ঢাকা, শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

ভোটযুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘স্বতন্ত্র লীগ’

  প্রণব সাহা

প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:০৭  
আপডেট :
 ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:৪৮

ভোটযুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘স্বতন্ত্র লীগ’
প্রণব সাহা। ফাইল ছবি

বিএনপি বিহীন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আওয়ামী লীগ বনাম জাতীয় পার্টি? না ভোটের মাঠে তেমনটি হবে না এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে। বরং এবারের নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত। রাজনীতির মাঠে যাদের নামকরণ ‘স্বতন্ত্র লীগ’। ২০০৮ সাল থেকেই আসন সমঝোতা চলছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে। কিছুদিন দুই দল ছিল মহাজোটেও। মনে রাখতে হবে ২১ বছর পর যখন সুযোগ পেয়েছিল আওয়ামী লীগ তখন জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়েই সরকার গঠন করতে হয়েছিল তাদেরকে। জাতীয় পার্টির তখনকার মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তখন সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী হয়েছিলেন। পতিত সামরিক স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদও জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন।

এবারও আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির আসন সমঝোতা নিয়ে নাটক-যাত্রা কম হয়নি। নির্বাচন থেকে যেন জাতীয় পার্টি সরে না যায় সেজন্য ২৫টি আসনে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। জাতীয় পার্টির আসন হিসেবে চিহ্নিত নারায়ণগঞ্জেরে একটি আসনে আগেই কোনো প্রার্থী দেয়নি ক্ষমতাসীন দলটি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- যেসব কিংস পার্টি বড় আলোচনায় এসেছিল, সেই বিএনএম, তৃণমূল বিএনপিসহ বেশ কয়টি রাজনৈতিক দলের নেতারা সরকারের শীর্ষনেতৃত্বের সাথে বৈঠক করলেও তাদের জন্য কোনো আসন ছাড়েনি আওয়ামী লীগ।

১৭ ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৯৬ জন। যা গত নির্বাচনে ছিল ১ হাজার ৮৬৫ জন। ২০০৮ সালে ছিল ১৫৬৭ জন। ফলে দেশের অন্যতম একটি বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবারের নির্বাচন বর্জন করলেও অন্তত প্রার্থীর সংখ্যার ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন বড় হয়ে দেখা দেয়নি। এর অন্যতম কারণ স্বতন্ত্র প্রার্থীর ছড়াছড়ি। কৌশল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের নেতাদেরকে স্বতন্ত্র নির্বিচনের জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছে, ফলে জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম হয়েছে ১০১ আসনে ‘জয়ে বাধা’ স্বতন্ত্র।

জতীয় পার্টির চাওয়া অনুযায়ী আওয়ামী লীগের মনোনীত গাইবান্ধা-২ আসনের প্রার্থী জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা গিনি, যিনি পরপর তিনবার জয়ী হয়েছিলেন তাকেও দল বলি দিয়েছে। তবে এই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আব্দুর রশীদ সরকার (তিনবার জাতীয় পার্টি থেকে এমপি, ২০১৮ সালে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে পরাজিত) সহজে জয়ী হবেন এমনটি এখনি বলা যাবে না। এখানে শক্ত প্রার্থী সদর উপজেলার পদত্যাগী চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা সারোয়ার। রংপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম রাজুর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখানে জাতীয় পার্টির হোসেন মকবুল শাহরিয়ারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তার নিজ দলের সাবেক মহাসচিব স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান রাঙ্গা। আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান বাবলু প্রার্থী থাকায় ত্রি-মুখী ভোটযুদ্ধের আভাস মিলছে। রংপুর-৫ আসনে এবার আওয়ামী লীগের এমপি এ এইন এন আশিকুর রহমানের ছেলে রাশেক রহমান বাবার বদলে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী দলীয় নেতা জাকির হোসেন। কুষ্টিয়া জেলায় দুই হেভিওয়েট রাজনীতিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহাবুব উল হানিফের বিরুদ্ধে আছে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী। হাসানুল হক ইনুকে লড়তে হবে মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান কামরুল আরেফিন। মাহাবুব উল হানিফের বিরুদ্ধে লড়ছেন পারভেজ আনোয়ার তনু। যিনি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও পাঁচবারের পৌর মেয়র আনোয়ার আলির ছেলে। দুই জাতীয় নেতার জয় খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।

ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফরুল্লাহকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান এমপি নিক্সন চৌধুরীর। জয় সহজ হবে না বলাই যায় । কিশোরগঞ্জে তিনটি আসনে স্বতন্ত্র শক্তিশালী প্রার্থীরা বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবেন বলে আভাষ মিলছে। কিশোরগঞ্জ-১ আসনটিতে এমপি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তার মৃত্যুর পর এখানে দলীয় মনোনয়নে এমপি হয়েছিলেন তার বোন সৈয়দা জাকিয়া নুর লিপি। দলের মনোনয়নে এবারও তিনি নৌকার মাঝি। তবে তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তারই আপন বড়ভাই মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম। কিশোরগঞ্জ-১ আসনে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন পুলিশের সাবেক ডিআইজি আবদুল কাহার আকন্দ। এই আসনে দুইজন শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। একজন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সোহরাব উদ্দিন এবং অপরজন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক এমপি মেজর (অব.) আক্তারুজ্জামান। কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের নৌকার প্রার্থী বর্তমান এমপি আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে শক্ত অবস্থানে আছেন আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক ও হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত পাল। সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে শ ম রেজাউল করিম, গোলাম দস্তগীর গাজী, ফরহাদ হোসেন, শাহরিয়ার আলম, মাহাবুব আলীকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শক্ত মোকাবিলার মধ্যে পড়তে হতে পারে।

পিরোজপুর-১ আসনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল আউয়াল। নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকারের। এখানেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন শাহজাহান ভূইয়া। রাজশাহী-৬ আসনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক এমপি রায়হানুল হক। হবিগঞ্জ-৪ আসনে বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহাবুব আলীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন।

গাইবান্ধা-২ আসনে আব্দুর রশিদের লড়াই হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহ সারোয়ার কবীরের সাথে। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

ঢাকা-১৯ আসনে দুর্যোগ মন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান নৌকার প্রার্থী হিসেবে মোকাবিলা করতে হবে সাবেক এমপি তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদের সাথে।

আভাস মিলছে যে, কমপক্ষে ১০০টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই জয়-পরাজয়ের ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে। আর এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শতকরা ৯০ ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। আর যেসব প্রার্থী উপজেলার চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়রের পদ ছেড়ে সংসদে যেতে ভোটে নেমেছেন তাদেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর রাজনীতির মাঠে তারাই এখন অভিধা পাচ্ছে ‘তৃণমূল লীগ’ বা ‘স্বতন্ত্র লীগ’ হিসেবে। যদিও এর কোনো আইনি বা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই।

লেখক: সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ

বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত