ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সুষ্ঠু তদারকি

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২২, ১৩:২৯

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সুষ্ঠু তদারকি
ড. জান্নাতুল ফেরদৌস

দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত অগ্রসরমান দেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি অনেকদিন ধরেই টালমাটাল। সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করতে পেরে দেশটি নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করেছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননে সরকার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। গভীর সংকট হাতছানি দিচ্ছে এ অঞ্চলের আরেক দেশ নেপালকেও। তবে সেরকম সংকটে না পড়লেও বাংলাদেশের মানুষ হিমশিম খাচ্ছে দ্রব্যমূল্যের নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতিতে।

বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত এবং উদ্বেগের বিষয় হল দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সঠিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকি করতে পারছে না। ফলে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় চাপে পড়েছে গরিব মানুষ আর এ অবস্থায় তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

অন্যদিকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষিমন্ত্রী প্রেস ব্রিফিং করে জানিয়েছিলেন, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সার, সেচ, বীজ, বালাইনাশকসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের জন্য ভর্তুকি প্রদানের বাস্তব অবস্থা। ফলস্বরূপ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়তে থাকায় কম দামে পণ্য পেতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ টিসিবির ন্যায্যমূল্যের চার ধরনের ভোগ্যপণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছে৷

আবার অসাধু ব্যবসায়ীরূপী সিণ্ডিকেট মহলের পরিকল্পিত কারসাজিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে পবিত্র রমজানের মতো মহিমান্বিত মাসেও রোজাদারদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

বস্তত দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতিতে বর্তমানে দিশেহারা দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বেঁচে থাকার তাগিদে আজ তারা আত্মপরিচয় ভুলে টিসিবির ট্রাকের পেছনে ছুটছে। নিম্নবিত্তের সঙ্গে একই কাতারে দাঁড়িয়ে স্বল্পমূল্যে পণ্য কিনতে প্রতিযোগিতা করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

অর্থনীতির হিসাবে গড় আয় এবং প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষের আয় বাড়েনি, ক্রয়ক্ষমতা বরং হ্রাস পেয়েছে। যেহেতু দ্রব্যমূল্য বাড়তি, টাকার মান কমছে ফলে মানুষের প্রকৃত আয়ও কমতির দিকে। এ অবস্থায় কেবল পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খাচ্ছেন মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত মানুষরা। করোনাকালে দারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়েছে এবং এখন তাদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রীও পরিস্থিতির অবনতির কথা স্বীকার করেছেন এবং তিনি এর আশু উন্নতিরও কোনো পথ দেখাতে পারেননি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ২০২০ সালে ১৮টি সবজি বাজার পর্যবেক্ষণ করে বলেছে, সবজির দাম বেড়েছে ১০ শাতংশের বেশি। বর্তমানে সেটি আরও বেড়েছে। এই ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুতের দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি। উল্লিখিত ব্যয়চিত্রের মধ্যে কোনো বিলাসদ্রব্যকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। কোনো ধরনের বিনোদনকেও বিবেচনায় নেয়া হয়নি। স্রেফ প্রাকৃতিক অক্সিজেনের মাধ্যমে বেঁচে থাকা। হিসাব করে দেখা গেছে, অপরিহার্য ৮টি উপখাতে ব্যয় বৃদ্ধির হার গড়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ। এর মানে হলো, যে ব্যক্তি তিন বছর আগে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করে জীবন নির্বাহ করতেন, তার জীবনমান বজায় রাখতে এখন আয় করতে হবে প্রতিমাসে ৪০ হাজার ৮০০ টাকা। এ অতিরিক্ত ১০ হাজার ৮০০ টাকার সমাধান কে দেবে? সেই দুশ্চিন্তায় নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছেন অনেকে।

দুর্গতির এখানেই শেষ নয়; আগামী দিনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে ১১৫ শতাংশ। বিদ্যুতের দাম ৬৬-৭৯ শতাংশ এবং পানির দাম ২০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাবনাও আছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), পিপিআরসি ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণা ও জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে দেশে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। তাদের মতে, দারিদ্র্যের এই হার করোনাপূর্ব ২১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশ হয়েছে। যদিও সরকার বারবারই বলছে, এ হার অনেক কম। কিন্তু সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছে এর সমর্থনে কোনো তথ্য নেই।

২০২০ সালের অক্টোবরের বিবিএস-এর এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের আয় ২০ শতাংশ কমে গেছে। একদিকে আয় কমেছে ২০ শতাংশ, অপরদিকে ব্যয় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। তার মানে হলো, ১০০ টাকার আয় কমে ৮০ টাকা হয়েছে আর ১০০ টাকার ব্যয় বেড়ে ১৩৬ টাকা হয়েছে। আয়-ব্যয়ের ব্যবধান হলো ৫৬ শতাংশ। এ বিশাল ঘাটতি মেটানোর উপায় সাধারণ মানুষের জানা আছে কি?

তাহলে দাম বৃদ্ধির এ অবস্থায় সরকারের করণীয় কী? অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের কাছে বাজার নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার তিনটি। সেগুলো হলো- পণ্যের ওপর শুল্ক-কর কমানো, খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো এবং বাজার তদারকি জোরদার করা।

যে কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে, এর অনেকটা দায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। অথচ কৌশলগত এ পণ্যটির ওপর প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ হার কমিয়ে বাজারদর সমন্বয় করা হয়েছে। সরকার খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এর আকার অনেক বেশি বিস্তৃত ও সহজ করা প্রয়োজন। আর শেষ হাতিয়ার হিসাবে বাজার তদারকির কাজটি খুব একটি কার্যকর নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সিন্ডেকেটগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা সরকার নিতে পারছে না। এ দিকটাতে নজরদারি বাড়াতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বল্প মেয়াদে দাম কিছুটা বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। তবে জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় কমিয়ে আনতে পারলে সাশ্রয় করা সম্ভব। এর বাইরে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন চাহিদার চেয়ে দ্বিগুণ। তাতে অনেক বেসরকারি উৎপাদন প্ল্যান্টকে অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ অপচয়ের কোনো প্রয়োজন নেই।

অর্থনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন বর্তমানে মধ্যস্বত্বভোগীদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে বাজার। সরকার কেবল টিসিবির মাধ্যমে এদের মজুদদারিসহ মূল্য বৃদ্ধির কৌশল ঠেকাতে পারবে না। এর জন্য আরও ব্যাপক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের যে হিসাব দেয়া হয় তা সম্ভবত বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

কাজেই বিকল্প একটাই, অতিসত্বর পরিকল্পিত বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেইসাথে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য লাগাম টেনে সাধারণ নাগরিকদের দুর্ভোগ লাঘবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নাগরিকদের কাছে ভোগ্যপণ্য সহজলভ্য করে তোলা জরুরি।

লেখকঃ ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ জার্নাল/পিএল

  • সর্বশেষ
  • পঠিত