ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৩৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

গ্যারেজ মালিকের মেয়ে শত কোটি টাকার মালিক!

  নরসিংদী প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:২৭

গ্যারেজ মালিকের মেয়ে শত কোটি টাকার মালিক!

নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া। অটো গ্যারেজের মালিকের মেয়ে। এক সময় তাদের তেমন কিছুই ছিলো না। গত ৫ বছরে অর্থবিত্ত অর্জন করে আঙুল ফুলে গলাগাছ হয়ে গেছেন। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট কিনে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

দেশে গাড়ির ব্যবসার পাশাপাশি বিদেশে দিয়েছেন বার। আর সবই করেছেন অন্যায় ও অপকর্মের ওপর ভর করে। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাককমেইল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও দেহ ব্যবসাই তাদের মূল পেশা।

জানা যায়, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক পাপিয়া বাগদী এলাকায় পেট্রোবাংলার অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সাইফুল বারীর মেয়ে। বর্তমানে তার বাবা নিজ এলাকায় একটি অটোর গ্যারেজ রয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি অটো গাড়ি ভাড়া দিয়ে চলে তাদের সংসার।

অতি সস্প্রতি পাপিয়া দুতলা বিশিষ্ট আধুনিক একটি বাড়ি করেছেন। তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন গানের শিক্ষক মতিউর রহমান চৌধুরীর বড় ছেলে। মতিউর রহমান স্থানীয় নজরুল একাডেমির অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছে। এক সময় সুমনেরও তেমন কিছুই ছিল না। আধাপাকা টিনসেড ঘরেই কেটেছে তার শৈশব। এসএসসির গন্ডি পার হওয়ার পরই থেকেই তার অপকর্ম শুরু।

২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমনের উথ্যান শুরু। শৈশব থেকেই চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ব্ল্যাকমেইল ছিল সুমনের প্রধান পেশা। দূরদর্শী চতুর ও মাষ্টারমাইন্ড সুমন রাজনীতিবিদদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর সে আলোচানায় আসে। এই দম্পতির ঘরে আট বছরের একটি ছেলে রয়েছে।

২০১২ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নরসিংদী শহরের বাসাইল এলাকায় নিজ বাসার সামনে সুমনের ওপর গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিটি বিদ্ধ হয় তার স্ত্রী পাপিয়ার পেটে। এরপর তারা নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। এরপর থেকে পাপিয়া চৌধুরী ও তার স্বামী সুমন ওরফে মতি সুমন রাজধানীর সাবেক এক সংরক্ষিত এমপির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ওই এমপির সঙ্গে তার গাড়ির ব্যবসা আছে বলে জানা গেছে।

এরই মধ্যে পাপিয়া ও সুমনের অস্বাভাবিক উথ্যান হয়। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে তৌহিদা সরকার রুনা সভাপতি ও পাপিয়া চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুরু হয় অস্বাভাবিক উথ্যান। আর এ সবই করেছেন রাজধানী ঢাকায় বসে। মাঝে মধ্যেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের মিটিং মিছিলে দলবল ও বহর নিয়ে যোগ দিতেন এই দম্পতি।

সুমন শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক ও তার স্ত্রী পাপিয়া যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় এলাকায় তাদের বিশাল কর্মী বাহিনী ছিলো। বিশাল শোউাউন আর শত শত লোকজন নিয়ে আওয়ামী লীগের মিছিল ও সভায় তারা যোগ দেয় তারা। নরসিংদী কলেজ শাখা ছাত্রলীগ ও জেলা ছাত্রলীগের অনেক নেতা-কর্মী যারা তার অনুসারী, তারা ‘কিউ অ্যান্ড সি’ ট্যাটু ব্যবহার করেন। মাঝেমধ্যেই তারা বিশাল শোডাউন দেন আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে।

যত সম্পদ: নরসিংদী জেলা শহরে বাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় দুই তলা তলাবিশষ্ট বাড়ি রয়েছে। অতি সম্প্রতি পৌর শহরের ব্রাক্ষন্দী এলাকায় তার স্বামী মতি সুমনের বিলাশ বহুল ৬ তলা বাড়ি করেছেন। বিলাদী মোড়ে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের ১০ শতাংশ এবং আরেকটি ৬ শতাংশের মূল্যবান দুটি প্লট রয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণদীতে স্বামীর দোতলা একটি বাড়ি আছে।

রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে ‘রওশন ডমিনো রিলিভো’ বিলাসবহুল ভবনে তার ও তার স্বামীর নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া তার কালো ও সাদা রঙের দুটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়া ও একটি ভিজেল কার আছে। নরসিংদী শহরে পাঁচটি মোটরসাইকেল রয়েছে বলে জানা গেছে তাদের। মোটরসাইকেলগুলো তার অনুসারীরা ব্যবহার করেন। শুধু তাই নয় নরসিংদী জেলা শহরে সুমন চৌধুরীর কেএমসি কার ওয়াশ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। কার ওয়াশ ব্যবসার আড়ালে মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাস কর্মকাণ্ড চলে।

তার স্বামীর মালিকানায় থাইল্যান্ডে একটি বারও আছে। নরসিংদীর একটি ব্যাংক শাখায় গত বছরের জুন পর্যন্ত ১ লাখ ২৩ হাজার ৮২৯ টাকা জমা ছিল। একটি ব্যাংকে পাপিয়ার হিসাবে ১ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭০ টাকা ছিল। আর একটি ব্যাংকে তার তিনটি হিসাব নম্বরের খোঁজ পাওয়া যায়। এর একটিতে ১ লাখ, অন্য দুটিতে ৫০ হাজার ও ১ লাখ ২০ হাজার টাকার ডিপোজিট পাওয়া যায়। এছাড়া একটি ব্যাংকে গোল্ড ক্রেডিট কার্ড ও একটি এমেক্স গ্রিন ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। রাজধানীর এফডিসি গেটের সঙ্গে ‘কার এক্সচেঞ্জ’ নামে তার একটি গাড়ির শোরুম আছে। নরসিংদীর শালিদা এলাকায় আর এস এম কার ওয়াস নামে একটি গাড়ির সার্ভিস সেন্টার রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাবসায়ী জানায়, ব্ল্যাকমেইলই তাদের প্রধান পেশা। তারা প্রথমে সুন্দরী নারীদের পাঠায়। তারপর কৌশলে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সাথে সুন্দরীদের ভিডিও ধারণ করে। পরে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়।

শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শ্যামল কুমার সাহা বলেন, এত অল্প সময়ে কেউ বিপুল পরিমান অর্থ সম্পদের মালিক হতে পারে না। তারা অনৈতিক কাজ করেই এসব অর্জন করেছেন। আর অসহায় ও দরিদ্র মেয়েদের চাকরি দেয়ার কথা বলে তাদের দেহ ব্যবসা করতে বাধ্য করতেন। নইলে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো।

নরসিংদী শ্রমিকলীগের আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামীর চালচলন দেখে প্রথম থেকেই আমাদের সন্দেহ ছিলো। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সন্দেহের বাইরে ছিলো না। তার আয়ের উৎস সর্ম্পকে সবসময় ধোঁয়াশা ছিলো।

জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসিবুল ইসলাম মিন্টু বলেন, পাপিয়া ও সুমনের সাথে জেলা ছাত্রলীগের কোন সম্পর্ক নেই। তবে তাদের সাথে কারো ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতে পারে। এ ব্যাপারে আমার ধারণা নেই।

নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি তৌহিদা সরকার রুনা বলেন, মহিলা যুবলীগের কমিটিতে ছয় বছর ধরে পাপিয়া ও আমি একসাথে রয়েছি। আমরা একসাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছি। কিন্তু কোনভাবেই জানতে পারিনি পাপিয়া এত বড় অপরাধের সাথে জড়িত। শনিবার তাদের গ্রেপ্তারের পর আমরা এ বিষয়ে জানতে পারি।

নরসিংদী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভুইয়া বলেন, খারাপ লোকের অপকর্মের দায় আওয়ামী লীগ বহন করবে না। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অন্যায়মূলক কাজ সংগঠন করেছে, যা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। তাদের বিরুদ্ধে দল ও আইন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত