ঢাকা, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

সঙ্কটের ভারে ডুবতে বসেছে রায়পুর হ্যাচারি!

  রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৬:২৯

সঙ্কটের ভারে ডুবতে বসেছে রায়পুর হ্যাচারি!

এশিয়ার বৃহৎ খ্যাত লক্ষ্মীপুরের রায়পুর মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (হ্যাচারি) ১৩ সঙ্কটে ডুবতে বসেছে। রায়পুর হ্যাচারি নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটি জোড়াতালি দিয়ে চলছে। এ হ্যাচারিকে ঘিরে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও তা কাজে আসছে না। এতে ভেস্তে যেতে বসেছে সরকারের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য।

এখানে উৎপাদিত রেণু-পোনার ব্যাপক চাহিদা। গুণগতমান ভালো থাকায় এটি দেশের অন্তত ৪০টি জেলায় সরবরাহ হয়। প্রতিবছর মৌসুমের সময় প্রতিযোগিতা দিয়ে চাষিরা তা সংগ্রহ করে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় মাত্র প্রায় ৩০ ভাগ সরবরাহ করতে পারছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে খালি হাতে ফিরে যেতে হয় বিভিন্ন জেলা থেকে দুই-একদিন আগে আসা মৎস্য চাষিদের।

প্রতিষ্ঠার তিন যুগের বেশি সময় পার হলেও এখনো সঙ্কট কাটেনি। সম্ভাবনাময় এ হ্যাচারির প্রাণ ফেরাতে দুই বছর আগে জনবল সঙ্কটসহ ১৩টি সমস্যা চিহ্নিত করে সুপারিশ করেছে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। তবে এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৫৪ একর জমিতে ৭৫টি পুকুর নিয়ে রায়পুর হ্যাচারির নির্মাণ শুরু করা হয়। ৮২ সালের জুনে এর কাজ শেষ হয়। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী এ জেড এম ওবায়দুল্লাহ খান এটির উদ্বোধন করেন। এটি এশিয়ার বৃহৎ হ্যাচারি হিসেবে জনশ্রুতি রয়েছে। মৎস্য চাষিদের গুণগত মানসম্পন্ন রেণু ও পোনার সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং মাঠ পর্যায়ে মৎস্য খাতের সঙ্গে নিয়োজিতদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে হ্যাচারি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে রায়পুর হ্যাচারি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নোমান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর কাছে সম্পূরক প্রশ্ন করে বলেছিলেন, জনবল সঙ্কট, ভবন ও পুকুরগুলো জরাজীর্ণ থাকায় হ্যাচারিটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এটি সচল রাখার ব্যবস্থা করবেন কিনা? জবাবে মন্ত্রী বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি অতিদ্রুত সম্ভাব্য সময়ের মধ্যে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।

এ প্রেক্ষিতে ২৪ সেপ্টেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (মৎস্য) অসীম কুমার বালা ও মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মো. রমজান আলী সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরে তারা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে ১৩টি সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য সুপারিশ করেন। কিন্তু দুই বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

সম্প্রতি সরেজমিনে হ্যাচারি ঘুরে দেখা গেছে, পাড় ভেঙে ও পলি জমে শুষ্ক মৌসুমে ২৬টি পুকুর পানিশূন্য হয়। ভেতরের অধিকাংশ পুকুরের ধারণকারী প্রাচীর নেই। পুকুরপাড়ের রাস্তাগুলো ভেঙে পড়ছে। পানি সরবরাহের সংযোগ দীর্ঘদিনেও সংস্কার হয়নি। অনেকাংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংযোগ বিকল রয়েছে।

প্রশাসনিক, আবাসিক, হ্যাচারি, গুদাম, রেস্টহাউজ ভবনগুলো জরাজীর্ণ এবং ব্যবহারের অনুপোযোগী। অনেকাংশে উঁচু সীমানা প্রাচীর নেই। গাড়ি ও অন্যান্য সরঞ্জাম অপ্রতুল। লোভোল্টেজ ও নিবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় কার্যক্রম পরিচালনায় বেগ পেতে হচ্ছে।

সূত্র জানায়, হ্যাচারিটিতে ৮১টি পদের মধ্যে ৬৪টিই শূন্য রয়েছে। মাত্র ১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছেন। এতে রেণু উৎপাদনসহ হ্যাচারির কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। গত তিন বছর ধরে জনবল সঙ্কট চলছে। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার চিঠি লিখেও কোন সুফল আসেনি।

হ্যাচারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, এখানে উৎপাদিত রেণু ও পোনার দেশ-বিদেশে খ্যাতি রয়েছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, চাঁদপুর, যশোর ও গোপালগঞ্জসহ অন্তত ৪০টি জেলা থেকে মৌসুমে প্রতিবছর চাষিরা এখান থেকে রেণু-পোনা সংগ্রহ করে। চলতি বছরে প্রায় ৬২ লাখ টাকার পোনা ও রেণু বিক্রিতে রাজস্ব জমা হয়েছে।

২০১৩ সালের ৫ আগস্ট প্রথম কাতল মাছের ৪ হাজার পোনা শ্রীলংকায় নেয়া হয়। এর আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত শ্রীলংকার হাইকমিশনার সারাথ কে. বেরাগোদা ও তার কার্যালয়ের প্রধান সচিব আরিশা পরআই হ্যাচারিটি পরিদর্শন করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানে কার্প রেণু, কৈ, শিং, মাগুর ও গিফট পোনা ৮ প্রজাতির মাছের পোনা ও রেণু উৎপাদন হয়।

শরীয়তপুর থেকে রেণু নিতে আসা ফারুক হোসেন মির্জা জানায়, দুই বছর আগে তিনি ৭৫ হাজার টাকার পোনা-রেণু নিয়ে চাষ করেছেন। এরপর বিভিন্ন ধাপে তিনি প্রায় ৮ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। এখন আবার নতুন করে নিয়ে চাষ করবেন। যদিও গত বছরের এপ্রিলে এসে রেণু-পোনা না পেয়ে ফিরে যাওয়ার ঘটনায় এখনও ক্ষোভ কাটেনি তার।

লক্ষ্মীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, দেশ-বিদেশে রায়পুর হ্যাচারির সুনাম রয়েছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয়। পরিকল্পিতভাবে হ্যাচারিটি আধুনিকায়ন করলে শুধু লক্ষ্মীপুরে নয়, দেশব্যাপী ব্যাপক সুফল আসবে। বেকার সমস্যাও লাঘব হবে।

এ ব্যাপারে রায়পুর মৎস্য প্রজনন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুর রহমান মজুমদার বলেন, এখানের পোনা-রেণু অন্তত ৪০টি জেলার চাষিরা প্রতিযোগিতা দিয়ে সংগ্রহ করে। কিন্তু চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ সরবরাহ করতে পারছি। তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে এখানের উৎপাদিত পোনা-রেণু দিয়ে সারাদেশে বিপ্লব ঘটানো যাবে। অনুমোদিত লোকবল নিয়োগ দিলে উৎপাদন বৃদ্ধি করে কয়েকগুন রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত