ঢাকা, শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ন্যানোটেক গবেষণা ও ড. বাছিত

ন্যানোটেক গবেষণা ও ড. বাছিত

বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার একটি আকর্ষনীয় বিষয় হলো ন্যানোটেকনোলজি। ন্যানোটেকনোলজি, যাকে সংক্ষেপে ন্যানোটেক বলা হয়, অতি ক্ষুদ্রের এক জগৎ যা কখনোই খালি চোখে দেখা যায় না। পৃথিবীজুড়ে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, অস্ট্র্রেলিয়া, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অগণিত গবেষক, বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ে গবেষণা করছেন। ওইসব দেশের সরকার এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যানোটেক গবেষণায় মিলিয়ন ডলার গবেষণা বরাদ্দ দিচ্ছে। ভারতের আইআইটি সমূহ এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ন্যানোটেক গবেষণায় ইউরোপ আমেরিকার মত না হলেও যথেষ্ঠ উৎকর্ষ সাধন করেছে। অদূর ভবিষৎতে আরো ভাল কিছু করার কাঠামোগত প্রস্তুতি নিচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে ন্যানো বিষয়ক গবেষণায় বাংলাদেশের অবস্থা কেমন? এই বিষয়ে বিস্তারিত জানালেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাছিত।

বুয়েটের গবেষক ড. বাছিত, ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। এরইমধ্যে তিনি বুয়েটে ‘ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ নামে একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার অধীনে শিক্ষার্থীরা বিএসসি, এমএসসি, এমফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের লক্ষ্যে ন্যানোটেক বিষয়ে গবেষণা করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেনে মুস্তফা মনওয়ার সুজন।

বাংলাদেশ জার্নাল: ন্যানোটেকনোলজি বা ন্যানোটেক প্রযুক্তি কী?

ড. বাছিত : এক থেকে একশ ন্যানোমিটার স্কেলে বস্তুর গুণাবলী গবেষণা, নিয়ন্ত্রণ এবং মানবকল্যাণে ব্যবহারের কার্যকরী প্রযুক্তি উদ্ভাবন ন্যানোট্যাকনোলজির বিষয়। সাধারনত এক থেকে একশ ন্যানোমিটারকে ন্যানোস্কেল বলা হয়। এক ন্যানোমিটার হলো এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। খুব সাধারনভাবে বলা যায়, আমাদের মাথার একটি চুলের ব্যাস প্রায় পঞ্চাশ হাজার ন্যানোমিটার। অর্থাৎ একটি চুলকে পঞ্চাশ হাজার বার প্রস্থচ্ছেদ করলে প্রতি ভাগ পাবে এক ন্যানোমিটার। সুতরাং ন্যানো অতি ক্ষুদ্রের এক জগৎ এবং এটাই পদার্থের মৌলিক গাঠনিক উপাদান, যা পুরোপুরি প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত। উল্লেখ্য যে, ন্যানোমিটার স্কেলে বস্তুর ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক গুণাবলী সচরাচর দৃষ্ট একটি বস্তুর ওই গুণাবলী থেকে যোজন যোজন পৃথক।

বাংলাদেশ জার্নাল : ন্যানোটেকনোলজি গবেষণা কীভাবে সম্পন্ন করা হয়, শুনতে চাই

ড. বাছিত : ন্যানোসাইন্স এবং ন্যানোটেকনোলজি গবেষণা বিষয়টি হচ্ছে পুরোপুরি ইন্টারডিসিপ্লিনারি। অর্থাৎ এই বিষয়ে গবেষণার জন্য বিজ্ঞান, যেমন পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, আণবিক জীববিজ্ঞান, মেটারিয়ালস সায়েন্স ইত্যাদি আবার ইঞ্জিনিয়ারিং যেমন ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, কেমিকেল প্রভৃতির বিভিন্ন শাখা একত্রিত হয়ে গবেষণা পরিচালিত হয়। আপনি যদি খেয়াল করেন তবে দেখতে পাবেন পৃথিবীর বিখ্যাত জার্নাল, যেমন সাইন্স, নেচার, নেচার ন্যানোটেকনোলজি, ন্যানো লেটারর্স ইত্যাদিতে যখন একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তার গবেষকদের এফিলিয়েশন থাকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বা পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের। আর এটাই স্বাভাবিক কেননা ন্যানোটেক বিষয়ে গবেষণার জন্য সাইন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাবহারিক জ্ঞান যেমন অত্যাবশ্যক, ঠিক তেমনি অত্যাবশ্যক তাত্ত্বীক জ্ঞান এবং কম্পিউটেশনাল দক্ষতা। কাজেই ন্যানোটেক বিষয়ে যৌথ গবেষণা অনেকাংশেই অপরিহার্য।

বাংলাদেশ জার্নাল : বাংলাদেশে বর্তমানে ন্যানোটেকনোলজি গবেষণার অবস্থা কেমন ?

ড. বাছিত : এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুব সহজে দেয়া সম্ভাব নয়। কেননা হয়তো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেকেই নিজ উদ্যোগে গবেষণা করছেন, যা আমার জানা নেই। তবে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহাজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে অবকাঠামোগত বেশ উন্নয়ন হয়েছে। ওই সব বিভাগ থেকে বেশ ভালো মানের জার্নালে গবেষণা প্রকাশিত হচ্ছে। কিছু কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ও ভালো মানের গবেষণা করছে। তবে দেশে বর্তমানে অনেক নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ভালো গবেষক তৈরি না হলে সার্বিকভাবে গবেষণার মান ভালো বলা যাবে না।

বাংলাদেশ জার্নাল: ন্যানোটেকনোলজি গবেষণার শুরু কী করে হলো ?

ড. বাছিত: ন্যানো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রকৃতিতে মানব সৃষ্টি থেকেই বিদ্যামান। উদারণ হিসেবে, জীববিজ্ঞান, চুম্বকত্ব বা আলোক বিজ্ঞানের কথাই বলেন। সৃষ্টির শুরু থেকেই অনুজীবেরা মহাবিশ্বে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ম্যাগনেটিক ডোমেইন বা স্পিন সম্পর্কে ধারনা না থাকলেও সেই প্রস্তর যুগ থেকে মানুষ চুম্বকের ব্যবহার করছে, আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য না জেনেও আলোর ব্যবহার সর্বকালে সর্বত্র। কাজেই নির্দ্বিধায় বলা যায় ন্যানোটেক কোটি বছরের পুরনো প্রযুক্তি। তবে ন্যানোটেক গবেষণার ভিত্তি রচিত হয় ১৯৩১ সালে যখন জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাকস নল এবং আর্নেস্ট রুসকা ইলেকট্রন মাইক্রোস্ককাপ আবিষ্কার করেন। তারপর ১৯৫৯ সালে ক্যালিফনিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পদার্থ বিজ্ঞানীদের এক সভায় রিচার্ড ফাইনম্যানের বিখ্যাত বক্তৃতা "দেয়ার্স প্লেন্টি অব রুম অ্যাট দা বটম’’ প্রকাশিত হবার পর পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ন্যানোটেক গবেষণায় নড়ে চড়ে বসে। আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সব সময় বলি, এই বক্তৃতাটি জীবনে একটিবারের জন্য হলেও পড়ে দেখতে। ল্যাবরেটরির ন্যানো প্রযুক্তি গবেষণার সবচেয়ে দ্রুত বাস্তব প্রয়োগ হয় ডিস্ক ড্রাইভে যখন ১৯৮৮ সালে আলবার্ট ফার্ট এবং পিটার গুয়েনবার্গ জায়ান্ট ম্যাগনোটোরেজিস্ট্যান্স আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কারের পর বিখ্যাত কয়েকটি ডাটা স্টোরেজ কোম্পানী চৌম্বক পদার্থের মাঝখানে অচৌম্বক পদার্থের স্তর স্যান্ডউইচ করে এমন একটি ডিস্ক ড্রাইভ তৈরি করে, যার তথ্য সঞ্চয় ক্ষমতা এবং সংবেদনশীলতা সাধারণ ডিস্কের তুলনায় অনেক অনেক গুন বেশি। অতি ক্ষুদ্র জায়গায় বেশি ডেটা সঞ্চয় সম্ভাব হয়েছে বলে আজ একটি ডিভাইসের বহুবিধ ব্যবহার করা যাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, জায়ান্ট ম্যাগনোটোরেজিস্ট্যান্স বিষয়ক গবেষণার জন্য ২০০৭ সালে আলবার্ট ফার্ট এবং পিটার গুয়েনবার্গ পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। ঠিক ওই সময়ে আমি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে চুম্বকের ডোমেইন কন্ট্রোলিং এর ওপর গবেষণা শুরু করি। একই বিষয়ে গবেষণা করার কারণে পরবর্তীতে আলবার্ট ফার্ট এবং পিটার গুয়েনবার্গের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আমার সাক্ষাৎ হয়। পিটার গুয়েনবার্গ তখন রিটায়াডর্; সরাসরি গবেষণায় তিনি খুব একটা জড়িত ছিলেন না। তবে ফরাসী বিজ্ঞানী আলবাট ফার্ট এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ।

বাংলাদেশ জার্নাল: ন্যানোটেক গবেষণায় আপনার উৎসাহের শুরুটা কি তখনই হয়েছে ?

ড. বাছিত: নিশ্চিতভাবেই গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে লর্ড ক্যালভিন (প্রফেসর উইলিয়াম থমসন) এর নামে প্রতিষ্ঠিত কেলভিন ন্যানোকারেকটারাইজেশন সেন্টার অথবা অত্যাধুনিক জেমস ওয়াট ন্যানোফেব্রিকেশন সেন্টারে গবেষণা করা আমার জীবনে খুবই সৌভাগ্যের একটি বিষয়। ওইসব সেন্টারে গবেষণা করার সময় আক্ষেপ হতো, যদি আমাদের দেশে এই রকম গবেষনাগার থাকতো। দেশের দুই-চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ন্যানোটেক রিসার্চ সেন্টার তৈরি করতে কত আর খরচ হবে, সর্বোচ্চ দেড়-দুই হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সাইন্স, বেঙ্গালুর প্রতিষ্ঠা করে সেন্টার ফর ন্যানো সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। ওই প্রতিষ্ঠানের গবেষনা সুযোগ সুবিধা শুধু ভারতীয়রা নয়, বাংলাদেশীরাও ব্যবহার করতে পারি। অনুরুপ ন্যানো রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি।

বাংলাদেশ জার্নাল: আমরা জেনেছি যে, আপনি এরইমধ্যে বুয়েটে ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরি নামে একটি অত্যাধুনিক গবেষনাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন, এ ব্যাপারে কিছু বলেন।

ড. বাছিত: হ্যাঁ, ন্যানোটেক গবেষণার জন্য একটি ল্যাবরেটরি তৈরি করার চেষ্টা করছি ২০১৪ সাল থেকে।

বাংলাদেশ জার্নাল: আপনার ন্যানো ল্যাব বিষয়ে যদি একটু বিস্তারিত বলেন।

ড. বাছিত: ২০১১ সালের মে মাসে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি থিসিস জমা দিয়েই আমি দেশে প্রত্যাবর্তন করি। বুয়েটের বিভিন্ন বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, কিছু বিভাগে ন্যানোটেক বিষয়ে কিছু কোর্স পড়ানো হয় এবং একই সাথে তত্ত্বীয় গবেষণা হয়। তত্ত্বীয় গবেষণা করে বুয়েটের অনেক গবেষক বছরে বেশ কিছু ভালো মানের জার্নালে পেপার প্রকাশ করেন। এক্ষেত্রে একটি বিষয় মানতেই হবে, শুধু তত্ত্বীয় গবেষণা দিয়ে ন্যানো গবেষণার ভালো ফল আশা করা সম্ভব নয় এবং তা সব ক্ষেত্রে বাস্তব সম্মতও হয় না। তাই তত্ত্বীয় গবেষণা শুরু না করে আমি একটি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা শুরু করি। প্রথমে যে সমস্যার সম্মুখীন হই তা হলো ল্যাবরেটরির জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা সংকট। বুয়েটের স্পেস যথেষ্ট সীমিত এবং বিশেষ করে পুরাতন একাডেমিক ভবন যেখানে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ অবস্থিত, সেখানে খালি কোন জায়গা নাই বললেই চলে। তারপরেও বার বার বিভাগীয় প্রধানের কাছে একটি রুম দেয়ার জন্য বলতে থাকি। এভাবে দুই বছরের বেশি সময় কেটে গেল। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বিভাগের স্টোর রুমটি ল্যাবরেটরি হিসাবে উপযোগী করে গড়ে তোলার অনুমতি দেয়া হলো। ওই সময় থেকে শুরু হলো আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। এক সাথে তিনটি কাজ করতে থাকলাম; প্রথমত, বিদেশী কোলাবরেটর নিয়ে কিছু গবেষণা সম্পন্ন করা এবং সেগুলো প্রকাশ করা, দ্বিতীয়ত, গবেষণা বরাদ্দের জন্য দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংস্থায় আবেদন করা; এবং তৃতীয়ত, রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কিছু আসবাবপত্র এবং কিছু যন্ত্রপাতি কেনা।

অত্যন্ত সৌভাগ্যের কথা যে, ২০১৪ সালে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিকস এর জার্নাল, ‘জার্নাল অব এ্যাপ্লাইড ফিজিকস’ এবং রয়াল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি এর জার্নাল ‘ন্যানোস্কেল’ এ আমাদের দুইটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। এই দুইটি প্রবন্ধ আমাকে গবেষণা ফান্ড পেতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। আমি ২০১৪-২০১৫ সালে একে একে পাঁচটি গবেষণা ফান্ড পেয়ে যাই। প্রথমে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন থেকে এক লাখ ছত্রিশ হাজার টাকার একটি ফান্ড পাই, এটাই ছিল শুরু। তারপর দি ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সাইন্স, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইনফ্রেস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানী লিমিটেড এবং বুয়েট থেকে প্রায় দুই কোটি টাকার ফান্ড পেয়ে যাই। ছাত্র, সহকর্মী, বুয়েট প্রশাসন সবার সহযোগিতায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠে আজকের ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটোরী। অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, ২০১৭ সালের মে মাসে উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ) এর আওতায় একটি উপ-প্রকল্প থেকে আরও এক কোটি নব্বই লাখ টাকা গ্রান্ট পাই; যার একটি বড় অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যানোটেকনোলজি রিসার্র্চ ল্যাবরেটরির জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে। এ যন্ত্রগুলো ডিসেম্বরের মাঝে চলে আসবে বলে আশা করি, তখন ল্যাবরেটরি আরো অনেক সমৃদ্ধ হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল: আপনার কথা শুনে একটি বিষয় পরিস্কার যে, ইচ্ছা থাকলে দেশে দুর্লভ ও ব্যয়বহুল বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং সেই ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য গবেষণা বরাদ্দ প্রাপ্তিও সম্ভব।

ড. বাছিত : অবশ্যই সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে গবেষণা প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। কোন গবেষক উদ্যমী এবং পরশ্রিমী হলে অর্থ পেতে খুব বেশী প্রতিবদ্ধকতা থাকবে বলে আমি মনে করি না। এছাড়া দি ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সাইন্স, ইনফ্রেস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানী লিমিটেড, এই রকম সংস্থা থেকেও গবেষণা বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব। আমাদের অনেকে হরাইজন -২০২০ এর কথা জানেন না। এই প্রকল্প থেকে ইউরোপের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথভাবে গবেষণা বরাদ্দ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এরইমধ্যে হরাইজন-২০২০ এর আওতায় কয়েকজন ফান্ড পেয়েছেন, অন্যরাও আবেদন করতে পারেন।

বাংলাদেশ জার্নাল: আপনার ন্যানোটেকনোলজি রিসার্র্চ ল্যাবরেটরিতে বর্তমানে কি ধরনের গবেষণা হচ্ছে এবং তার ইমপ্যাক্ট সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

ড. বাছিত: আমাদের গবেষণাগারটি তৈরি করা হচ্ছে ‘বটম আপ অ্যাপ্রোচ’ ফলো করে অর্থাৎ খুব ছোট থেকে ধীরে ধীরে ল্যাবরেটরির সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের গবেষণা পরিচালনার অ্যাপ্রোচ হচ্ছে ‘টপ ডাউন’; এ ক্ষেত্রে আমরা একটি বড় (বাল্ক) আকৃতির বস্তুকে ভেঙে ছোট ছোট কণা তৈরি করি; যা ন্যানোপার্টিক্যাল হিসেবে পরিচিত। এই ন্যানোপার্টিকেলের স্ট্রাকচার এবং ইলেকট্রিক, ম্যাগনেটিক বা অপটিক্যাল গুনাবলী বড় আকারের (বাল্ক) বস্তুর চেয়ে অনেক উন্নত এবং ব্যবহার উপযোগী। ইদানিং আমরা বিসমাথ আয়রন অক্সাইড ন্যানোপার্টিক্যালের সাথে গ্রাফিন মিক্স করে এক ধরনের ন্যানোক্মপাজিট তৈরি করেছি। এ ন্যানোক্মপাজিট ব্যাবহার করে সৌর শক্তির সাহায্যে পানিকে ভেঙে হাইড্রোজেন কনভারসন ইফিসিয়েন্সি অনেকগুন বৃদ্ধি করতে পেরেছি। সৌরশক্তির সাহায্যে উৎপাদিত হাইড্রোজেন ফুয়েল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, যা সম্পুর্ন কার্বন নিঃসরণমুক্ত। এ গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল জার্নাল অব এ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে প্রকাশিত হচ্ছে। গত তিন বছরে আমাদের গবেষণা ল্যাব থেকে অনেক শিক্ষার্থী আন্ডরগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রীর জন্য থিসিস করেছে, পনেরো জন এম ফিল/এমএসসি ডিগ্রী সম্পন্ন করেছে, আরো ছয় জনের ডিগ্রী প্রায় শেষের দিকে। বর্তমানে পাঁচ জন পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য গবেষণা শুরু করেছে।

গত তিন বছরে তেরটি জার্নাল পেপার আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স, ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স ইউ.কে এবং সমমানের পাবলিশার এর মানসম্মত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এসব পাবলিকেশনের ইমপ্যাক্ট উল্লেখযোগ্য, যা বুয়েট তথা বাংলাদেশকে বিশ্বে বৈজ্ঞানিক কম্যিউনিটিতে প্রতিনিধিত্ব করবে।

বাংলাদেশ জার্নাল: আপনার ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া অন্যান্য গবেষণা সহযোগীদের সম্পর্কে বলবেন?

ড. বাছিত : আমি আগেই বলেছি, ন্যানোটেক গবেষনা পুরোপুরি ইন্টারডিসিপ্লিনারি। বর্তমানে আমার সাথে বুয়েটের তড়িৎ কৌশল, যন্ত্রকৌশল, ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং, রসায়ন বিভাগের কয়েকজন সহকর্মী কাজ করছেন। আনান্দের সাথে জানাচ্ছি যে, গত কয়েক বছরে বুয়েটে গ্লাস এন্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আর্ন্তজাতিক মানের সুযোগ সুবিধা সংযোগ করেছে। গ্লাস এন্ড সিরামিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাথে আমাদের বেশ কিছু যৌথ গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে এবং গত দুই বছরে আমরা যৌথভাবে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ পাবলিশ করেছি। অদূর ভবিষ্যতে বুয়েটের সাইন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগগুলোর মধ্যে যৌথ কোলাবরেশনে অনেক যুগান্তকারি গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হবে বলে আমরা আশাবাদি। বুয়েটের সাথে দেশ-বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ কোলাবরেশন রয়েছে, যা আরও ফলপ্রসু হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল: একটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা বরাদ্দ খুবই কম। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?

ড. বাছিত : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক যা গবেষণা বরাদ্দ দেয়া হয় তা সত্যিই অপ্রতুল। তবে গত কয়েক বছরে মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের হেকেপ প্রজেক্ট এর মাধ্যমে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু বিভাগ কিছু অনুদান পেয়েছে এবং গবেষণা কার্যক্রম আগের চেয়ে অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। ঠিক একইভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়, শিক্ষা মন্ত্রনালয়, আইসিটি মন্ত্রনালয় থেকেও অনেক গবেষণা প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। যদিও প্রতি বছর এই বরাদ্দের পরিমান বাড়ছে, আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ জার্নাল: ন্যানোটেক ছাড়াও অন্য সব বিষয়ে গবেষণা বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া আর কি ধরনের ব্যাবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করেন ?

ড. বাছিত : ন্যানোটেক ছাড়াও বাংলাদেশে অন্য অনেক বিষয়ে ভালো ভালো গবেষক এক্সপেরিমেন্টাল এবং তাত্ত্বীক গবেষণা করছেন। যেকোন বিষয়ে একজন প্রধান গবেষকের গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে পিএইচডি ছাত্র এবং পোষ্ট ডকটোরাল ফেলোরা। আমি মনে করি, একজন ভালো অধ্যাপকের দুই-তিন জন পি.এইচ.ডি ছাত্র-ছাত্রী এবং অন্তত একজন পোস্ট ডকটোরাল ফেলো থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রতিবছর দেশ থেকে শত শত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী বিদেশে পাড়ি জমায়। পোস্টডকের কোন কালচার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখোনো গড়ে ওঠেনি। আমি মনে করি, একজন ভালোমানের পিএইচডি ছাত্রকে মাসে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা এবং একজন পোস্টডককে মাসে আশি হাজার থেকে এক লাখ টাকা ফেলোশিপ প্রদান করা উচিত, যাতে তারা দেশে পূর্ণকালীন গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারে। শুধু তাই না, বিদেশীদেরও পোস্টডক হিসেবে অ্যালাও করা উচিত। বিষয়টা আমাদের বেতন কাঠামোর সাথে কিছূটা সাংঘর্ষিক, তবে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন ছাড়া গবেষনায় ভালো ফলাফল আশা করা দুরূহ। আমাদের কিছু ভালো ছাত্র যাতে দেশে পিএইচডি করে এবং পিএইচডি শেষে পোস্টডক হিসেবে গবেষণা কন্টিনিউ করে তা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল: আপনি একটি উন্নত মানের ল্যাবরেটরি তৈরি করেছেন, অনেকে আপনার সুপারভিশনে থিসিস করেছে এবং আপনার গ্রুপ থেকে ভালোমানের অনেকগুলো আর্টিক্যাল ইতিমধ্যে মানসম্মত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে; তারপরেও জানতে চাই, আপনার কি কোন ধরনের আক্ষেপ আছে?

ড. বাছিত : অনেক কঠিন একটা প্রশ্ন। এসব সৃজনশীল কাজে সহজে আত্মতৃপ্ত হওয়া যায় না, হওয়া উচিৎও না। আমার গ্রুপের যাত্রা মাত্র শুরু হয়েছে, আমরা বাংলাদেশকে বৈজ্ঞানিক মানচিত্রে আরো ভালোভাবে উপস্থাপন করতে চাই। বুয়েট কৃর্তপক্ষের কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পাই। তবে আমার স্পেস খুবই সীমিত, অন্য বিভাগের বেশ কিছু সহকর্মী এবং আরও অনেক ছাত্র-ছাত্রী আমার সাথে গবেষনা করতে আগ্রহী। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে ল্যাবে কাজ করার জায়গা দিতে পারিনা, ব্যাপারটি বেদনাদায়ক।

কী স্বপ্ন দেখেন ?

ড. বাছিত : একটি স¦প্ন দেখি, ‘বুয়েট সেন্টার ফর ন্যানোটেকনোলোজি রিসার্চ’ একদিন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে; এ সেন্টারটি হবে সবদিক থেকে অত্যাধুনিক, ন্যানোটেক গবেষনায় বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিবে। এই রকম আরো কয়েকটি সেন্টার দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আরও কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে গড়ে উঠবে।

জেডএইচ/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত