ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ৫১ মিনিট আগে
শিরোনাম

মৃত্যু হাতে নিয়ে বিজয়ের বার্তা এনেছিলেন বসীর আহমেদ

  জামালপুর সংবাদদাতা

প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:০৪  
আপডেট :
 ১০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:৩৪

মৃত্যু হাতে নিয়ে বিজয়ের বার্তা এনেছিলেন বসীর আহমেদ
মুক্তিযোদ্ধা বসীর আহমেদ

নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এক হাতে সাদা পতাকা আর এক হাতে সেরেন্ডার লেটার নিয়ে পাকবাহিনীর কামালপুর গ্যারিসনে গিয়ে বিজয়ের বার্তা বয়ে এনেছিলেন অসীম সাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বসীর আহমেদ। ১৬ বছর বয়সী বশির দশম শ্রেণিতে পড়াকালিন ১১নং সেক্টরে হেলাল কোম্পানির অধিনে যুদ্ধ করেছিলেন। অংশ নিয়েছিলেন একাধিক সন্মুখযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসের সাথে পালন করেছেন বীরত্বপুর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক পদকে ভূষিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা কাহিনী তুলে ধরে দৈনিক বাংলাদেশ জার্নালের মুখোমুখী হয়েছিলেন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ বীর প্রতীক।

যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন কিভাবে?

বশির আহমেদ : পাক সেনারা আমাদের দেশের মানুষকে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে বাঙালি নিধনের ধংসযজ্ঞ চালায়। প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে হানাদারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

কখন কিভাবে মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে গেলেন এবং যুদ্ধে অংশ নিলেন? বশির আহমেদ : আমার বাড়ি জামালপুর জেলার বকসীগঞ্জ উপজেলার ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম লাউচাপড়ায়। ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কাছে। যুদ্ধে যাব, ছোট হওয়ায় বাড়ি থেকে অনুমতি দিচ্ছে না। আমি এবং ভাগিনা বাড়ি থেকে পালাই। রওনা দেই ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বিলডোবা বিএসএফ ক্যাম্প হয়ে মহেন্দ্রগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেই। তারা শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে রেশন কার্ড করার পরামর্শ দেয়। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে শরণার্থী ক্যাম্পে না গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দেখা হয় আমার স্কুল শিক্ষক সোলামান হক স্যারের সাথে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরির দ্বায়িত্বে ছিলেন তিনি। তার কাছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে বলেন, তোমরা ছোট মানুষ, অস্ত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে পারবা না। এ বলে আমাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।

তারপর? বশির আহমেদ : ১৫ দিন আত্মীয়ের বাড়িতে থাকার পর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর পেলাম মুক্তিযুদ্ধে লোক নিচ্ছে। ফের লাইনে দাঁড়াই। সোলায়মান স্যার আমাদের দেখে বলেন, তোমরা আবার এসেছ? উত্তরে আমরা বলি স্যার মরি আর বাঁচি আমাদের যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ দেন। আমাদের প্রবল আগ্রহ দেখে তালিকায় নাম তুলে বলেন, বিকেলে কাঁথা বালিশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে চলে এসো। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমার।

কোথায় ট্রেনিং নিয়েছিলেন? বশির আহমেদ : মহেন্দ্রগঞ্জেই ট্রেনিং নিয়েছি। হাবিলদার ধন বাহাদুর সিং প্রথমে বাঁশের লাঠি পরে অস্ত্রের ট্রেনিং দেয়। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনী ক্যাম্পে আসার পর তাদের কাছে অস্ত্রের ট্রেনিং নেই।

আপনি কোন কোম্পানির অধিনে এবং কোন পজিশনে যুদ্ধ করেছেন? বশির আহমেদ : আমি হেলাল কোম্পানির অধিনে যুদ্ধ করেছি। পরবর্তীকালে মিত্র বাহিনীর একটি কোম্পানিতে নিযুক্ত হই। সেখানে রেকি করা, দু’ভাষির দ্বায়িত্ব পালন ও সন্মুখযুদ্ধেও অংশ নিয়েছি।

আপনি কোন কোন অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন? বশির আহমেদ : বেশিরভাগ অপারেশন কমালপুরেই চালিয়েছি। দেওয়ানগঞ্জসহ বিভিন্ন অপারেশনে গিয়েছি এবং আমাদের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের যে যুদ্ধে মর্টার সেলের আঘাতে পা হারিয়েছেন সেই যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলাম। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের নির্দেশ দিলেন তোমাদের কামালপুর আক্রমণে যেতে হবে। আমরা কামালপুর পাকবাহিনী ক্যাম্পের উত্তর পাশে এখন যেটি ভারতীয় চেকপোস্ট সেই স্থানে অবস্থান নেই। সরাসরি আক্রমণ করতে প্রস্তুত করে রাখা হয়। আমাদের সহযোগিতা করতে আরো ২টি প্লাটুন দুই সাইটে প্রস্তুত রাখা হয়। রাত ২টার সময় সেক্টর কমান্ডার তাহের অপারেশনের খবর জেনে গেছে বলে বাতিল করে আমাদের নিয়ে ভারতীয় গ্রাম ব্রাহ্মণপাড়া থেকে পুর্বদিকে টুংরো চর গ্রাম হয়ে বাংলাদেশে নয়াপাড়া গ্রাম দিয়ে মৃর্ধাপাড়া মোড়ে চলে আসেন। আসতে সকাল হয়ে যায়। মৃর্ধাপাড়া মোড়ের পশ্চিম পাশের কাঠের ব্রিজ ছিল। ব্রিজের পশ্চিম পাশে আখক্ষেতের দক্ষিণে বেশকিছু পাকসেনাদের দেখা গেল। তাহের স্যারকে আমরা বললাম, এদের উপর আক্রমণ করা হোক, ফায়ার করা হোক। তিনি আমাদের বলেন, না তাদেরকে মারবোনা ধরবো। এই বলেই তাহের স্যার রাস্তার উত্তর পাশ দিয়ে কাঠের ব্রিজের নিচে গেলে ৫০০ গজ দূরেই শিমুল গাছে পাক সেনাদের অবজারবেশন পোস্ট থেকে দেখে ফেলে। কামালপুর পাক বাহিনী ক্যাম্পে ওয়ারলেসে তারা বার্তা পাঠালে মুর্হুতেই ৬০ মিলিমিটার মর্টার সেল নিক্ষেপ করলে তাহের স্যারের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্রুত স্ট্রেচারে করে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে যাই। সেখান থেকে হেলিকপ্টারযোগে আসামের গোহাটিতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়।

যুদ্ধ চলাকালে উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি… বশির আহমেদ : কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্পের কোনায় শিমুল গাছের তলা থেকে রকেট ল্যান্সার নিক্ষেপ করে মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে আক্রমণ করে। আমাদের ক্যাম্প ছেড়ে নিচে নেমে যেতে হয়েছিল। দূর থেকে রকেট ল্যান্সারের গোলাবারুদ ক্যাম্পের উপর এসে পড়ছে। সেদিন ভয়াবহ হামলার মুখে পড়েছিলাম। সেই ভয়াল দৃশ্যটি আজো মনে পড়ে।

আপনি নিশ্চিত মৃত্যু জেনে সেরেন্ডার হাতে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্পে গিয়েছিলেন, বিজয়ের বার্তা বহনের গৌরবময় অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলুন… বশির আহমেদ : ৪ ডিসেম্বর সকাল বেলা যৌথ বাহিনীর ১১নং সেক্টর সেনাপতি বিগ্রেডিয়ার হরদেব সিং ক্লে উপস্থিত ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার উদ্দেশ্যে প্রস্তাব রাখলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনাদের আত্মসর্মপণের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে কামালপুর ক্যাম্পে। সবাই নিশ্চুপ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললাম আমি যাবো।

সেনাপতি আমাকে নির্দেশনা দেন, তুমি এক হাতে সাদা পতাকা আরেক হাতে সারেন্ডার লেটার নিয়ে যাবে। ক্যাম্পের কাছে বাঁধ রোডের কিছু উপরে উঠবে সাদা পতাকা ও সারেন্ডার লেটার দেখাবে এবং ইশারায় ডাকবে। তারা আসলে হাতে সেরেন্ডার লেটার হস্তান্তর করবে আর গুলি চালালে নিচে পজিশনে নেমে পড়বে, আমরা আর্টেলারি ফায়ার দিয়ে তাদের দমিয়ে রাখবো তুমি চলে আসবে। সকাল ৮টায় সাদা পতাকা হাতে সেরেন্ডার লেটার নিয়ে কামালপুর ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ব্রাহ্মণপাড়া থেকে কামালপুর ক্যাম্প পর্যন্ত পুরো জায়গাটা ফাঁকা। আমি সাদা পতাকা উড়িয়ে মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছালে পাকসেনারা দেখে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যার যার ব্যাংকারে পজিশন নেয়। আমি অর্ধেক না উঠে সাহস করে বাঁধ রোডের উপরে উঠে পড়লাম। তাদের সারেন্ডার লেটার দেখালাম ও ইশারায় ডাকতে থাকলাম। প্রায় ৩০ মিনিট ডাকলেও তারা কাছে না এসে উল্টো ইশায়ায় তাদের কাছে যেতে বলে।

তারপর? বশির আহমেদ : ক্যাম্পে ঢুকার রাস্তায় গ্রেনেড মাইন লে আউট করে রেখেছে। সে পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া খুবই ঝুঁকি। দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পর গুলি করতে পারে ভেবে সাবধানে পা ফেলে ক্যাম্পে পৌঁছি। একজন পাকিস্তানী আর্মি অফিসার এসে আমার হাত থেকে সেরেন্ডার লেটার ও সাদা পতাকা নিয়ে পিঠে হাত দিয়ে বলে মুক্তিযোদ্ধা তুম মাত গাবরাও। সেখানে আমাকে দুটি রুটি ডাল ও পানি খেতে দিল। আমার নিরাপত্তার জন্য একজন অফিসার নিয়োগ করে আশপাশে সৈন্যদের না আশার নির্দেশ দিলেন।

আমার দেরি দেখে ক্যাম্পের উপরে ভারতীয় ৪টি বিমান টহল দিল। অক্ষত রাখতে আমার হাত ধরে টান দিয়ে পাক আর্মি অফিসার বাংকারের অভ্যন্তরে নিয়ে গেল। বিমান থেকে একটি বোম নিক্ষেপ করে। তবে আমি ও পাকসেনাদের কেউই আক্রান্ত হয়নি। আধা ঘণ্টা পর রকেট ল্যান্সার মেরে ভারতীয় বিমান চলে গেল। ইতোমধ্যেই বিমান হামলায় পাক সেনাদের মধ্যে ভিতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেছে। আমাকে মেরে ফেলেছে ভেবে সাড়ে ৭ ঘণ্টা পর বেলা সোয়া ৩টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জু কে সেরেন্ডার লেটার ও সাদা পতাকা দিয়ে পাঠালো। সাড়ে ৩টার দিকে ভারতীয় যুদ্ধ বিমান পুনরায় কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ করলো। বিমান থেকে নিক্ষেপ করা বোমা ও রকেট ল্যান্সারে আঘাতে ৪জন পাক সেনা আহত হয়। এক অফিসার দৌড়ে এসে বলে তোমরা ফাঁকা মাঠে গিয়ে সাদা পতাকা দেখাও, আমরা আত্মসর্মপণ করবো। আমরা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে সাদা পতাকা উড়ালে ভারতীয় বিমান চলে যায়। ৪টার দিকে ক্যাম্পের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আনসার মালিক স্যারেন্ডার লেটারের জবাব লিখে সাথে সাদা পতাকা দিয়ে বলে তোমাদের ব্রিগেডিয়ারের কাছে পৌঁছিয়ে ফেরত লেটার নিয়ে আসো। আমি পৌঁছলে আত্মসর্মপণের শর্তাবলি লিখে ফেরত লেটার দিয়ে ফের পাক ক্যাম্পে আমাকে পাঠায়। পরে আমার সাথে পাকসেনারা অস্ত্র নামিয়ে আত্মসর্মপণ করে। আমাদের কামালপুর ক্যাম্প দখলের পর বাঙালির স্বাধীনতা লাভের সূচনা হয়। বাংলাদেশ বিজয়ের পথে যাত্রা শুরু করে। দ্রুত হানাদার মুক্ত হয় ১১নং সেক্টরের অন্যন্য অঞ্চলগুলো। পরে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী বিজয়ের বেশে রাস্তায় পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে জামালপুর ও টাঙ্গাইল দখল শেষে রাজধানী ঢাকা দখল করে। ১৬ ডিসেম্বর রেসর্কোস ময়দানে পাকবাহিনীর স্যারেন্ডার শেষে বাংলাদেশের আকাশে উড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন তা বাস্তবায়ন হয়েছে? বশির আহমেদ : না তা বাস্তবায়ন হয়নি। অপূর্ণ রয়ে গেছে অনেকটাই। স্বাধীনতার সত্যিকারের চেতনা থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। এই বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ সাথীরা জীবন দেয়নি।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন? বশির আহমেদ : আমাদের অসমাপ্ত কাজ ভবিষৎ প্রজন্মকে সম্পন্ন করার আহবান জানাচ্ছি। সমাজে নাগরিক বৈষম্য থাকবে না, রাষ্ট্রীয়ও অনিয়ম দুর্নীতি করতে হবে নির্মূল। সকল নাগরিক অধিকার ভোগ করবে জনগণ। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে।

সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ বশির আহমেদ : আপনিসহ বাংলাদেশ জার্নাল পরিবারকে ধন্যবাদ।

/এসকে/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত