিত্তিতে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছেন - ডিটেক্টশন, ডিলিশান এবং ডিপোর্টেশন। এখন নাগরিক তালিকা নবায়নের যে প্রক্রিয়া চলছে, তাকে তিনি ডিটেক্টশনের পর্যায়ে ফেলছেন। অর্থাৎ প্রক্রিয়া শেষ হলে ওই তালিকায় নাম না থাকা ব্যক্তিদের তাড়িয়ে দেয়া হবে।
নাগরিক তালিকার চূড়ান্ত খসড়া থেকে বাদ পড়া শিলচরের বাসিন্দা পাপড়ি ভট্টাচার্য নামে এক নারী জানান, রাম মাধবের ওই বক্তব্যের পর তো আমি সত্যিই কনফিউজড।
তিনি বলেন, কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন যে কাউকে আসাম থেকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়া হবে না। এখন আবার রাম মাধবের মতো বড়ো নেতা বলছেন সবাইকে তাড়ানো হবে। তার মতো নেতা তো নিশ্চই দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে কথা বলেই এই ঘোষণা করেছেন। তাহলে কি ভারতীয় হওয়া স্বত্ত্বেও, ভারতের পাসপোর্ট হোল্ডার আর সরকারি চাকরিজীবী হওয়া স্বত্ত্বেও সত্যিই আমাদের তাড়িয়ে দেয়া হবে? আর সেটা না করা হলেও ডিটেইন করে রাখাও তো হতে পারে! সত্যিই আতঙ্কিত আমি।
একটা সময়ে আসামের বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমান মনে করতেন যে নাগরিক তালিকা নবায়ন হওয়ার পরে তাদের দিকে যেভাবে মাতৃভাষার কারণে অবৈধ বাংলাদেশী বলে আঙ্গুল তোলা হতো, সেটা বন্ধ হবে।
কিন্তু নাগরিক তালিকা বা এনআরসি প্রক্রিয়া যখন প্রায় শেষের দিকে, ততই অনেকের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে যে এটা আসলে বাংলাভাষী মানুষের ওপরে দীর্ঘমেয়াদে অত্যাচার নামিয়ে আনার একটা প্রক্রিয়া নয় তো?
শাহজাহান আলি আহমেদ নামে এক ব্যাক্তি বলেন, এনআরসি-র প্রক্রিয়াটাকে এতদিন ধরে যেভাবে একটা ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়া বলে আমাদের বোঝানো হয়েছে, এখন তো দেখা যাচ্ছে কাজটা তো সেভাবে হচ্ছে না। সুপ্রীম কোর্ট বলছে তারা গোটা প্রক্রিয়ার ওপরে নজরদারি চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তো কোনও নজরদারি দেখতে পাচ্ছি না। শুধুমাত্র এনআরসি-র ভারপ্রাপ্ত একজন অফিসারের ওপরেই আদালত ভরসা করছেন।
তিনি বলেন, এটা আসামের সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিক যেসব বাংলাভাষী মানুষ, তাদের ওপরে অত্যাচার চালানোর একটা পূর্বপরিকল্পিত প্রক্রিয়া নয় তো?
৩০ জুলাই নাগরিক তালিকার যে চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে নাম নেই বাকসা জেলার আইখারি গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান আলি আহমেদ সহ তাঁর পরিবারের ৭ জন সদস্যের।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাসিন্দা, ছাত্র নেতা ইব্রাহিম আলিরও নাম ওঠে নি নাগরিক তালিকার চূড়ান্ত খসড়ায়। তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেনই। কিন্তু বিজেপি-র শীর্ষ নেতা রাম মাধবের ঘোষণার পরে কী ভাবছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মতো আসামের আদি বাসিন্দাদের যদি এনআরসি থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়, তা হলে শুদ্ধ নাগরিক তালিকা তৈরী কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। ঘটনাক্রম দেখে তো সন্দেহ হচ্ছে যে ২০১৯ সালে ভোটের আগে বিজেপি রাজনৈতিক মুনাফার জন্য কোনও পরিকল্পনা করছে কী না এই ব্যাপারটা নিয়ে।
অবৈধ বাংলাদেশীদের দেশ থেকে বিতাড়নের দাবি আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি সেই আশির দশক থেকেই করে আসছে। তাদের দাবি মতোই নাগরিক তালিকা নবায়ন করা হচ্ছে। তারা চায় হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া মানুষদের তাড়ানো হোক।
কিন্তু বিজেপি এতোদিন বলে এসেছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি থেকে সেই সব দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সেখানে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে দেশ ছেড়ে ভারতে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।
আসামের ক্ষেত্রে যার অর্থ বাংলাদেশ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে এসেছেন, এমন হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।
কিন্তু মি. রাম মাধব নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়া সবাইকেই বিতারণের কথা বলছেন - হিন্দু মুসলমান কোনও ভেদ করেন নি।
শিলচরের জনপ্রিয় দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকার সম্পাদক অরিজিত আদিত্য বলেন, এনআরসি প্রক্রিয়াটা কোনও কালেই হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদের প্রক্রিয়া ছিল না। এটা আদতে ছিল অসমীয়া মূলবাসী এবং তথাকথিত অবৈধ অভিবাসী, অর্থাৎ অবৈধ বাংলাদেশী চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা হয় আসামের গ্রাউন্ড রিয়েলিটিটা বোঝেন না অথবা জেনে বুঝেই মানুষকে মিসগাইড করছেন! ২০১৯ এর আগে এনআরসি প্রক্রিয়াটার এমন একটা বিজ্ঞাপন তারা সারা দেশে করতে চাইছেন, যেন মুসলমান অনুপ্রবেশকারী বাছাই করার একটা প্রক্রিয়া এটা। আদৌ তো তা নয়।
