ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১০ মিনিট আগে
শিরোনাম

দলিল লেখকের একাউন্টে কোটি কোটি টাকা

  মাহফুজুর রহমান, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:২১  
আপডেট :
 ৩০ ডিসেম্বর ২০২০, ২০:০১

দলিল লেখকের একাউন্টে কোটি কোটি টাকা
ছবিতে- দলিল লেখক নাসির উদ্দীন

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক নাসির উদ্দীন চৌধুরী এখন দুদকের জালে। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া মাত্র ৪ শতক জমি থেকে এখন মাঠে প্রায় ৬০ বিঘা জমি। ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা। আছে আলিশান বাড়ি। স্ত্রী থাকার পরও শ্যালিকা বিয়ে করে তাদেরও সম্পদ দিয়ে ভরপুর করেছেন। শুনতে আবাক হলেও পেশায় একজন দলিল লেখকের এই অঢেল সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। অর্থ আর রাজনৈতিক ক্ষমতায় হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। চলাফেরা করেন দাপটের সঙ্গে। হত্যাসহ একাধিক মামলা ছিলো তার নামে।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নাসির চৌধুরী নামক এই দলিল লেখকের বিরুদ্ধে অবৈধ পন্থায় প্রায় ৬ কোটি টাকার অর্থ উপার্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক।

দুদকের যশোর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মোহাঃ মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এই মামলাটি করেন। আদালত মামলাটি নথিভুক্ত করে আগামী বছরের ৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

নাসির চৌধুরী ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সিমলা-রোকনপুর ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের জামসের আলী চৌধুরীর ছেলে। তিনি বর্তমানে কালীগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক হিসেবে সমিতির সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি তিনি কালীগঞ্জের সিমলা-রোকনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের সাবেক সহকারী পরিচালক শহিদুল ইসলাম মোড়ল নাসির চৌধুরীর বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলোর তদন্ত করেন। তদন্তকালে দেখা যায়, আসামি নাসির চৌধুরী তার নিজ নামে ব্র্যাক ব্যাংক যশোর শাখায় একটি সঞ্চয়ী হিসাব ও ১২ টিএফডিআর হিসাব খোলেন। এগুলোতে তিনি বিভন্নি সময়ে মোটা অংকের টাকা লেনদেন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী হিসাব থেকে টাকা স্থানান্তর করে অন্য এফডিআর এ জমা করা হয়েছে। সর্বোপরি সকল ক্ষেত্রে এফডিআর হতে হস্তান্তর করে মূল সঞ্চয়ী হিসাবে এনে আবার সেখান থেকে উত্তোলন করেন। নাসির উদ্দিন চৌধুরী ২০১২ সালের ৭ ফেব্রয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে মোট ৭ টিএফডিআর এ ১ কোটি ৭৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা করেছিলেন। যা থেকে তিনি ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করে একই ব্যাংকে স্ত্রী খাদিজা বেগমের নামে সঞ্চয়ী হিসাবে হস্তান্তর করেন।

এছাড়া তিনি ওই শাখায় স্ত্রী খাদিজা বেগমের নামে একটি সঞ্চয়ী ও ৫টি এফডিআর খুলে লেনদেন করেন। যার মধ্যে সঞ্চয়ী হিসাবটি এখনও চলমান রয়েছে। ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে ওই ৬টি সঞ্চয়ী ও এফডিআরের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা লেনদেন করেন। তিনি স্ত্রীর নামের এই সকল এফডিআর ও সঞ্চয়ী হিসাব থেকে ১ কোটি ২৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪১৬ টাকা উত্তোলনপূর্বক স্থানান্তর করেন।

অভিযুক্ত নাসির উদ্দিন তার শালিকা (দ্বিতীয় স্ত্রী) মোছা. মাহফুজা খাতুনের নামে যশোরের ব্র্যাক ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব ও ৪টি এফডিআর খুলে লেনদেন করেন। যার মধ্যে বর্তমানে একটিও চলমান নেই। ওই ৫টি হিসাব পর্যালোচনা করে দুদক নিশ্চিত হয়েছে যে, অভিযুক্ত নাসির উদ্দিন তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঞ্চয়ী হিসাবের টাকা জমা করে সেখান থেকে এফডিআর হিসাবে জমা করেছেন। যেখান থেকে আবার সঞ্চয়ী নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

গত ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ১৪ মে তারিখ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার ৬২৮ টাকা উত্তোলনপূর্বক স্থানান্তর করেছেন নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তার শ্যালক জিয়াকুব আলীর নামে একই ব্র্যাক ব্যাংক ও যশোরের এবি ব্যাংকে এফডিআর ও এম.আই.ডি.এস হিসাব খুলে ৮০ লাখ টাকা জমা করেছিলেন। যা সম্পূর্ণ উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করেন। তার শ্যালক তদন্তকারী সংস্থাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নাসির উদ্দিনের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মারুফ হোসেন রিয়াজের নামে রূপালী ব্যাংক কালীগঞ্জ শাখায় আর.এস.এস হিসাব খুলে সেখানে ৩০ লাখ টাকা জমা করেন। এ সকল বিষয় মামলায় উল্লেখ করেছে দুদক।

মামলায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্ত নাসির উদ্দিন চৌধুরী অবৈধ পন্থায় দুর্নীতির মাধ্যমে ৫ কোটি ৭০ লাখ ৭৩ হাজার ৪৪ টাকা অর্জন করেছেন। নিজ নামে, প্রথম স্ত্রী খোদেজা বেগম, দ্বিতীয় স্ত্রী মাহফুজা খাতুন, শ্যালক জিয়াকুব আলী ও ছেলে মারুফ হোসেন রিয়াজের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআরে জমা করেন। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ টাকা উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করেন। আর এই অপরাধে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২) ধারায় সিনিয়র স্পোশাল জজ আদালতে মামলার আবেদন করা হয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ নভেম্বর দুদক কর্মকর্তা ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি নথিভুক্ত করার আবেদন করেন। আদালত শুনানি শেষে ৩০ নভেম্বর আদেশের দিন ধার্য্য করেন। ধার্য্য তারিখে মামলা নথিভুক্ত করে আগামী ৩ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য দুদক কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে দুদক যশোর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নাজমুস সাদাত জানান, তারা দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমতি পেয়ে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তদন্ত ও পরবর্তীতে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি তদন্ত চলছে, এখনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।

এ বিষয়ে দলিল লেখক নাসির উদ্দীন চৌধুরী জানান, মামলা দায়েরের খবর তিনি জানেন না। তাই এ বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে চাননি।

উল্লেখ্য, কালীগঞ্জ শহরের আড়পাড়ায় দলিল লেখক নাসির চৌধুরীর ৩টি আলীশান বাড়ি, নদীপাড়ায় একটি ও কুল্লোপাড়ায় বাগানবাড়ি রয়েছে। দলিল লেখক নাসির চৌধুরীর জমিজাতি আছে অঢেল।

অভিযোগ রয়েছে, গ্রামে তার কারণে কেউ উচ্চমূল্যে জমি কিনতে পারে না। তার কাছে জমি বিক্রি না করলে বাড়িতে হামলা করা হয়। বাবার ৪ শতক জমি থেকে নাসির চৌধুরী শত কোটি টাকার জমি কিনেছেন।

সর্বশেষ তথ্যমতে, নাসিরের নামে ৫৯.২৭ বিঘা জমির সন্ধান মিলেছে। কালীগঞ্জের বাবরা, পকুরিয়া, তিল্লা, ডাকাতিয়া, এ্যাড়েখাল, মনোহরপুর, সিমলাসহ বিভিন্ন মাঠে এই জমি রয়েছে। এ নিয়ে ২০১৯ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত