ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ভালো ফলাফলের আড়ালে নানা অনিয়ম রংপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

  লাবনী ইয়াসমিন, রংপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২২, ২০:২৩

ভালো ফলাফলের আড়ালে নানা অনিয়ম রংপুরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
ছবি: প্রতিনিধি

প্রশ্নপত্র ফাঁসের গল্প সবাই জানলেও পরীক্ষার হলে উত্তরপত্রের যোগান দিয়ে রংপুরের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে এ-প্লাস নামীয় সোনার হরিণ। শিক্ষাব্যবসার ছকে মেধাবী শিক্ষার্থীর মেধা মূল্যায়নে ঝুলছে মুলো। এভাবে একদিন জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে, আশঙ্কা রংপুরের সাধারণ মানুষের।

২০১৯ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় রংপুর কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল এন্ড কলেজ এবং পুলিশ লাইনস স্কুল এন্ড কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্র ছিল রংপুর কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে। এই পরীক্ষাতেই অংশগ্রহণ করেন কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল মঞ্জুয়ারা পারভীনের ছেলে সাদমান আজাদ। পরীক্ষায় অন্যান্য শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে খাতা জমা দিলেও অতিরিক্ত আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা শিক্ষকদের পাহারায় লিখেন সাদমান। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা দেয় চাপা অসন্তোষ ও ক্ষোভ। কোনক্রমেই যে শিক্ষার্থী ভালো রেজাল্ট করতে পারে না, সেই শিক্ষার্থীর এ-প্লাস যেন বানরের গলায় মুক্তোর মালা।

এ নিয়ে পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল ড. একে এম জালাল উদ্দিন আকবরের সাথে কথা হলে তিনি অভিযোগটি উড়িয়ে দেন।

এদিকে, প্রশ্ন আসে পুলিশ লাইনস স্কুল এন্ড কলেজ কেন সুবিধা দেবে কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীকে? এর যোগসূত্র খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। শিক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষায় অবাধে অপরের খাতা দেখার সুযোগ, না পারলে শিক্ষকই বলে দেন উত্তর, নৈর্ব্যত্তিকে উত্তর যোগান, প্র্যাক্টিক্যালে অবাধে প্লাস মার্কস দেয়া, এ যেন শিক্ষার্থীকে জিপিএ-৫ পাইয়ে দেয়ার বিশাল দায়িত্ব কর্মরত শিক্ষকদের।

দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র অনুযায়ী চূড়ান্ত কলেজের তালিকা নির্ধারিত হয়। তালিকা অনুযায়ী কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের কেন্দ্র ছিল রংপুর আরসিসিআই স্কুল এন্ড কলেজ ও পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের কেন্দ্র ছিল লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ। পরীক্ষার দু’দিন আগে হঠাতই কেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়।

এ নিয়ে দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তোফাজ্জুর রহমানকে অনেকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নাম না প্রকাশ করার শর্তে দিনাজপুর বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পরীক্ষার আগে আগে সচিব স্যার (কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপালের স্বামী) ফোন দিয়েছিল। ফলে কেন্দ্র চেঞ্জ করে দেয়া হয়। মূলত কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে কেন্দ্রগুলো দেয়া হয়।’

কেন্দ্র পরিবর্তনের অনুরোধের কথা নাকচ করেছেন কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপালের স্বামী সাবেক সচিব আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রতিবেদককে ফোনে বলেন, ‘আমি কখনই কেন্দ্র পরিবর্তন কি, ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে নাক গলাইনি। কালেক্টরেটের বিভিন্ন নিয়োগে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কতিপয় স্বার্থান্বেষী গুজব ছড়াচ্ছে। রংপুরে সিনিয়র সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা করেন আমি কে।’

কেবল কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান নয়, হঠাৎ কেন্দ্র পরিবর্তনের দায় মাথায় নেননি পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল ড. একে এম জালাল উদ্দিন আকবরও। তিনি বলেন, কেন্দ্র পরিবর্তন করেছে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড, এখানে আমার কোন হাত নেই। অন্য কেউ পরিবর্তনের অনুরোধ করলে সেটা আমার দায় নয়।

কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের একজন শিক্ষক বলেন, ২০১৪ সালে থেকে এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাল্টাপাল্টি পরীক্ষা কেন্দ্র পড়ছে। এরপর থেকেই পুলিশ লাইনে শতভাগ পাশ এবং কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে মাত্র এক থেকে ২ জন ফেল করে। এছাড়া এই বছরগুলোতে পুলিশ লাইনস স্কুল এন্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ শতভাগ এ-প্লাস পেয়েছে। এগুলো কেমন করে হয়? কোনভাবেই এমন রেজাল্ট হতে পারে না।

ওই শিক্ষক আরও বলেন, ২০১৮ সালে কালেক্টরেট এর সিট বসেছিল আরসিসিআই স্কুল এন্ড কলেজে। কিন্তু সেখানে ভালো সুবিধা করতে না পারায় ২০১৯ সালে যেহেতু নিজের ছেলেও পরীক্ষা দেবে, তাই কোন ঝুঁকি নিতে চায়নি কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল। তড়িঘড়ি করে কেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়। এটি শুধু পুলিশ লাইন্স বা কালেক্টরেট নয়, রংপুরের অন্যান্য বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজের দৃশ্যও একই। তবে প্রথম শ্রেণির স্কুল এন্ড কলেজগুলো এই ফায়দা বেশি নিচ্ছে।কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের স্বার্থ বোঝা গেলেও পুলিশ লাইনের স্বার্থ খুঁজতে গিয়ে

এ বিষয়ে প্রতিবেদককে যেতে হয় অনুসন্ধানের আরও গভীরে। করোনাকালে অনুসন্ধান পিছিয়ে গেলেও ২০২২ সালে এসে প্রতিবেদকের হাতে আসে ৪১টি ওএমআর সিট। ২৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী সেদিন মানবিক বিভাগের ইতিহাস ২য় পত্র পরীক্ষা হয়। প্রতিদিনের মতো সেদিনও নির্বাচনী পরীক্ষার উত্তর আগেই ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেয়া হয়। পরীক্ষার্থীরা যথরীতি ৩০টি নৈর্ব্যত্তিকের উত্তর দেয়। পরে শিক্ষকরা জানায় ভুলবশত ইতিহাস ২য় পত্রের উত্তর না লিখে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ২য় পত্রের উত্তর ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা হয়েছিল। কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি করে পূর্বের ওএমআর সিট সরিয়ে নতুন ওএমআর সিট দেন শিক্ষার্থীদের এবং পরের শিটই জমা দেয়া হয় শিক্ষাবোর্ডে। তবে বাতিল করা ওএমআর শিটের ক্রমিক নাম্বারপত্র তোলা হয় সেদিনের নৈর্ব্যত্তিত হাজিরা পেপারে।

ওএমআর সিটে কক্ষ পরিদর্শকের সাক্ষর অনুযায়ী যোগাযোগ করা হয় কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের ভূগোলের সহকারী শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে। ওএমআরের ব্যাপারে কথা বলা হলে তিনি বলেন, ‘আমার ঠিক মনে পড়ছে না। আমি কখনই ওএমআর সিট পরিবর্তন করিনি। জমা দেয়ার পর কেউ পরিবর্তন করলে আমি জানি না।’

রোল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশন নাম্বারের ভিত্তিতে দেখা যায়, ২০১৯ সালে এই ৪১ জন শিক্ষার্থীর ১৬ জন জিপিএ-৫ ও ৯ জন জিপিএ-৪.৯২, অন্যরা বিভিন্ন পয়েন্ট পেয়ে পাশ করে। মূল ওএমআর সিট রংপুরে থাকলেও এই ৪১ জন শিক্ষার্থীর রেজাল্ট আসলো কিভাবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ভালো বলতে পারবেন।’

দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফসর হারুন অর রসীদ মন্ডল বলেন, ওএমআর সিট কেন্দ্র সচিবের দায়িত্বে থাকে। কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান। আমাদের কাছে ওএমআর সিট পরিবর্তনের অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ আসলে আমরা তদন্ত করতাম।’

এ নিয়ে কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রিন্সিপাল মঞ্জুয়ারা পারভীনের সাথে কথা বলা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না। আমার প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।’

তবে ৩ ঘণ্টা পর তিনিই প্রতিবেদককে ফোন করে জানান, ‘২০১৯ সালের পরীক্ষায় তিনি কেন্দ্র সচিব ছিলেন না। সেসময় কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব তিনি কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের ম্যানেজমেন্টের সহকারী অধ্যাপক ও প্রশাসনিক কো অর্ডিনেটর নাহেদ ফরিদকে দিয়েছিলেন। সেসময় কি হয়েছে তিনি বলতে পারেন না।

এ নিয়ে কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ ও পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা হয়। তারা বলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। বিগত ১০-১২ বছর থেকে বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে উত্তর যোগানের মহাসমারোহ চলছে। আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে জাতি মেধাশুন্য হয়ে পড়বে। এরাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করবে। এদের কাছে জাতি কি আশা করে? কিছু কিছু শিক্ষকের মাঝে লোভী মনোভাব, সম্পদ লিপ্সা, বিত্তবান হওয়ার আকাঙ্খা এ জাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। এখান থেকে সারাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র অনুমান করা যায়।’

দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের কিছু কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতি এবং রংপুরের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা বাণিজ্য দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে জানিয়ে এ বিষয়ে সরকারের কড়া নজরদারির দাবি করছেন রংপুরের সচেতন জনগণ।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত