ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ মিনিট আগে
শিরোনাম

সঙ্কটের অজুহাতে সার-বীজের দাম বৃদ্ধি, শঙ্কায় আলুচাষিরা

  এস.ডি সাগর, জয়পুরহাট প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৪৪

সঙ্কটের অজুহাতে সার-বীজের দাম বৃদ্ধি, শঙ্কায় আলুচাষিরা

নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে টিএসপি সার ও বীজআলুর মূল্য বেশি নেওয়ায় জয়পুরহাটে এবার আলু চাষ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা। কৃষকদের অভিযোগ, কিছু অতিলোভী ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দিনের পর দিন ঘুরেও বীজ-সার পাচ্ছেন না অনেক কৃষক। আবার অতিরিক্ত টাকা দিলেই মিলছে এসব। সঙ্কটের অজুহাতে টিএসপি সার, বিএডিসি ও ব্র্যাকের আলুর বীজ নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন কিছু ব্যবসায়ী।

এদিকে এমন অভিযোগে জেলার বেশ কয়েকটি ডিলার ও সাব-ডিলারকে জরিমানাও করেছে প্রশাসন। তবুও থেকে নেই বেশি দামে বিক্রি।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সার-বীজের কোন সঙ্কট নেই। চাহিদা দেওয়ার পর আবারও ১৫শ' মেট্রিক টন টিএসপি সার ও ১ হাজার ১৭ মেট্রিক টন আলুবীজ চলে এসেছে। ফলে কৃষকদের আর স্কঙ্কট সমস্যা থাকার কথা নয়।

বাংলাদেশ জার্নালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এবার বাজারে আলুর চড়া দাম ও আবহাওয়া অনুকূল থাকায় আলুচাষের বিখ্যাত জেলা জয়পুরহাটে ব্যাপকভাবে চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। আর তাতেই যেন দিক হাড়িয়ে ফেলেছেন তারা। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার-বীজ আলু কিনে শেষ পর্যন্ত যদি বাজারমূল্য ভালো না পাওয়া যায়, তবে সর্বশান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তাই স্বপ্নের সাথে কিছুটা শঙ্কা নিয়েই এবার আলুর চাষ করছেন তারা।

কৃষকদের অভিযোগ, সঙ্কটের অজুহাতে জেলার বিভিন্ন বাজারে বীজ আলু ও সারের দাম নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন কিছু অতিলোভী ব্যবসায়ী। কৃষকরা সেসব দোকানে ন্যায্যমূল্যে সার-বীজ কিনতে গেলে বলা হচ্ছে আমদানি নেই। অথচ অতিরিক্ত টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে। ১১শ' টাকার টিএসপি সার তারা কৃষকদের কাছ থেকে নিচ্ছে ১৩ থেকে ১৫শ' টাকা পর্যন্ত। অনেকেই আবার বিক্রির কোন স্লিপই দিচ্ছেন না। সম্প্রতি প্রশাসন কয়েকটি ডিলারকে জরিমানা করলেও থেমে নেই বেশি দামে বিক্রি। কেউ কেউ আবার কাউকে না বলার শর্তে মেমোতে নির্ধারিত মূল্য লিখলেও হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।

এদিকে আলুর বীজের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এ গ্রেড ৪০ কেজি বস্তার বীজ আলুর মূল্য ১৮৮০ টাকা ও ১৯২০ টাকা। এছাড়াও বি গ্রেড ১৮৪০ টাকা ও অন্যান্য জাতের ১৮০০ টাকায় সরকারিভাবে বিক্রির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা সঙ্কটের অজুহাত দেখিয়ে ৪০ কেজির প্রতিবস্তা অ্যাস্টেরিক, ক্যারেজ ও ডায়মন্ড জাতের আলুবীজ ২৩শ' থেকে ২৮শ' টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, কিছু ব্যবসায়ী সার বা বীজ তাদের গোডাউনে না রেখে অন্য কারো বাড়িতে বা গুপ্ত কোন স্থানে লুকিয়ে রাখছে। কেউবা গোডাউনে রেখেই বলছে নেই। নিরুপায় হয়ে যারা বেশি টাকা দিচ্ছে, তাদেরই মিলছে এসব।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, জেলায় এবার ৪০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হচ্ছে। যা গতবছরের তুলনায় প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর বেশি। গত বছর জেলায় ৩৮ হাজার ৩২৫ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছিলো।

কোমরগ্রামের কৃষক আলআমিন হোসেন বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, গত বছর আমি এক বিঘা আলু চাষ করেছি ১৭ হাজার টাকায়। কিন্তু এবার সার-বীজের দাম বেশি হওয়ায় আমার ২২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হিচমী বাজারের একটি দোকান থেকে আমি বীজআলু ২৬শ' টাকায় কিনেছি। তবে তার নির্ধারিত মূল্য ২১শ' টাকা। উৎপাদনের সময় যদি ন্যায্যমূল্য না পাই তাহলে সর্বশান্ত হয়ে যাবো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একই গ্রামের আরও এক কৃষক বলেন, আমিও হিচমী বাজারের একটি দোকান থেকে ২৫শ' টাকা করে দুই বস্তা বীজআলু কিনেছি। এছাড়াও সারের দামও তারা বেশি নিচ্ছে।

আক্কেলপুরের রায়কালী বাজারে সার কিনতে আসা কৃষক আকরামুল হক বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, ৫ দিন থেকে ঘুরছি টিএসপি সার‌ কেনার জন্য। সবাই বলছে সার নেই। কিন্তু যারা বেশি টাকা দিচ্ছে তাদেরকেই তারা সার দিচ্ছে। আমরা গরীব কৃষক, আমরা কোথায় যাব?

কালাইয়ের পুনট বাজারে সার কিনতে আসা আমিরুল নামে এক কৃষক জানান, সবাই সার বেশি দামে বিক্রি করছে। প্রশাসন এসে জরিমানা করার পরও পরে তারা আবার বেশি নিচ্ছে।

এদিকে ডিলাররা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, প্রথমে যা বরাদ্দ ছিলো, তা কৃষকদের চাহিদা বেশি থাকায় শেষ হয়ে গেছে। তাই কিছুটা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। নতুন বরাদ্দ পেলে আর সঙ্কট থাকবে না।

নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে দাম যদি বেশি নেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্ন করলে তারা বলেছেন, ডিলাররা স্লিপ দিয়েই ন্যায্যমূল্যে সার-বীজ আলু বিক্রি করছেন। যদি দাম বেশি নিয়ে থাকে তাহলে সেটা সাব-ডিলাররা নিচ্ছে।

তবে একই কথা বলে ডিলারদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে সাব-ডিলাররা। তারা বলছেন, অল্প যা বরাদ্দ পেয়েছিলেন তা কৃষকদের চাহিদা বেশি থাকায় আগেই শেষ হয়েছে। পরে ডিলারদের কাছ থেকে তারা টিএসপি সার ও বীজআলু কিছুই পাচ্ছে না। নতুন বরাদ্দ আসলে কৃষকরা পর্যাপ্ত সার পাবে।

ক্ষেতলালের বটতলী বাজারের বিএডিসির অনুমোদিত বীজ ডিলার দুলাল মিয়া জানান, প্রতি বছর তিনি কৃষকদের কাছে বিপুল পরিমাণ আলুবীজ বিক্রি করেন। কিন্তু এবার বিএডিসি বীজআলু কিছুটা দেড়িতে বাজারে সরবরাহ করায় বীজের ব্যাপক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। তাদের চাহিদা মেটাতে কম উৎপাদন হওয়া জেলাগুলো থেকে তিনি বেশি দাম দিয়ে বীজ সংগ্রহ করে কৃষকদের চাহিদা মেটাচ্ছেন। নতুন বরাদ্দ হয়েছে এখন আর কোন সঙ্কট থাকবে না।

মোসলেমগঞ্জ বাজারের ডিলার মেসার্স নাছিমা বীজের আসাদ আলী ফকির বলেন, টিএসপি সারের আমার বরাদ্দ খুব কম ছিল। নতুন করে নাকি আবার বরাদ্দ হয়েছে। সেই বরাদ্দ পেলে সব কৃষকরা সার পাবে। আমার এখানে কোন দাম বেশি নেয়া হয়নি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, ইতিমধ্যে জেলার প্রায় ৫০ ভাগ জমিতে আলু চাষ শেষ হয়েছে। বর্তমান বাজারে আলুর দাম বেশি হওয়ায় এবার বেশি করে আলুর চাষ করছেন কৃষকরা। এবার প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলুর চাহিদা ছিল। আর টিএসপির চাহিদা ছিল ২ হাজার মে. টন। তবে প্রথম দিকে কিছুটা সঙ্কট দেখা দিলে নতুন করে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। ইতিমধ্যে আরও ১৫শ' মে. টন টিএসপি সার চলে এসেছে। এছাড়াও ১ হাজার ১৭ মে. টন আলুবীজও এসেছে। কৃষকদের আর কোন সঙ্কট থাকবে না।

এ বিষয়ে বিএডিসি’র বীজ বিপণন জয়পুরহাট অঞ্চলের সহকারী উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, বিভিন্ন জাতের ‘এ’ গ্রেড আলুবীজ প্রতিমণ ১ হাজার ৮৮০ টাকা এবং ‘বি’ গ্রেড ১ হাজার ৮৪০ টাকা দরে কৃষকের কাছে বিক্রির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলায় ডিলার পর্যায়ে ১ হাজার ৭৬০ এবং কৃষক পর্যায়ে ৪৪০ টন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এরপরেও ১ হাজার ৭শ' টন সরবরাহ করা হয়েছে।

তিনি জানান, বর্তমান ডিলারদের কাছে বীজ আলুর কোন সঙ্কট নেই। আগামীতে আরও বরাদ্দ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বাংলাদেশ জার্নালকে জানান, বর্তমান সার-বীজ আলুর কোন সঙ্কট নেই। নতুন বরাদ্দের ১৫শ' টন মেট্রিক টন টিএসপি সার ও ১ হাজার ১৭ মেট্রিক টন আলুবীজ সরবরাহ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এসব বিতরণ শুরু হয়েছে।

তিনি আরও জানান, বেশি দামে বিক্রি করায় জেলায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও আমাদের এই অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত