ঢাকা, শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ আপডেট : ২৫ মিনিট আগে
শিরোনাম

অশুভ প্রতিযোগিতায় সড়কে ঝরছে প্রাণ

  তৌফিক ওরিন

প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০১৯, ২২:৩০

অশুভ প্রতিযোগিতায় সড়কে ঝরছে প্রাণ

যাত্রী তোলাকে কেন্দ্র করে বাস চালকরা প্রতিনিয়ত অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছেন। সড়কের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্রশাসনের নাকের ডগায় তারা স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এই প্রতিযোগিতার কারণেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রী, পথচারী এবং সাধারণ মানুষ। সড়কে কোনো ভাবেই থামছেনা মৃত্যুর মিছিল।

রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বাস স্টপেজ গুলোতে বাস চালকদের প্রতিযোগিতার মাত্রা বেড়ে যায়। পেছন থেকে সামনে যাওয়া, কখনো পেছনের বাসকে সামনে যেতে বাধা দেয়ার মত ঘটনা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর এগুলো বেশিরভাগই ঘটছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রকদের সামনেই। ইতোমধ্যে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীর ১২১টি বাস স্টপেজের স্থান নির্ধারণ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। এসব স্টপেজ ছাড়া অন্য কোথাও বাস না থামানোর নির্দেশ রয়েছে। তবে সেই নির্দেশ অমান্য করে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো নামানো করছেন পরিবহন শ্রমিকরা।

রাজধানীর ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, মতিঝিল, মিরপুর, গাবতলী, সায়েন্স ল্যাব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বাসচালকদের বিশৃঙ্খল আচরণ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) চলমান কর্মসূচির মধ্যেও বেপরোয়াভাবে বাস চলাচ্ছেন তারা।

গত বছর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ‘নিরাপদ সড়ক’ ও সড়ক পরিবহন আইন সংস্কারের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৬ আগস্ট চূড়ান্ত অনুমোদন পায় ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ আইন। সর্বোচ্চ পাঁচ বছর সাজার বিধান রেখে বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ওই আইনের ধারা ৩০৪ (বি) অনুযায়ী, ‘বেপরোয়া যানবাহন চালানোর কারণে মৃত্যু ঘটলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।’ সড়কের নৈরাজ্য দূর করতে এসব আইন তৈরি করা হলেও চালকদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। নিজেদের শক্তির জানান দিতে কে, কার আগে বাস স্টপেজ থেকে বেশি যাত্রী তুলতে পারবে, সেই প্রতিযোগিতা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন চালকরা।

সংশ্নিষ্টরা জানান, রাজধানীতে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দায়িত্ব সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি) ও ট্রাফিক পুলিশের। কিন্তু পরিবহন খাতে নৈরাজ্যের দায়িত্ব সরকারি এই পাঁচ সংস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এড়িয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, যথাযথ জবাবদিহি না থাকার কারণেই রাজধানীর রাজপথে নৈরাজ্য বিরাজ করছে।

তবে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা চিরতরে বন্ধের কার্যকর সমাধান দিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন সরকারের কাছে পরিবহন নৈরাজ্য বন্ধের যে পরিকল্পনা দেয়া হয়েছে সেটির প্রনয়ন করলে এই সমস্যার সমাধান হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এবং গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, ২০০৫ সালে এইচটিপিপিএ প্রনয়নের মাধ্যমে এর প্রতিকার দেয়া হয়েছিল। তখন সরকারের হাতে যে পরিকল্পনাপত্র দেয়া হয়েছিল সেটার মধ্যে বলা হয়েছিল পরিবহন সেক্টরে ঝামেলা রয়েছে। এই ঝামেলাকে দূর করার জন্য এটাকে কম্পানি বেজড এবং এখন যে খন্ডিত দ্বিখন্ডিত ছোট ছোট মালিক নির্ভর পরিবহন সেটাকে কর্পোরেটাইড করতে হবে। তাহলে প্রতিযোগী না থাকলে চালক যদি গাড়ি চালায়, চালক যদি বেতন পায় তাহলে সে যাত্রীদের সেবাটা দিতে পারবে। ২০০৫ সালে এমন কৌশলগত পরিকল্পনা ছিল। ২০১৩-১৪ সালে এসে এটাকে আরো ডিটেইল করে সে সময় সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়।

তিনি জানান, সে সময় দেড়শটা মত রুট ছিল, এখন তো তিনশ এর অধিক রুট রয়েছে। সেটাকে সংক্ষিপ্ত করে বাইশটা পরিবারে নিয়ে এসে ছয়টা কোম্পানির মাধ্যমে সেবা দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। তৎকালীন মেয়র গুলশান এলাকায় করেছিল ঢাকার চাকা আর হাতিরঝিলে রয়েছে আর একটা। ওই আদলে একটা কোম্পানির বাস চলবে আর চলবে না। এরকম পদ্ধতি চালু হলে বাসের গায়ে আচড় লাগে না, পরিবহন চালকরা যত্রতত্র যাত্রী তোলে না, অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে না এমনকি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুলিশও লাগেনা। এই জিনিসগুলো অনেক আগেই সহজ সরল ভাবে বলা আছে।

এখন থেকে দিক নির্দেশনার পরিবর্তে ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ বলেন, চলমান বিশৃঙ্খল সিস্টেমের অনেকে বেনিফিশিয়ারী আছে। বাসের রুট পারমিট না থাকলে কারো কারো সুবিধা হয়, বাস দুর্ঘটনায় পড়লে কারো কারো সুবিধা হয়, ড্রাইভারের লাইসেন্স না থাকলে কারো কারো সুবিধা হয়, হাজার হাজার বাস মালিক থাকলে সংগঠন করে দেশ অচল করার ক্ষমতা পায়। এই জায়গা গুলোতে অনেক প্রাপ্তি আছে। এজন্য সরকারকে একটু শক্ত হয়ে যারা বিশৃঙ্খল ব্যবস্থার জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই সরকার ধারাবাহিক সরকার, তাই এখনো যদি ব্যবস্থা না নিতে পারে তাহলে স্বাভাবিকভাবে সরকারের সক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে। এখন আর দিক নির্দেশনা নয়, এখন শুধু একশন।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় জানা গেছে, ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৬৬টি দুর্ঘটনায় ৬৯৯ জন নিহত এবং এক হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই বাসের কারণে ঘটেছে।

এদিকে গত ১৭ মার্চ থেকে রাজধানীতে চলছে ট্রাফিক সপ্তাহ, যা চলবে ২৩ মার্চ পর্যন্ত। ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহে সচেতনতা বৃদ্ধি, ট্রাফিক গাইড বুক প্রকাশ-প্রচার, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, টার্মিনালে সভা-সমাবেশ, সচেতনতামূলক ভিডিও প্রদর্শন, লিফলেট, পোস্টার বিতরণ, পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস ও জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপারে উদ্বুদ্ধ করাসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে ট্রাফিক সপ্তাহ চলাকালীন সময়ে গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর বসুন্ধরায় যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে নদ্দা এলাকায় সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় নিহত হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। দুটি বাসের রেশারেশির কারণে ওই ঘটনারও সূত্রপাত।

ওই ঘটনার পরে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন ওই শিক্ষার্থীরা। সাথে সাথে সেই আন্দোলন সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় তারা আট দফা দাবি ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে আলোচনা শেষে গত বুধবার সন্ধ্যা ছয়টার পর রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সামনের সড়কে এসে সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয়।

বাংলাদেশ জার্নাল/এনএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত