ঢাকা, শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

ডাইমিথাইল-মারকারি -- হিটলারের পরাজয়

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:৫৮

ডাইমিথাইল-মারকারি -- হিটলারের পরাজয়

প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান বিপরীত প্রতিক্রিয়া না জেনে হিটলারের যুদ্ধ বহরের মর্দা ঘোড়াগুলো সময়-অসময় নিজেদের সমীপে নিরীহ গাধাবহরে হিম্মত জানান দিতে- মালটানা নিরীহ গাধা সম্প্রদায়ের বৌ-ঝিদের উপর একের পর এক যৌন দুর্ঘটনা চালিয়ে যেতে থাকল। গাধিগুলো আতঙ্কিত মনে রক্তাক্ত হয়ে ধর্ষিত হলো। বিপদে গাধাকে কাছে না পেয়ে গাধিরা গাধাদের চরম ভৎর্সনা করল। চিৎকার করে বলল - 'গাধার বাচ্চা তোদের জীবনটাই বৃথা।' গাধিরা ক্ষোভে দুঃখে কত কতেক সময়ে গাধাদের পশ্চাদ্দেশে ক'টা লাথিও দিলো।

গাধারা গাধি সমীপে সবিনয়ে কেঁদে কেঁদে বলল: "দ্যাখো- আমাদের বাপ-দাদা কেউই কারোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। আমরা দিনরাত মার খাই। চিৎকার করতে পারি না। এমন কী কাঁদতেও পারি না। চিৎকার করলে মানুষ বলে, 'গাধার চিৎকার অমঙ্গল।' না থামা পর্যন্ত আমাদের পেটায়। আমাদের জন্মই তো হয়েছে নীরবতার জন্যে- মৌনতা খাবার জন্যে, নীরবে কাঁদবার জন্যে। আমরা নামমাত্র খাব-দাব আমৃত্যু মানুষের বোঝা টানব ।'

ঘোটকীকুল পিদিম বিরহের একচ্ছত্র আলো ছড়িয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে বুঝতে পারল- তাদের পার্টনার হিটলারের মতো নতুন নতুন গবেষণ মনে নিজেদের নিজস্বী হারিয়ে নিরীহ গাধিদের উপর একের পর এক যৌন দুর্ঘটনা চালিয়ে যাচ্ছে। গাধিরা মনে মনে অসুখি হলেও আবার মহাখুশি! তাদের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হতে চলেছে। ঠিক যাপিত সময়ের রাজা-মহারাজা, বাদশাহ-সম্রাটের হেরেমখানা অন্দরমহলে বন্দিনী অগুনতি যৌনদাসী রানীদের মতোন। একজন সম্রাট কিংবা রাজার একটা শিশ্ন। হোক- আগামোটা গোড়া চিকন। হোক, বিশেষ মুহূর্তে নেতিয়ে পড়ে এমন। হোক না- দাসী যোনির কাছে সম্রাট শিশ্নের পরাজয়- তাতে কী? রাজার শিশ্নে রাজ হেকিমের হাতে বানানো যৌনবর্ধক তেল মেখে মোদক হালুয়া গণ্ডারের শিং দেশি কই মাগুরের ঝোল, লাল ঝুঁটি মোরগ পোলাও, ঝিনুকের স্যুপ, হরিণের কস্তুরী পান খেয়ে দু’ চার একশ পাঁচশ হাজার যৌনদাসী, খোজা পাহারার অন্দর মহলের অনেক রানী, নতুন নতুন বাছাই করা হেরে গিয়ে পালিয়ে বাঁচা-মরা রাজাদের অনিন্দ্য সুন্দরী গণিমতের খাঁচায় বন্দী রানী বৌ-ঝি সামলে রাজকার্য পরিচালনা করা কিন্তু লুটেরা সম্রাটের চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও সম্রাট রাজাদের বিরুদ্ধে মাসের পর মাস বছরান্তে বিরহকাতর স্ত্রী যৌনদাসী সরব-নীরবে ক্ষীণ শব্দ করবার সুযোগ নাই।

অবাধ্য পরিণতি সকলের জানা। মুণ্ড কেটে থালা ভরে সকালে রাজদরবারে প্রকাশ্যে দেখানো হয়। তাই নিয়তি মেনে যে যার মতো- দাসী রানী রাজবন্দিনী হয়ে সময় পার করে দেয়। রাজারই বা কী দোষ!? সে তো ইচ্ছে করলে বায়োলজিক্যাল দেহ ঘড়ির সেকেণ্ড মিনিট ঘণ্টার কাঁটা পাল্টাতে পারবে না।

ঘোটকীর তো রাজা নেই। নেই খোজা ঘোটরের পাহারা। নেই গর্দান হারাবার ভয়। তাতানো যৌবন জ্বালা নিয়ে দিশেহারা ঘোটকীরা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে দেখে- গাধির নিরীহ স্বামী গাধাগুলো হালকা দাঁত কেলিয়ে মোক্ষম সময় বুঝে ঘোটকীর সাথে ইচ্ছের মিলন ঘটিয়ে দিতে চান। ব্যস! এই পর্যন্ত। পরেরটা মিউল-হিনি বর্ণশংকর ইতিহাস।

হিটলারের তেজি ঘোড়া বাহাদুর চ্যাং কেঁদে কেঁদে তার ঘোটকী সুন্দরী বউ উল্কীর গাধা প্রেমিক মিল্কীর পরকীয়ার বিচার চাইলো।

হিটলার তখন ইভা ব্রাউনের সাথে প্রেম যুদ্ধের ছলাকলা অনুরাগের স্থাপত্যকলা সঙ্গম-জঙ্গমে যুদ্ধ জেতার কৌশল হাতে-কলমে পরখ করছিলেন। তার প্রিয় ঘোড়ার মানসিক দুরবস্থা দেখে হিটলার ভেঙে পড়লেন। ইভা ব্রাউনকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেন, 'মরণেও তারা একসাথে থাকবেন।'

বন্ধু গোয়েবলস আগ বাড়িয়ে বললেনঃ 'বন্ধু তোমার কত কত কাজ। সবেমাত্র ষাট হাজার ইহুদী নিধন করেছ। নির্বংশ করা নাগাদ তোমার অনেক কাজ বাকী। ছোট খাটো ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে আমার উপরে ছেড়ে দাও।'

ঘোটকীর ঔরসে গাধার বাচ্চা দেখে হিটলার বাহিনীর কেউই মেনে নিতে পারেননি; কিন্তু গাধীর ঘরে ঘোটকের বাচ্চা দেখে নিরঙ্কুশ মনে সবাই মেনে নিয়েছেন। গোয়েবল চিন্তা করলেন- 'আসলে আমাদের গাধা-ঘোড়া উভয়েরই দরকার। যা হবার তো হয়েছেই। নতুন করে ফ্যাসাদ বাড়ালে দুর্গম এই অঞ্চলে আমাদের মহাবিপদ। গাধা মার খাবে, হাঁটবে না। ঘোড়া দৌড়াবে না। সুযোগ নিয়ে তেজি ঘোড়া অবাধ্য হবে। আমাদের নীচে ফেলে দিবে।'

হিটলার বাহিনীর সামনে ভীষণ উর্বর মহাবিপদ সংকেত অপেক্ষা করছে। একদিকে সামনে বরফ পড়া মৌসুম শুরু হতে চলেছে। অপরদিকে গাধা ঘোড়া বর্ণশংকর প্রজনন যুদ্ধ হিটলার বাহিনীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। হিটলারের চিন্তা অন্যখানে। পৃথিবীতে চিরদিন এক সময় স্থায়ী পরিস্থিতি বলতে কিছু নেই। সময় চলে তার নিজস্ব নিয়মে সুযোগ পরিস্থিতি ও সুবিধেমতো মত-পথ পাল্টায়। পৃথিবীতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় বলতেও কিছু নাই। হোক না সেটা সীসা ঢালাই বাঙ্কার গহীণ জঙ্গল কিংবা গভীর সমুদ্র।

দার্শনিক ডায়োজিনিস নিজের একটি কথা বার বার বলতেন, 'আমি অহেতুক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে বসবাস করি।' হিটলার চিন্তা করতে লাগলেন, 'আহা! আমার পূর্বসূরীর তেমন কিছু ছিলো না। আমি নিজেও একসময় একাকি বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করতাম। পোস্টকার্ড বিজ্ঞাপনের ছবি এঁকে সামান্য উপার্জন করতাম। এত এত মোহ ক্ষমতা প্রাচুর্য ভোগ আমার জীবনে খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো? ঠাণ্ডা এসে যাচ্ছে। মিত্রবাহিনীর হাতে কী পরাজয় অত্যাসন্ন?

দার্শনিক ডায়োজিনিস দ্য সিনিক আলেকজাণ্ডারকে প্রশ্ন করেছিলেন -

'বৎস! তুমি এখন কী করতে চাও?'

বিশ্ব জয় করতে চাই।

- তারপর?

ঘরে ফিরে বিশ্রাম নেবো।

গুরু দার্শনিক ডায়োজিনিস বললেন,'তাহলে তোমার যুদ্ধের দরকার কী? এখনি বিশ্রাম করতে পারো। '

যুগে যুগে মানুষ নামের প্রাণীটি কেউ কী শুনেছে কারোর নীতিকথা? নীতি আদর্শ দয়া-মায়া সময়ের সাথে সাথে নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই মিটমাট করে নিয়েছে। হোক সেটা নৈতিক-অনৈতিক হোক না শত্রু-মিত্র। একমাত্র মানুষ নামের প্রাণীটি যে নিরঙ্কুশ ভণ্ড ও জাত বেঈমান, তা সময়ের ভাঁজে ভাঁজে বহুরূপী স্বার্থান্ধ জীবনের প্রয়োজনে নিজেদের সেরাটা চিনিয়েছে।

হিটলার ইভা ব্রাউন ছাড়া বাঙ্কারে একা টিকে থাকতে চাইলো। তাকে ছেড়ে যেতে ইভাতে নির্দেশ দিলো। ইভা গোঁয়ার প্রেমিক হিটলার বিরহে এক মুহূর্তও বাইরে থাকতে রাজী নয় জানিয়ে দিলো। হিটলারের বুঝতে বাকি নেই- প্রেম ও যুদ্ধ একসাথে চলতে পারে না। যুদ্ধে প্রেমিকার সাথে গোলাপ ছোড়া যায়, মেশিনগান কামানের গোলা ছোড়া যায় না । হিটলারের এই সর্বনাশা প্রেম হিটলারের মিত্র মহল সামরিক কমাণ্ডারের চোখে মুখে আতঙ্কিত করে তুলেছে। কিন্তু তারা সাহস করে, প্রেম ও যুদ্ধ একসাথে জেতা যায় না। সিদ্ধান্তের মতামত প্রকাশে কিছুই বলতে পারলো না। উপরন্তু অনেক জেনারেল নিজেদের গর্দান বাঁচাতে স্তাবক হয়ে মিত্র বাহিনীর হাতে মনে মনে পরাজয় মানার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে বসে রইলো।

স্বামী প্রেমিক হিটলার পাশে- এটাই ইভা ব্রাউনের প্রেমের জয়। যুদ্ধের দামামা নিয়ে ইভার তেমন আগ্রহ নেই। হিটলারকে আদর-আত্তিরও কমতি রাখেননি। হিটলার মনে মনে ভাবলেন, 'আহা! যুদ্ধ হতে প্রেম বড়।

প্রেমের এত মহিমা জানলে আমি ইহুদি না মেরে প্রেমিক হতে চাইতাম। প্রেমের স্নাইপার বুলেট কবিতা লিখে হাজারো ইহুদি নারীর হৃদয় খুন করে ইতিহাসের

সেরা খুনি কবির খেতাব আমিই জিতে নিতাম।'

মিত্রবাহিনী ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হিটলার বাহিনীর রসদ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। পরাজয় সময়ের ব্যাপার বুঝে গাধা ঘোড়া বর্ণশংকর 'মিউল হিনি' অমীমাংসিত সিদ্ধান্ত থমকে আছে। হিটলার বন্ধু জোসেফ গোয়েবেলস একক সিদ্ধান্তে দফারফা করে দিলেন। বললেন, 'আজ হতে মিউন হিনিকে' খচ্চর নামে ডাকা হবে। তোরা স্বাধীন প্রাণী। মানুষওত তোদের মতো সুযোগ পেলে যৌন দুর্ঘটনা চালিয়ে দেয়। অজাচার সম্পর্কে সারাটাজীবন কাটিয়ে দেয়। সে সম্পর্কেও তোদের মতোন মানুষরূপী কিছু প্রাণী জন্ম নেয়। হরেক রকম তাদের নাম। রাজার ঘরে দাসীপুত্র, প্রজার ঘরে জারজ, প্রেমিকপুত্র, শত্রুর ঘরে শত্রুপুত্র, বেশ্যার ঘরে বেশ্যাপুত্র, যুদ্ধের ধর্ষণে নিজেদের যুদ্ধশিশু বানিয়ে নেয়।

গোয়োবেলস পলিসি ভাষণে 'খচ্চর' প্রজন্ম নিজেদের মহান ভাবতে শুরু করলো। মিত্র বাহিনী হিটলারের দুরবিন দূরত্বের আওতায় এসে গেল। হিটলারের চোখে মুখে বিন্দুমাত্র উদ্বেগের ছাপ নেই।

তখনো স্ত্রী ইভার বাহুডোরে। হিটলার ইভার কাছে শেষ পরামর্শ চাইলো। ইভা ব্রাউনের একটাই উত্তর, 'চলো আমরা পালিয়ে বাঁচি।' আমাদের যুদ্ধের দরকার নাই।' হিটলারের গোঁফ খাড়া হলো। সে নিজেকে

নিজে কাপুরুষ ভেবে ধিক্কার দিয়ে বললো, 'আসলে এই যুদ্ধ না জেতার একমাত্র কারণ- আমাদের প্রেম।' প্রেম আর যুদ্ধ একসাথে জেতা যায় না। প্রেমিক হলে কারোর হৃদয় জেতা যায়। যুদ্ধ জেতা যায় না। যোদ্ধা প্রেমিক হলে- অবসর নিতে হয়। কারোর অস্তিত্ব ধ্বংস করে দিতে তাকে প্রেমের নামে ছলনা মাকড়সা জালে জড়িয়ে দাও। সে অবশ্যই হেরে যাবে। ইভা যেভাবে আমি তোমার পা চেটেছি; সামরিক ম্যাপের দুর্বল গ্যাপের ভুলে যুদ্ধের বদলে বেছে নিয়েছি তোমার আয়েশী কোল।

হঠাৎ জেনারেল কাউন্ট ক্লাউস হিটলারের বাঙ্কারের সামনে চিৎকার করছে-

'স্যার।'

- চিৎকার করছো কেন?

: স্যার, ইভা মিত্রপক্ষের বিপ্লবী। ডাইমিথাইল-মার্কারি বিষ প্রয়োগে আপনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ইভা ব্রাউন একাই মিত্র বাহিনীকে জিতিয়ে দিয়েছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ। মেইল[email protected]

বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত