ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

বিসিএস বিরোধীতায় যাদের ঘুম নেই!

  সত্যজিত চক্রবর্তী

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:২৪  
আপডেট :
 ২৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৩২

বিসিএস বিরোধীতায় যাদের ঘুম নেই!

বাংলাদেশে যে পরিমাণ বেকার আছে পৃথিবীর অনেক দেশে সে পরিমাণ জনসংখ্যাও নেই। আইসল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার চেয়েও এদেশে বিসিএস ক্যান্ডিডেটের সংখ্যা বেশি। এদেশে কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে তাকে বলা হচ্ছে "ছেড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখো না"। এদেশে ছেলেমেয়েরা গবেষণায় মনযোগ না দিয়ে কেন বিসিএস ক্যাডার হচ্ছে, এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেও অনেকে গবেষক হয়ে গেছেন। কেউ কেউ রীতিমত ক্ষোভে দুঃখে ছটফট করছে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া স্টুডেন্ট কেন বিসিএস দিয়ে পুলিশ হচ্ছে, ডাক্তারি পাশ করা মেয়েটি কেন বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছে এসব নিয়ে। জনাব বিশেষজ্ঞবৃন্দ, আপনাদের মতামতের প্রতি আমি সত্যজিৎ পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এসব নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দেয়ার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন:

১। কয়টা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আছে যারা অভিজ্ঞতা ছাড়া চাকরি দিচ্ছে? একজন সদ্য গ্র‍্যাজুয়েট চাকরির জন্য সে কিভাবে অভিজ্ঞতা পাবে? একটা সেমিনার শেষে যখন লাঞ্চ করছিলাম, তখন একজন নিয়োগদাতাকে এই প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বললেন- "দাদা, আমরা তো সেরাটাই চাইব। অভিজ্ঞ ক্যান্ডিডেট পেলে আমরা কেন অনভিজ্ঞ ক্যান্ডিডেট নিব। " কাম টু দ্যা পয়েন্ট। সদ্য গ্র‍্যাজুয়েটদের অভিজ্ঞতা নেই তাই তারা সরকারি চাকরিতে যাচ্ছে, কারণ সেখানে অভিজ্ঞতা লাগে না, মেধা লাগে।

২। কতজন ইঞ্জিনিয়ার আছেন যারা প্রাইভেট কোথাও জব পাচ্ছেন তাদের চাহিদার বেতনে। আমার পরিচিত অনেক ইঞ্জিনিয়ারকে দেখেছি যাদের স্টার্টিং স্যালারি ১২ হাজার টাকা। আবার বলছি মাত্র ১২ হাজার টাকা। সেই ছেলেটা কেন চাইবে না গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ১২ হাজার টাকার চেয়েও বেশি বেতন ও সুবিধা নিয়ে সরকারি চাকরিটা করতে? উত্তর আছে?

৩। অনেক কোম্পানি বর্তমানে নিয়োগ দেয়ার সময় অলরেডি ভার্সিটির নাম উল্লেখ করে দিচ্ছে। তাহলে জনাব আপনার কাছে আমি সত্যজিৎ প্রশ্ন রাখছি, দেশে যে এতগুলো প্রাইভেট ভার্সিটি আর ন্যাশনাল ভার্সিটির স্টুডেন্টস আছে তারা কি তাহলে সরকারি চাকরিতে আবেদন না করে বেকার থাকবে? কারণ কোম্পানীগুলো যেসব ভার্সিটির নাম উল্লেখ করে দিচ্ছে সেসব ভার্সিটি সব পাবলিক ভার্সিটি।

৪। কয়টা কোম্পানি এদেশে আছে যারা ইতিহাস, বাংলা, রাষ্টবিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স করা ছেলেকে নিয়োগ দিচ্ছে? এমবিএ ছাড়া অন্যান্য সাবজেক্ট থেকে তো কোথাও কোনো কোম্পানি নিয়োগ দিচ্ছে না। এই এক এমবিএ ছাড়াও যে দেশে শ'খানেক সাবজেক্ট নিয়ে লাখখানেক স্টুডেন্ট গ্র‍্যাজুয়েট হচ্ছে, তাদের কি তাহলে বেকার থাকতে বলবেন? কোম্পানিগুলো যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তখন সরকারি চাকরিগুলো তাদের জন্য দরজা খোলা রেখে দিয়েছে।

৫। প্রাইভেট চাকরিতে ঢুকে বসের সাথে মনোমালিন্য হওয়ার কারণে কতজনকেই তো চাকরি ছাড়তে হলো। কারণ প্রাইভেট জব ব্যক্তিনির্ভর আর সরকারি চাকরি সিস্টেম নির্ভর। সরকারি চাকরির মত নিশ্চয়তা যদি কেউ অন্য কোথাও না পায়, তবুও আমি কোন মুখে একজন সরকারি চাকরি পাওয়ার মত যোগ্য ব্যক্তিকে বেসরকারি চাকরির অনিশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দিব?

৬। দেশের প্রায় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে না। বরং তাদের লোক প্রয়োজন হলে তাদের পছন্দের ভার্সিটিতে গিয়ে সিভি নিয়ে আসছে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে তারা হাজার হাজার সিভি দেখার ঝামেলা এড়াতে মাত্র ২/১ টা সেরা ভার্সিটতে গিয়ে অল্প কিছু সিভি কালেক্ট করে নিয়ে যায়। এখানেও প্রশ্ন, তাহলে বাকি ভার্সিটির স্টুডেন্টরা আবেদন করার জন্য কোনো কোম্পানিই তো পাচ্ছে না। কথা বাড়াচ্ছি না। আমিও চাই এদেশের সবাই সরকারি চাকরির দিকে না ঝুঁকে কেউ উদ্যোক্তা হোক, কেউ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করুক। কিন্তু এই আপনিই তো আবার আপনার বোন বা মেয়ের জন্য পাত্র আসলে প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করা ছেলেটির চেয়ে সরকারি অফিসারকে প্রাধান্য দেন বেশি। কেন? পরিবর্তনটা না হয় আগে আপনিই শুরু করুন। যার বোয়াল মাছ ধরার যোগ্যতা আছে, সে কেন পুটি মাছ ধরবে? আপনি নিজে আপনার ছোট ভাইটিকে বিসিএস কিংবা ফার্স্ট ক্লাস গভর্নমেন্ট জবের পরামর্শ দিয়ে, নিজে আবার ফেসবুকে কিংবা পত্রিকায় কলাম লিখছেন " তরুণদের অতি বিসিএস প্রীতি দেশের জন্য হুমকি "। কী দারুণ!

দেশের প্রায় সব প্রাইভেট ভার্সিটির মালিকগণ শিল্পপতি। তাঁরা কতজন তাঁদের নিজের শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিজের গড়া ভার্সিটির স্টুডেন্টদের চাকরি দিয়েছেন? শুধু তাই নয়, পাবলিক ভার্সিটিতে ইতিহাস, বাংলা, পদার্থ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে পাশ করা কতজন ছাত্রকে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলো কাজের সুযোগ দিচ্ছে? কারণ তাদের লাগবে এমবিএ ডিগ্রীধারী। আবার হাজার হাজার এমবিএ ডিগ্রীধারী যখন সিভি নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে যাবে, তখন তারা খুঁজবেন অভিজ্ঞ প্রার্থী। এতসব যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে তাই সবাই সরকারি চাকরির দিকে এগুচ্ছে। এদেশের গ্র‍্যাজুয়েটদের ক্যারিয়ার নিয়ে রং তামাশা অনেকেই করছে।

সবশেষে, আমি সত্যজিৎ নিজেও চাই এদেশের গ্র‍্যাজুয়েটরা সরকারি বেসরকারি সব জায়গায় পদার্পন করুক। এরা উদ্যোক্তা হয়ে আরো কয়েকশ পরিবারের চাকরির ব্যবস্থা করুক। এরা গবেষণায় মনযোগ দিয়ে নতুন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করুক। তবে ক্যারিয়ার মাঠে যেন তাকে আফসোস করতে না হয়" ইশ আমার ঐটা করার যোগ্যতা ছিল, কেন যে এটাতে এলাম "। আগে এই আফসোসের জায়গাটা দুর করার জন্য সব জায়গায় সমান সুবিধা নিশ্চিত করুন।

লেখক: পাবলিক স্পিকার ও কর্পোরেট ট্রেইনার, প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ ক্যারিয়ার ক্লাব (লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত)

  • সর্বশেষ
  • পঠিত