ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৪৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

লাইক-ভিউয়ের মরণফাঁদ!

  রোকন কাফি

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২২, ২০:৪০  
আপডেট :
 ১৩ জুলাই ২০২২, ২৩:০০

লাইক-ভিউয়ের মরণফাঁদ!

প্রাণ থাকলে মৃত্যু অবধারিত। এটি চিরন্তন সত্য। রোগ-শোক-বয়স-জরাসহ নানা অপঘাতে জীবনের সমাপ্তি। যে কোনো বয়স-শ্রেণি-পেশার মানুষের মৃত্যুতেই রচিত হয় কতো না শোকগাথা। জীবন-জীবিকার জন্যও মানুষ মৃত্যুমুখে পড়ে। কিন্তু শখ-সৌখিনতার জন্য বেঘোরে প্রাণ হারানোর ঘটনাগুলো খুবই উদ্বেগ জাগানিয়া। একের পর এক মর্মন্তুদ এসব ঘটনা কীভাবে বিশ্লেষণ করা যায়!

পরিবর্তিত সময়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন এখন অনেক গতিশীল। ইন্টারনেট, কম্পিউটারসহ নানা গ্যাজেটে মোড়া শহুরে জীবন কতো আয়েশি। আর স্মার্টফোন ছাড়া তো নাওয়া-খাওয়াও যেন মিছে! শুধু কি শহর! স্মার্টফোন ছাড়া তো প্রত্যন্ত জনপদেও আপনি আনস্মার্ট! এসব অনুষঙ্গে জীবন বর্ণিল হয়েছে সত্য; সেইসঙ্গে মৃত্যুরও যেন নতুন কিছু আঙ্গিক সৃষ্টি হয়েছে। যদিও আর দশটা বিষয়ের মতো এটিকেও পুরনোই বলা যায়। বিষয়টি অনেকটা গা সওয়াও হয়ে গেছে বটেন!

কখনো রেললাইনে বসে স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হচ্ছে কিশোর-যুবকের শরীর। কখনো বা সেলফি তুলতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ যাচ্ছে। টিকটক ভিডিও করতে গিয়ে নদী বা সমুদ্রে নিখোঁজের খবর হরহামেশাই আসছে। এগুলোকে কী বলা যায়? স্মার্ট জীবনে খেই হারিয়ে আনস্মার্ট মৃত্যু? নাকি আত্মঘাতি শখের কাছে জীবনের করুণ পরিণতি! প্রতিনিয়ত এসব ঘটনা ঘটেই চলেছে। অথচ এদের হুশ ফিরছে না। লাইক-ভিউ-ফলোয়ারের নেশায় এরা উদভ্রান্ত। পরিণতি নিয়ে ভাবার ফুরসত কোথায়!

কতো বিপদজনক সেলফি তুলে কত বেশি লাইক পাওয়া যাবে। কুরুচিপূর্ণ, মাত্রাহীন অশ্লীলতার মাধ্যমে কীভাবে চমক সৃষ্টি করা যাবে- সেই নেশায় এরা মত্ত। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, এদের হিতাহিত জ্ঞান নিয়েও প্রশ্ন জাগে। বিশেষ করে এবারের ঈদুল আজহায় একাধিক এমন ঘটনায় উৎসবযাত্রা পরিণত হয়েছে শবযাত্রায়। নিভৃত পল্লীতে প্রিয়জনকে আলিঙ্গনের প্রতীক্ষায় ছিলেন যারা, তারা পেয়েছেন স্বজনের নিথর দেহ। উৎসবের বদলে বাড়ির আঙিনায় নেমে এসেছে বিষাদের কালো ছায়া।

চলতি বছর টিকটকে ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে ১০ জন তরুণ-তরুণী প্রাণ হারিয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন। বুধবার সংগঠনটির পক্ষ থেকে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করা হয়।

গত মঙ্গলবার গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে মাথা বের করে সেলফি তোলার সময় এক যাত্রীর মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি রেলস্টেশন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

এর আগের দিন সোমবার কুমিল্লার লাকসামে ট্রেনের ছাদে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে টিকটক ভিডিও তৈরি করার সময় ছিটকে পড়ে মেহেদী (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে লাকসাম পৌর শহরের দৌলতগঞ্জ বাজারের চাঁদপুর রেলগট এলাকায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে।

এ দুটি ঘটনা নিছক উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরলাম। যারা গণমাধ্যমে নিয়মিত চোখ রাখেন, তারা জানেন নিকট অতীতে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটছে বলা যায়। আর কানে হেডফোন দিয়ে ট্রেন লাইনে হেঁটে বা বসে থাকার কারণে যে গত কয়েক বছরে কতজনের মৃত্যু হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কানে হেডফোন থাকায় ট্রেনের তীব্র হুইসেলেও তারা সতর্ক হতে পারেনি। পারার কথাও না। সতর্ক তো আগেই হবার কথা ছিলো। ট্রেন লাইন বসার জায়গা নয়। যে কোনো সময় ট্রেন আসতে পারে। আর কানে হেডফোন থাকলে কোনো শব্দই যে শোনা যাবে না সেই কাণ্ডজ্ঞানও এদের থাকে না।

এভাবে আর কত? স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া আর টিকটক আসক্ত লাগামহীন এই কিশোর-যুবকদের রাশ টানার উপায় কী! ভয়ঙ্কর এই নেশা থেকে কীভাবে এদের মুক্ত করা যায় সে বিষয়টি জোরেশোরে ভাবার সময় এসেছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে আরো পস্তাতে হবে।

স্মার্টফোনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার জো নেই। শুধু শখ বা বিলাসিতা নয়; এগুলো এখন জ্ঞান আহরণেরও অন্যতম মাধ্যম- একথা বিলক্ষণ ঠিক। কারণ মুহূর্তেই সারা দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটের চেয়ে সহজ ও দ্রুততম কোনো মাধ্যম নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এর অপপ্রয়োগ নিয়ে। বিশেষ করে আমাদের দেশে শিশু-কিশোরদের জন্য স্মার্টফোন যেন সব খোয়ানোর মাধ্যমে হয়ে দাড়াচ্ছে।

বস্তুত, সন্তানের আবদার মেটাতে তার হাতে স্মার্টফোন তুলে দেয়ার আগে গভীরভাবে ভাবতে হবে। স্মার্টফোন হাতে পেয়ে প্রিয় সন্তানটি যে উচ্ছন্নে যাবে না, টিকটক করতে গিয়ে যে মৃত্যুফাঁদে পা দেবে না। স্মার্টফোনে ডুবে জীবনকেই ঝুঁকিতে ফেলবে না সে বিষয়ে ভাবার অবকাশ আছে বৈকি!

লেখক: সাংবাদিক

বাংলাদেশ জার্নাল/আরকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত