ঢাকা, শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৭ মিনিট আগে
শিরোনাম

করোনা থেকে বেঁচে ফেরা একজনের অনুভূতি

‘আমার শত্রুরও যেন এ রোগ না হয়’

‘আমার শত্রুরও যেন এ রোগ না হয়’
লন্ডনে কমনওয়েলথের অনুষ্ঠানে পতাকা হাতে ওলুওয়াসুন ওসোওবি

লন্ডন থেকে ফেরার অল্প কিছুদিন পরেই ওলুওয়াসুন ওসোওবি’র মধ্যে লক্ষণগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। ২৯ বছর বয়সী এই নাইজেরিয়ান অধিকারকর্মী গত ৯ মার্চ যুক্তরাজ্যের রাজধানীতে ওমেনওয়েলথ দিবসের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অফিসিয়াল পতাকা বহন করেছিলেন। সেখান থেকে নাইজেরিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী লাগোসে ফেরার পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নতুন করোনভাইরাস বাহিত শ্বাসকষ্টজনিত রোগ কোভিড-১৯য়ে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা তা জানতে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

পরীক্ষায় তার দেহে করোনাভাইরাস সনাক্ত হয় এবং তিনি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা সমৃ্দ্ধ হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তাকে বিচ্ছিন্ন রেখে (আইসোলেশসন) চিকিৎসা দেয়া হয় এবং এই ভাইরাস থেকে মুক্তি হওয়ার আগ পর্ন্ত তিনি বিচ্ছিন্ন থাকেন। কোভিড-১৯ থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি মোর্চের শেষ নাগাদ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন।

ওসোওবি যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নিমিত্তে গঠিত‘স্ট্যান্ড টু এন্ড রেপ ইনেসিয়েটিভ’নামের একটি আইনজীবীদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি তার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং তার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে সম্প্রতি আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলেন।

বাংলাদেশ জার্নালের পাঠকদের জন্য ওই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ তুলে ধরা হলো।

করোনাভাইরাস রোগটি থেকে সেরে উঠার পর আপনার অনুভূতি কি?

ওসোওবি: কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠা তো অবশ্যই একটা দারুণ অনুভূতির ব্যাপার। আপনি যদি এই ভাইরাসে কারণে মারা গেছেন এমন লোকদের পরিসংখ্যান দেখতে পান, তবে সেটি তো যথেষ্ট উদ্বেগজনক। এ অবস্থায় আমার বেঁচে থাকাটা অবশ্যই একটি দারুণ ব্যাপার। আর বেঁচে আছি বলেই তো অন্যদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারছি। নাইজেরিয়ার অনেকেই এখন বিশ্বাস করতে পারবে, এটা কোনও বানানো গল্প নয়।

আপনি যখন অসুস্থ হলেন তখন আপনার মধ্যে কি কি লক্ষণ দেখা দিয়েছিল? আপনি তখন কেমন বোধ করছিলেন?

ওসোওবি: আমার প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল, সঙ্গে ভয়বিহ কাশি এবং ক্ষুধা কমে গিয়েছিল। কোভিড-১৯য়ে আক্রান্ত হলে যেসব লক্ষণ দেখা যায় তার সবক’টি আমার মধ্যে স্পষ্ট ছিল। তাই আমি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম। কেননা আমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম এবং সেরে উঠছিলাম না। ভাইরাস আমার সিস্টেম নষ্ট করে দিয়েছিল। আমার খুব দুর্বল লাগতো। সারাক্ষণ আমার মাথা ঘুরাতো এবং বিছানা থেকে উঠলেই পড়ে যেতে চাইতাম। আমি কোনও কিছুর স্বাদ পাচ্ছিলাম না, কিন্তু আমার ঘ্রাণ শক্তির প্রচণ্ড জোর ছিল। তাই আমাকে গন্ধ শুকে শুকে সব উপলব্ধি করতে হতো যেমন-পানি, খাবার এমনকি সাবানও। আমার কাছে সবকিছু বিস্বাদ ঠেকছিল। এটা ছিল সত্যিই খুব কঠিন সময়। আমার জন্য আসলেই খুব কঠিন মুহূর্ত গেছে। তবে এটাকে পরাজিত করতে পেরে আমি খুব খুশি। এটা এমন একটা বিশ্রী অভিজ্ঞতা, আমি চাই না আর কেউ এতে আক্রান্ত হউক।

আপনার পরীক্ষায় পজিটিভ রিপোর্ট আসার পর আপনার কি মনে হচ্ছিল?

ওসোওবি: আমার প্রথম মনে হয়েছিল আমি মরে যাচ্ছি। এই ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম যে, আমিও হয়তো করোনায় মৃতদের তালিকার একজন হিসাবে নাম লেখাতে চলেছি। তখন নিজেকে প্রশ্ন করেছি, ‘নাইজেরিয়া কি এই করোনা পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করার জন্য তৈরি? লাওস কি এখন এই পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করতে পারবে?’আমি সত্যিই খুব ভয় পাচ্ছিলাম।

চিকিৎসা কেন্দ্রে ডাক্তার ও নার্সদের সঙ্গে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

ওসোওবি: ভালো। যদিও শুরুটা অনেক নড়বড়ে ছিল। পরে অবশ্য আমরা নিজেদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিতে পেরেছিলাম। কেন্দ্রের প্রত্যেককে শীর্ষস্থানীয় পরিষেবা দেওয়ার জন্য তারা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে কিনা, এমনকি আমাকেসহ, সেটাও আমি দেখতে পেরেছি। আমার কাছে একজন চিকিৎসকের নাম্বার ছিল। তাই আমি তাকে টেক্সট করে বা ফোন করে বলতে পারতাম আমার লক্ষণগুলো। তো যখন আমি বমি করতে শুরু করলাম, তখন আমি তাকে টেক্সট পাঠালাম, ‘আমি মরতে চাই না, আমকে সাহায্য করুন।’তখন কিছু নার্স আমার কাছে ছুটে আসেন এবং আমাকে সাহস যোগাতে থাকে। তারাও আমার সঙ্গে প্রার্থনা করতে থাকেন।

আপনাকে কি ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল?

ওসোওবি: কোভিড-১৯ সারাতে আমাকে বেশ কিছু ওষুধ দেয়া হয়েছিল। আর ওই ওষুধগুলির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো দূর করার জন্য আমাকে আরও বেশ কয়েকটি ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। একটা সময় এমন হলো যে, কোনও ওষুধেই আমার বমি বন্ধ হচ্ছিলো না। তখন আমাকে বমি করার আকাঙ্ক্ষা দমন করার জন্যও ইঞ্জেকশন দিতে হয়েছিল। বমি যাতে না হয় এজন্য আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কেননা বমির কারণে ওষুধ রাখতে পারছিলাম না, সব বমির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ছিল। সে অবস্থায় ওষুধ শরীরে ধরে রাখতে পারাটা ছিল আমার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা ওই ভাইরাস আমার পাকস্থলীর সবকিছু বের করে দিচ্ছিলো। কিন্তু অবশেষে আমি পেরেছি। আর এটি এমন একটি যুদ্ধ যাতে আমি শেষ পর্যন্ত জিতেছি।

কীভাবে বদলালো পরিস্থিতি?

ওসোওবি: দিনে দিনে আমার অবস্থা ভালো হতে লাগলো এবং আমার বেঁচে থাকার সুযোগ তৈরি হতে লাগলো। এক পর্যায়ে বমি আর পাতলা পায়খানা বন্ধ হলো। মাথা ঘোরাটাও আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। আর এটি আমার সুস্থ হয়ে উঠার ইঙ্গিত ছিল। এ নিয়ে আমি সত্যিই উত্তেজিত ছিলাম। এটি আমার মধ্যে বেঁচে থাকার নতুন আশা তৈরি করেছিল। তারা সকালে, বিকেলে এবং রাতে আমার তাপমাত্রা পরীক্ষা করছিলেন - এবং শরীরের তাপমাত্রও কমছিল। আমার রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। আমার পালস ভাল হয়ে যাচ্ছিল। আমি আমার স্বাদ ফিরে পেয়েছিলাম। তখন, আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, এবারের মতো আমি তাহলে বেঁচে যাচ্ছি এবং এই ভাইরাসকে আমি পরাজিত করতে পেরেছি।

এখনও যেসব মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হননি তাদেরকে আপনি কি বার্তা দিতে চান?

ওসোওবি: প্লিজ, আপনারা বারবার সাবান পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে নিজেদের হাত ধুয়ে নিন এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকুন।

আমি আপনাদের নিজের প্রথম অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি , আপনাদের স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন (সেল্ফ আইসোলেট) থাকা কতটা প্রয়োজন। যতটা সম্ভব বাড়িতে থাকুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন যাতে আপনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত না হন এবং একই সঙ্গে অন্য কেউ আপনার দ্বারা সংক্রামিত হতে না পারে।

আসলে সব সামাজিক অনুষ্ঠানই গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনার স্বাস্থ্য এবং আপনার শরীর। তাই আপনার শরীরের কোনও সংক্রমণ বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আছে কিনা সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আপনাকে সঠিক ডায়েট গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে সেবন করতে হবে সঠিক ওষুধ।

আপনার করোনা থেকে সেরে উঠার এই অভিজ্ঞতাটি নিয়ে আপনি কী করতে চান?

ওসোওবি: আমি করোনাভাইরাস সংক্রামণের বিরুদ্ধে কাজ করতে চাই। বিশেষ করে এটি নিয়ে আমাদের দেশে যে সামাজিক ভুল ধারণাগুলো গড়ে উঠেছে সেগুলো দূর করতে চাই।

আশা করছি কোভিড-১৯ নিয়ে যেসব সামাজিক মিথ তৈরি হয়েছে সেগুলো মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে আমি আমার প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করবো। এছাড়া যারা করোনায় সংক্রামিত হয়েছেন তারা যাতে যথাযথ চিকিৎসা পান এবং আমার মতো বেঁচে উঠেন, সেজন্যও কাজ করবো।

আল জাজিরা অবলম্বনে মাহমুদা আকতার

এমএ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত