ঢাকা, শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৯ মিনিট আগে
শিরোনাম

১১৭ শিক্ষক-কর্মকর্তার নাম শিক্ষামন্ত্রীর টেবিলে, তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০১৮, ১৭:৪১  
আপডেট :
 ০১ মার্চ ২০১৮, ১৭:৪৫

১১৭ শিক্ষক-কর্মকর্তার নাম শিক্ষামন্ত্রীর টেবিলে, তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাঠ প্রশাসনে মিলেমিশে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য চলছে। সারা দেশে অসাধু শিক্ষক, জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট এসবের সঙ্গে জড়িত। ওই সিন্ডিকেটের ১১৭ জনের নাম বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রীর টেবিলে আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সম্প্রতি তালিকা করে ব্যবস্থা নিতে নামগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই একজন শিক্ষকের ঘুষ দেয়া শুরু হয়। এমপিওভুক্তির কাজকে ঘুষের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করা হয়। গড়ে তোলা হয় সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটে শিক্ষা অফিসের দারোয়ান-ড্রাইভার থেকে শুরু করে উপপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন। এরা মিলে মাঠপর্যায়ের শিক্ষা অফিস, বিশেষ করে মাউশির আঞ্চলিক অফিসগুলো দুর্নীতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছে।

এমপিওর কাজে এক একজন শিক্ষক বা কর্মচারীকে ন্যূনতম ৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। টাকা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এমপিওভুক্তির কাজ মাঠ প্রশাসনে ছেড়ে দেয়ার পর এই ঘুষ বাণিজ্য রাতারাতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। শিক্ষকরা উৎকোচের শিকার হওয়ায় প্রকারান্তরে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা খাতে স্বচ্ছতা আনতে গোয়েন্দা সংস্থাটি ৫ দফা সুপারিশ করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এবং অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, চিহ্নিত ১১৭ জনের মধ্যে ৮৬ জন জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। ৬ জন বিভাগীয় উপপরিচালক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন দফতরের ১৬ জন কর্মচারীও আছে। সিন্ডিকেটে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রধানরাও আছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার এক মাস পর এখন পর্যন্ত ২৫ জনকে বদলি করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজন পেয়েছেন প্রাইজ পোস্টিং।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তালিকা পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এমপিও কার্যক্রমে দুর্নীতি করার দায়ে কিছু কর্মকর্তার নাম সংবলিত একটি তালিকা আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পেয়েছি। এটি আমাদের জন্য একটি ইনডিকেশন (নির্দেশনা)। আমরা এখন তালিকাটি পর্যালোচনা করছি। অপরাধী কেউ রেহাই পাবে না। অপরাধ অনুযায়ী অভিযুক্তদের ক্লোজড, বদলি, ওএসডি, শোকজসহ নানারকমের ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ ব্যাপারে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের কেউই রেহাই পাবেন না। এমনকি ভবিষ্যতেও কেউ কোনো অপকর্মে চিহ্নিত হলে কঠোর পরিস্থিতির মুখে পড়বেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তালিকার মধ্যে উপপরিচালকদের ব্যাপারে ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। মাউশির অধিক্ষেত্রে চিহ্নিতদের ব্যাপারে দু’দফা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তালিকা ধরে বাকিদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার কাজ চলছে।’

সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা মাঠপর্যায়ে এমপিও কার্যক্রমে ঘুষ বাণিজ্য ও দুর্নীতির ওপর অনুসন্ধান চালায়। সেই অনুসন্ধান প্রতিবেদনই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো হয়। তালিকাটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যেসব ক্ষেত্রে কেস স্টাডি এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে, শুধু সেই অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী এমপিও প্রার্থীর নাম-পরিচয় এবং প্রমাণ হিসেবে মোবাইল নম্বরও দেয়া হয়েছে। উল্লেখ আছে ঘুষের পরিমাণ। দাবিকৃত টাকা না দেয়ায় কতদিন ঘোরানো হয় ইত্যাদি বিষয়ও এতে বলা হয়েছে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কিছু জায়গায় কে অভিযুক্ত তা অভিযোগকারীর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। সেসব ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম তালিকায় উল্লেখ করা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট অফিস যে দুর্নীতিপ্রবণ সে বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশিতে ঘাপটি মেরে থাকা সিন্ডিকেটের হোতারা মাঠ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বাঁচাতে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের এই ‘ইতিবাচক’ দিকটিকে ‘দুর্বলতা’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ কারণে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক মাস আগে নির্দেশ দেয়ার পরও ধীরে চলছে সংশ্লিষ্টরা। এ পর্যন্ত মাত্র ১৩ জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও ২ উপপরিচালককে বদলি করা হয়েছে। কাউকে প্রাইজ পোস্টিংও দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ বুধবার ১০ কর্মচারীকে বদলি করা হয়েছে। অথচ সরকারি চাকরিতে ‘বদলি’ কোনো শাস্তি নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, শিক্ষা খাতে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ নানা মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগের বড় কর্তাদের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু তারা কারও বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেন না। গত ৯ বছরে বড় ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার তেমন নজির নেই। এক বছর আগে মাউশির কয়েকজন আঞ্চলিক পরিচালকের বিরুদ্ধে এমপিও-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ‘তিরস্কার’র মতো লঘুদণ্ড দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, কয়েক মাস পর সেই লঘুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনকে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। শিক্ষা প্রশাসনে বদলিকে শাস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে কোনো বিষয়ে বড় ধরনের সমালোচনা উঠলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি ছাড়া অন্য কোনো ‘শাস্তি’ না দেয়ার রেওয়াজই চলে আসছে শিক্ষা প্রশাসনে।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘চিহ্নিতদের শাস্তিমূলক বদলি করতে গেলেও আমাদের বাধার মুখে পড়তে হয়। অনেকেই প্রভাবশালী মহল দিয়ে তদবির করান। এ কারণে আমি এবারের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তালিকা ধরে) পদক্ষেপ নেয়ার আগে ঘোষণা করেছি, যে বা যারা তদবির করাবেন, তার বা তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

জানা গেছে, এরপরও চিহ্নিতরা তদবির করাতে পিছপা হয়নি। মঙ্গলবার তালিকাভুক্ত ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপপরিচালক এএসএম আবদুল খালেককে বদলি করা হয় নড়াইলের ডিইও পদে। কুমিল্লার উপপরিচালক মোহাম্মদ হোসেনকে চাঁদপুরের একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে স্বপদে থাকতে বেপরোয়া একজন তদবির করিয়েছেন। ওই অঞ্চলের একজন প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রীর ডিও (আধাসরকারি পত্র) পর্যন্ত তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে চার উপপরিচালকের নাম আছে। এদের মধ্যে একজনকে বদলি করা হয়েছে। তবে এই বদলি আগের চেয়ে তুলনামূলক ভালো পদ। তাকে একটি কলেজের উপাধ্যক্ষ করা হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো তালিকায় ১৮ জন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নাম আছে। এদের মধ্যে দু’জন আছেন যারা বর্তমানে পিআরএলে আছেন। একজন আছেন সাবেক ডিইও। এই তালিকায় আরও ৬৮ জনের নাম আছে। যাদের মধ্যে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা অফিসের পরিদর্শক, একাডেমিক সুপারভাইজার, প্রোগ্রামারসহ বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নামও আছে। এ তালিকায় রংপুরের একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, গোপালগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং বরিশালের একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের নাম আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা অফিসের সিন্ডিকেটে বড় ভূমিকা পালন করেন সেখানের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, স্টেনো-টাইপিস্ট ও অফিস সহকারী, নৈশপ্রহরী পর্যায়ের কর্মচারীরা। কোথাও আবার একশ্রেণীর অসাধু অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক এমনকি শিক্ষক নেতা এবং প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য দালালের ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এমন ১৬ কর্মচারীর নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা কোথায় কি করেছেন সে বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছে।

আরো পড়ুন : এমপিওভুক্তি ও জাতীয়করণে ঘুষ বন্ধে যা করণীয়

/এসকে/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত